-->
শিরোনাম

গোলা ভরছে সোনালী ধানে কৃষকের মুখে হাসি

রুদ্র মিজান
গোলা ভরছে সোনালী ধানে কৃষকের মুখে হাসি

রুদ্র মিজান: হাওরাঞ্চলের কৃষকের চোখে-মুখে হাসির ঝিলিক। প্রাকৃতিক তেমন কোনো দুর্যোগের মুখোমুখি হতে হয়নি এবার। এখন পর্যন্ত ৯০ শতাংশের বেশি জমির ধান কাটা হয়েছে। বেশিরভাগ কৃষকের জমিতে ফলেছে বাম্পার ফলন। হাওর এলাকায় এবার ছড়িয়েছে খুশির বন্যা। নানা শঙ্কা কাটিয়ে গোলায় উঠছে সোনার ফসল।

 

কৃষক জানিয়েছেন, সতর্কতা থাকায় এবার মৌসুমের শুরুতে ধানের চারা রোপণের চেষ্টা করেছেন। একইভাবে চৈত্রের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকেই ধান কাটা শুরু হয়েছে।

 

যতদূর চোখ যায়, শুধু ধান আর ধান। সোনালি ধানে ভরে গেছে হাওর। হাওরের মধ্য দিয়ে এঁকেবেঁকে গেছে সড়ক। কাটা ধানের আঁটি নিয়ে ছুটে যাচ্ছে ট্রলি। সড়কের দুই পাশে মাড়াই হচ্ছে ধান। অনেকেই জমি থেকে ধান কেটে সড়কে রাখছেন। হাওরজুড়ে পাকা ধানের ম-ম ঘ্রাণ। এর মধ্যে হঠাৎ আকাশ অন্ধকার করে কালো মেঘ জড়ো হলে কেঁপে ওঠে কৃষকের বুক।

 

যদিও এরই মধ্যে বজ্রপাত ও ছোটখাটো ঝড়-বৃষ্টির সম্মুখীন হয়েছে কৃষকের উৎপাদিত ধান। গত ২৩ এপ্রিল সুনামগঞ্জে কালবৈশাখী ঝড়, বজ্রপাতে ছাতক, দোয়ারাবাজার ও তাহিরপুরসহ তিন উপজেলায় ধান কাটতে গিয়ে ছয় কৃষকের মৃত্যু ঘটেছে। তবে সবকিছুর পর হাসি ফুটেছে কৃষকের মুখে। বাড়ির সামনে বিশাল জায়গাজুড়ে রোদে ধান শুকাচ্ছেন কৃষানি। গ্রামের চিরায়ত এ দৃশপট।

 

সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আধুনিকতার ছোঁয়াও লেগেছে। গরুর গাড়ির স্থান যেমন দখল করেছে ইঞ্জিনচালিত ট্রলি, তেমনি ধান কাটা ও মাড়াই থেকে কৃষককে মুক্তি দিয়েছে কম্বাইন হারভেস্টার নামক যন্ত্র।

 

কৃষি মন্ত্রণালয় জানায়, হাওরের রাজধানীখ্যাত সুনামগঞ্জেই রয়েছে সহস্রাধিক কম্বাইন হারভেস্টার। পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যানুসারে দেশের ৪১৪টি হাওরের মধ্যে সুনামগঞ্জে রয়েছে ১৩৩টি। হাওরে এবার ধান কাটার শ্রমিক কম।

 

সুনামগঞ্জের কৃষক জানান, ধান কাটার জন্য দেশের বিভিন্ন এলাকার শ্রমিকরা চৈত্র-বৈশাখে সুনামগঞ্জে যান। গত কয়েক বছর ধরেই শ্রমিক সংকটে রয়েছেন তারা। তবে এবার শ্রমিক সংকটে অনেকে নিজেরাই ধান কাটছেন। সেইসঙ্গে এলাকার শ্রমিক তো রয়েছেনই। এতে শ্রমিকদের মজুরি দৈনিক ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা। তবে বেশিরভাগ জমিতে শ্রমিক ছাড়া ধান কাটা হচ্ছে। ব্যবহৃত হচ্ছে হারভেস্টার।

 

কিশোরগঞ্জের কৃষক ময়না মিয়া বলেন, মেশিনে ধান কাটার কারণে খড় বেশি উৎপন্ন হচ্ছে। তাছাড়া মাড়াইয়ের কষ্ট থেকেও মুক্তি মিলেছে। এক্ষেত্রে ১ কিয়ার বা ৩০ শতক জমির ধান কাটার জন্য কম্বাইন হারভেস্টার কর্তৃপক্ষকে দিতে হচ্ছে ১ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার টাকা পর্যন্ত।

 

এছাড়া স্বেচ্ছায় ধান কাটতে উৎসাহ দিতে হাওর পরিদর্শন ও ধান কেটেছেন তিন মন্ত্রী। কৃষকের ধান কেটে সহযোগিতা করেছেন আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ।

 

সুনামগঞ্জের ভরামের হাওরের কৃষক আনিসুর রহমান জানান, এবার তিনি অল্প জমি চাষ করেছেন। গত কয়েক বছর অকাল বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। যে কারণে তার মতো অনেক কৃষকই হতাশ ছিলেন। কিন্তু এবার ফলন বেশ ভালো হয়েছে। কোনো কোনো জমিতে অন্য বছরের তুলনায় দেড়গুণ বেশি ধান হয়েছে।

 

সুনামগঞ্জের কৃষক কৃষ্ণ সাহা জানান, পোকায় কিছু ধান ক্ষতিগ্রস্ত হলেও ফলন ভালো হওয়ায় এতে তেমন কোনো প্রভাব পড়েনি। গত ২৬ এপ্রিল সরকারের তরফ থেকে জানানো হয়েছে, ইতোমধ্যে হাওরের ৭০ শতাংশের বেশি বোরো ধান কাটা হয়েছে। এর মধ্যে সিলেটে ৫৫ শতাংশ, মৌলভীবাজারে ৭০, হবিগঞ্জে ৬৭, সুনামগঞ্জে ৭৩, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৬৭, কিশোরগঞ্জে ৫৮ এবং নেত্রকোনায় ৭৭ শতাংশ ধান কাটা হয়েছে। দেশের এ সাত জেলাকে বলা হয় হাওরাঞ্চল। হাওর অধ্যুষিত এ সাত জেলায় বোরো আবাদ হয়েছে ৪ লাখ ৫২ হাজার হেক্টর জমিতে। আর হাওর ও হাওরের বাইরে উঁচু জমি মিলে মোট ৯ লাখ ৫৩ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে। সেখান থেকে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ৪০ লাখ টন চাল।

 

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের জানায়, এ বছর সারা দেশে ৫০ লাখ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে, আর উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ২ কোটি ১৫ লাখ টন চাল। গত ২০২১-২২ অর্থবছরে বোরো ধান আবাদ হয়েছিল ৪৮ লাখ ১৪ হাজার হেক্টর জমিতে, উৎপাদন হয়েছিল প্রায় ২ কোটি ২ লাখ টন চাল। এবার ধান উৎপাদনে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।

 

কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, চলতি মৌসুমে সুনামগঞ্জ জেলায় ২ লাখ ২২ হাজার ৭৯৫ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের চাষাবাদ হয়েছে। এখন পর্যন্ত ১ লাখ ৭০ হাজার হেক্টরের বেশি জমির ধান কাটা হয়েছে। এ জেলায় উৎপাদিত ধানের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৩ লাখ ৫৩ হাজার টন, যা থেকে ৯ লাখ ২ হাজার টন চাল উৎপাদন হবে। এর বাজার মূল্য ৩ হাজার ৮৮ কোটি টাকা।

 

সুনামগঞ্জ কৃষি কর্মকর্তা বিমল চন্দ্র সোম জানান, সুনামগঞ্জের হাওরের ৯০ শতাংশের বেশি ধান কাটা হয়ে গেছে। বর্তমানে বৃষ্টি আর নদীর পানি বাড়লেও কৃষকের খুব বেশি ক্ষতি হবে না। তবে শতভাগ ধান ঘরে তুলতে আরো কয়েকদিন সময় লাগবে বলে জানান তিনি। একই অবস্থা পুরো হাওরাঞ্চলের।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version