-->
শিরোনাম

দেশব্যাপী বজ্রপাত আতঙ্ক

রুদ্র মিজান
দেশব্যাপী বজ্রপাত আতঙ্ক

রুদ্র মিজান: বৈশাখ মাস। হঠাৎ বদলে যায় দিনের চেহারা। আকাশ অন্ধকার। মুহূর্তেই জড়ো হয় কালো মেঘ। দমকা হাওয়া। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। হাওরে ধান কাটতে গিয়েছিলেন কৃষক। বিপাকে পড়েন তারা। বিকট শব্দে যেন কেঁপে ওঠে পৃথিবী। একের পর এক বজ্রপাত হচ্ছিল। এমন বজ্রপাতেই নিহত হন ৪৫ বছর বয়সি আব্দুস সামাদ। সুনামগঞ্জের ছাতকের চরদুর্লভপুর গ্রামের বাসিন্দা তিনি। একই দিনে প্রায় একই সময়ে সুনামগঞ্জের তিন উপজেলায় বজ্রপাতে নিহত হয়েছেন ছয়জন।

 

বৈরী আবহাওয়া, বজ্রপাত হলেই এরকম মৃত্যু ঘটে হাওরাঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায়।

 

শনিবার বজ্রপাতে মারা গেছেন মো. মোস্তফা (৫০) নামে এক ব্যক্তি। বৃষ্টিতে শুকনা খড় ভিজে যাবে বলে ঘর থেকে দ্রুত বাইরে ছুটে যান মোস্তফা। খড় তুলতে গিয়ে বজ্রপাতে জীবন দিতে হয়েছে তাকে। তিনি নেত্রকোনার পূর্বধলা উপজেলার গোহালাকান্দা ইউনিয়নের হাটবারেঙ্গা গ্রামের বাসিন্দা। এভাবেই প্রতি বছর বাংলাদেশে বজ্রপাতে গড়ে ২৬৫ জনের মৃত্যু ঘটে।

 

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, গত এক যুগে ৩ হাজারের বেশি মানুষ মারা গেছেন। ২০২১ সালে মারা গেছেন ৩৬৩ জন, ২০২০ সালে ২৩৬ জন, ২০১৯ সালে ১৬৮ জন, ২০১৮ সালে ৩৫৯ জন, ২০১৭ সালে ৩০১ জন, ২০১৬ সালে ২০৫ এবং ২০১৫ সালে ১৬০ জন। প্রতি বছর মার্চ থেকে মে মাসের মধ্যে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি।

 

বজ্রপাতে গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালের বিছানায় মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন রাকিব হোসেন। পদ্মায় মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন তিনি। ঢাকার দোহারে তার বাড়ি। শনিবার মাছ ধরতে গিয়েছিলেন। এর মধ্যেই বজ্রপাত হয়। আর এতেই তিনি গুরুতর আহত হন। বজ্রপাতে শরীরের ২৫ শতাংশ পুড়ে গেছে। এ ঘটনায় তাকে প্রথমে দোহার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লক্সে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে বেগতিক দেখে চিকিৎসকরা ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে পাঠিয়ে দেন। এখন তিনি ঢামেক হাসপাতালের আইসিউতে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। হাসপাতালের বিছানায় বারবার জ্ঞান হারাচ্ছেন। জ্ঞান ফিরলেও স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পারছেন না।

 

রাকিবের বাবা বলেন, আমরা গরিব মানুষ। পেটের দায়ে ছেলে মাছ ধতে গিয়েছে। এর মধ্যেই বজ্রপাতে এ অবস্থা হয়। পদ্মায় এর আগের দিনও বজ্রপাত হয়। ওইদিন কেউ আহত হয়নি।

 

বজ্রপাত বেশি হয় হাওরাঞ্চলে। এ বিষয়ে বজ্রপাত সচেতনতায় কাজ করা সংগঠন সেভ দ্য সোসাইটি অ্যান্ড থান্ডারস্টর্ম অ্যাওয়ারনেস ফোরামের (এসএসটিএএফ) সাধারণ সম্পাদক রাশিম মোল্লা বলেন, বজ্রপাত রোধে প্রচুর উঁচু গাছ রোপণ করতে হবে। আর হাওরাঞ্চলে যেহেতু বজ্রপাত বেশি হয়, সেখানে প্রচুর ছাউনির ওপরে বজ্রপাত নিরোধক টাওয়ার নির্মাণ করতে হবে। সারা দেশে মাঠে মাঠে বজ্রনিরোধক টাওয়ার নির্মাণ করা প্রয়োজন।

 

এছাড়া বজ্রপাত নিয়ে মানুষের মধ্যে আরো বেশি সচেতন করতে পাঠ্যপুস্তকে এ বিষয়ে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। রাশিম মোল্লা আরো বলেন, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গবেষণায় দেখা গেছে বাংলাদেশে প্রতি বছর গড়ে ৮৪ লাখ বজ্রপাত হয়, যার ৭০ শতাংশই হয় এপ্রিল থেকে জুনে। বজ্রপাতে মৃত্যুর ঘটনাগুলোর ৭০ শতাংশই ঘটছে কৃষিকাজের সময়। মারা যাওয়া ব্যক্তিদের প্রায় ৭০ শতাংশই কৃষক। মৃত্যুর ঘটনাগুলোর সাড়ে ১৪ শতাংশ হয় বাড়ি ফেরার পথে এবং ১৩ শতাংশ গোসল কিংবা মাছ ধরার সময় জলাশয়ে।

 

বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবের কারণে বজ্রপাতে মৃত্যুর ঘটনা প্রতিনিয়ত বাড়ছে বলে জানান তিনি। এবারো ঝড় বৃষ্টির মৌসুম শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়েছে বজ্রপাত। প্রচন্ড তাপদাহের পর বৃষ্টির সঙ্গে সৃষ্টি হয়েছে বজ্রপাতের আতঙ্ক। বৃষ্টি আর ঝড় হলেই বজ্রপাতে একাধিক মৃত্যুর খবর পাওয়া যাচ্ছে। গত ২৩ এপ্রিল বাংলাদেশের পূর্বঞ্চলের ছয়টি উপজেলায় এক দিনে বজ্রপাতে ৯ জন প্রাণ হারান। এরপর ২৭ এপ্রিল একদিনে ছয় জেলায় আটজন বজ্রপাতের ফলে প্রাণ হারিয়েছেন।

 

বিশ্লেষকদের মতে, শহরে বেশিরভাগ ভবনে বজ্রনিরোধক দন্ড থাকায় বজ্রপাতে মৃত্যু তেমন হয় না। কিন্তু গ্রামে তা না থাকা ও বড় গাছপালা কমে গিয়ে খোলা মাঠের কারণে সেখানে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা বেশি। দেশের হাওর এলাকায় বজ্রপাতে মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি। সেখানকার ফসলি জমিতে বড় কোনো গাছ নেই। গাছ না থাকার কারণে বজ্রপাতে সেখানে মানুষের মৃত্যু ঘটে। বজ্রপাতের ধর্ম হচ্ছে তা মাটিতে আঘাত হানার আগে সবচেয়ে উঁচু যে জায়গাটি পায় সেখানে গিয়ে পড়ে।

 

বৃক্ষহীন হাওর এলাকায় কৃষকের শরীরই মাটির চেয়ে উঁচু থাকে। তাই বজ্রপাতের সময় মাঠে বা খোলা জায়গায় যেখানে উঁচু কোনো গাছ নেই বা বজ্রনিরোধক ব্যবস্থা নেই সেখানে যারা থাকেন তারা শিকার হন।

 

সংগঠন সেভ দ্য সোসাইটি অ্যান্ড থান্ডারস্টর্ম অ্যাওয়ারনেস ফোরামের গবেষণা সেলের প্রধান আব্দুল আলীম জানান, বাংলাদেশে বজ্রপাত প্রতিরোধ ও মানুষের জীবন বাঁচাতে সারা দেশে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১ কোটি তালগাছের চারা রোপণের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিল সরকার। এর মধ্যে সারা দেশে ৩৮ লাখ চারা রোপণের পর দেখা যায়, তা এক বছরের মধ্যেই অযত্ন-অবহেলায় মারা যায়।

 

এ পরিকল্পনা যথার্থ ছিল না বলে মনে করেন আব্দুল আলীম। কারণ তালগাছ রক্ষণাবেক্ষণ ছাড়াও এগুলো বড় হয়ে মানুষের চেয়ে উঁচু হতে ২০-৩০ বছর সময় লেগে যায়। তার মতে, এখন প্রয়োজন হলো, ফাঁকা জায়গাগুলোয় আশ্রয়কেন্দ্র এবং টাওয়ার স্থাপন করা। টাওয়ারের ওপরে লাইটিনিং প্রটেকশন সিস্টেম বসাতে হবে। এর দুটি পদ্ধতি আছে লাইটিনিং অ্যারেস্টর ও এয়ার টার্মিনাল। অল্প সময়ে সহজ পদ্ধতি হলো বজ্রনিরোধক দন্ড। এগুলো বসাতে হবে।

 

দীর্ঘ পরিকল্পনায় তালগাছ, নারিকেল গাছ লাগানো যেতে পারে।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version