-->
শিরোনাম
যাত্রীর প্রতিবেদন

ঈদের পথে এবার দুর্ঘটনা ১৮.২%, মৃত্যু ২১.১% কমেছে

নিজস্ব প্রতিবেদক
ঈদের পথে এবার দুর্ঘটনা ১৮.২%, মৃত্যু ২১.১% কমেছে

যাত্রী কল্যাণ সমিতি বলেছে, যত মানুষ এবার ঈদের পথে যাতায়াত করেছেন, তাদের ১৮.২ শতাংশই ভ্রমণ করেছেন মোটরসাইকেলে। রোজার ঈদের আগে-পরে মিলিয়ে ১৫ দিনে দেশে ৩০৪টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩২৮ জনের মৃত্যু হয়েছে, আহত হয়েছেন ৫৬৫ জন। আর সড়ক, রেল ও নৌপথ মিলিয়ে ৩৪১টি দুর্ঘটনায় ৩৫৫ জন নিহত এবং ৬২০ জন আহত হয়েছেন বলে তথ্য দিয়েছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি।

 

এ সংগঠনের পরিসংখ্যান বলছে, ২০২২ সালের রোজার ঈদের তুলনায় এবার সড়ক দুর্ঘটনা কমেছে ১৮ দশমিক ২ শতাংশ, আর প্রাণহানি ২১ দশমিক ১ শতাংশ এবং আহত ৩৩ শতাংশ কম হয়েছে।

 

সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী মঙ্গলবার ঢাকার সেগুনবাগিচায় বাংলাদেশ শিশুকল্যাণ পরিষদ মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে এবারের ঈদযাত্রায় সড়ক দুর্ঘটনার এই প্রতিবেদন প্রকাশ করেন।

 

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ঈদযাত্রা শুরুর দিন ১৫ এপ্রিল থেকে ঈদ শেষে কর্মস্থলে ফেরার দিন ২৯ এপ্রিল পর্যন্ত ১৫ দিনের দুর্ঘটনার তথ্য এসেছে এ প্রতিবেদনে। বরাবরের মতই সংবাদমাধ্যমে আসা দুর্ঘটনার খবর সঙ্কলিত করে এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। এই সময়ে রেলপথে ২৭টি ঘটনায় ২২ জন নিহত ও ৫৫ জন আহত হয়েছেন। নৌ-পথে ১০টি দুর্ঘটনায় ৫ জন নিহত ও ২২ জন নিখোঁজ রয়েছেন।

 

প্রতিবেদনে দেখা যায়, বরাবরের মত এবারও দুর্ঘটনার শীর্ষে রয়েছে মোটরসাইকেল। এবারের ঈদে ১৬৫টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ১৬৭ জন নিহত, ১২০ জন আহত হয়েছেন। যা মোট সড়ক দুর্ঘটনার ৫৪.৩ শতাংশ, নিহতের ৫১ শতাংশ এবং আহতের প্রায় ২১.৩ শতাংশ । ঈদের সড়কে এবার মোটরসাইকেল চলাচলে কোনো বিধিনিষেধ ছিল না।

 

এমনকি ঈদের আগে আগে পদ্মা সেতুতেও মোটরসাইকেল চলাচলের অনুমতি দেওয়া হয়, যাকে প্রধানমন্ত্রীর ঈদ উপহার হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। ফলে বিপুল সংখ্যক মানুষ এবার মোটরসাইকেলে করে ঢাকা থেকে বাড়ি গেছেন। ২০ এপ্রিল ভোর থেকে ২৫ এপ্রিল রাত পর্যন্ত ছয় দিনে পদ্মা সেত পার হয়েছে ৭৭ হাজার মোটরসাইকেল, তাতে টোল আদায় হয়েছে ৭৭ লাখ টাকা।

 

যাত্রী কল্যাণ সমিতির ধারণা বলছে, যত মানুষ এবার ঈদের পথে যাতায়াত করেছেন, তাদের ১৮.২ শতাংশই ভ্রমণ করেছেন মোটরসাইকেলে। ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার জানিয়েছিলেন,রোজার ঈদে এবার মোট মানুষের সঙ্গে ১ কোটি ২৩ লাখ সিম ঢাকা ছেড়েছিল।

 

তবে যাত্রী কল্যাণ সমিতি বলছে, “দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও পরিবহন ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায়, অতিরিক্ত গরমসহ নানা কারণে” এবার লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৩০ শতাংশ কম মানুষ ঈদে যাতায়াত করেছে। ২২ এপ্রিল ঈদ ঘিরে এবার ২১ থেকে ২৩ এপ্রিল ঈদের ছুটি ছিল। তবে তার আগে ২০ এপ্রিল সরকার নির্বাহী আদেশে বিশেষ ছুটি ঘোষণা করায় ঈদের ছুটি শুরু হয়ে গিয়েছিল কার্যত ১৯ এপ্রিল শবে কদরের ছুটির দিন থেকেই।

 

টানা পাঁচ দিনের ছুটি মিলে যাওয়ায় সড়কে এবার অন্যবারের মত দুঃসহ চাপ পড়েনি। যানজট এবং যাত্রা বিলম্বিত হওয়ার অভিযোগও সেভাবে আসেনি। সে কথা তুলে ধরে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, “বর্তমান সরকারের বিগত ১৪ বছরে ধারাবাহিক উন্নয়নের ফলে দেশের সড়ক মহাসড়কের অবস্থা আগের তুলনায় অনেক ভালো ছিল। ঈদের ছুটি একদিন বাড়ানোর সুফল মিলেছে। “সরকারের বিভিন্ন নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর নজরদারির কারণে এবারের ঈদযাত্রা খানিকটা স্বস্তিদায়ক হয়েছে।

 

এ কারণে ভোগান্তি কমার পাশাপাশি সড়ক দুর্ঘটনা ১৮.২ শতাংশ, প্রাণহানী ২১.১ শতাংশ কমেছে।” সমিতির প্রতিবেদন বলছে, এবার ঈদযাত্রায় সড়কে দুর্ঘটনায় হতাহতদের মধ্যে ৮৮ জন চালক, ১৬ জন পরিবহন শ্রমিক, ৪২ জন পথচারী, ৪৮ জন নারী, ৪০ জন শিশু, ১৭ জন শিক্ষার্থী, ১ জন সাংবাদিক, ৫ জন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, ৪ জন শিক্ষক, ৫ জন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী, ২ জন মুক্তিযোদ্ধা, ৫ জন চিকিৎসক।

 

যেসব বাহন দুর্ঘটনায় পড়েছে, তার ৩৬.৯ শতাংশ মোটরসাইকেল, ১৬.৫ শতাংশ ট্রাক-পিকআপ- কাভার্ডভ্যান, ৫.৬ শতাংশ কার মাইক্রোবাস ও জিপ, ৪.৬ শতাংশ নছিমন-করিমন ট্রাক্টর-লেগুনা মাহিন্দ্রা, ৬.৭ শতাংশ অটোরিকশা, ১২.৮ শতাংশ ব্যাটারিচালিত রিক্সা-ইজিবাইক-ভ্যান-সাইকেল, এবং ১৬.৯ শতাংশ বাস। এসব দুর্ঘটনার ২৬ শতাংশ মুখোমুখি সংঘর্ষ, ৩৭.২ শতাংশ পথচারীকে গাড়ি চাপা দেওয়ার ঘটনা, ২০.৪ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ার ঘটনায়, ১৬.৪ শতাংশ অন্যান্য অজ্ঞাত কারণে দুর্ঘটনা।

 

মোট দুর্ঘটনার ২৯.৬ শতাংশ জাতীয় মহাসড়কে, ৩৭.২ শতাংশ আঞ্চলিক মহাসড়কে, ২৬.৬ শতাংশ ফিডার রোডে হয়েছে। এছাড়া সারাদেশে হওয়া মোট দুর্ঘটনার ৬.৬ শতাংশ ঢাকা মহানগরীতে হয়েছে। মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, “সড়ক দুর্ঘটনার এই চিত্রকে একটি নমুনা রিপোর্ট বলা যায়। প্রকৃতপক্ষে দেশে বর্তমানে মোটরসাইকেল ও ইজিবাইক ক্যান্সারের মত বেড়ে যাওয়ায় দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিচ্ছিন্ন- বিক্ষিপ্তভাবে যে পরিমাণ সড়ক দুর্ঘটনা ও প্রাণহানী ঘটছে তা সংবাদমাধ্যমে আসে না। তাই এসব দুর্ঘটনার হিসাব রাখা সম্ভব হচ্ছে না।”

 

তিনি বলেন, এবারের ঈদে শুধুমাত্র ঈদের দিনে বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানোর সময় দুর্ঘটনায় ২১৬ জন পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। তাদের মধ্যে ৯৬ জনের অবস্থা অত্যন্ত গুরুতর। ঈদের দ্বিতীয় দিন দুপুর ২টা পর্যন্ত ১০৫ জন মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আক্রান্ত হয়ে ওই হাসপাতালে ভর্তি হন। তাদের মধ্যে ৩৫ জনের অবস্থা অত্যন্ত গুরুতর। “কেবল পঙ্গু হাসপাতালে এই দুই দিনে ভর্তি রোগীর সমপরিমাণ সড়ক দুর্ঘটনার খবরও সংবাদপত্রে আসেনি। ফলে এসব দুর্ঘটনার ভয়াবহতার খবর আমরা আপনাদের সামনে তুলে ধরতেও পারিনি," বলেন মোজাম্মেল।

 

তিনি বলেন, “গত ১৪ বছরে ধারাবাহিক উন্নয়নের ফলে সড়ক মহাসড়কের অবস্থা আগের চেয়ে অনেক ভালো। এসব সড়কে মানসম্মত বাসের অভাবে মোটরসাইকেল, অটোরিকশা, ইজিবাইকের মত ছোট পরিবহন অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ার কারণে সড়কে বিশৃঙ্খলার পাশাপাশি পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনা “ তিনি মোটরসাইকেল ও ইজিবাইকের আমদানি বন্ধের পাশাপাশি গণপরিবহনকে বিকশিত করার দাবি জানান।

 

বাংলাদেশে দুর্ঘটনার কারণের বেশ কিছু কারণও চিহ্নিত করেছে যাত্রী কল্যাণ সমিতি।

 

১. দেশের সড়ক মহাসড়কে মোটরসাইকেলের অবাধ চলাচল।

 

২. জাতীয় মহাসড়কে রোড সাইন বা রোড মার্কিং, সড়কবাতি না থাকায় হঠাৎ ঈদে যাতায়াতকারী ব্যক্তিগত যানের চালকদের রাতে এসব জাতীয় সড়কে ঝুঁকি নিয়ে যানবাহন চালানো।

 

৩. জাতীয়, আঞ্চলিক ও ফিডার রোডে টার্নিং চিহ্ন না থাকায় নতুন চালকরা এসব সড়কে দুর্ঘটনায় পড়েন।

 

৪. মহাসড়কের নির্মাণ ত্রুটি যানবাহনের ত্রুটি, ট্রাফিক আইন অমান্য করার প্রবণতা।

 

৫. উল্টোপথে যানবাহন চালানো, সড়কে চাদাঁবাজি, পণ্যবাহী যানে যাত্রী পরিবহন।

 

৬. অদক্ষ চালক, ফিটনেসবিহীন যানবাহন, অতিরিক্ত যাত্রী বহন, বেপরোয়া যানবাহন চালানো।

 

যাত্রী কল্যাণ সমিতির সুপারিশ:

 

১. জরুরি ভিত্তিতে মোটরসাইকেল ও ইজিবাইক আমদানি ও নিবন্ধন বন্ধ করা।

 

২. জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কে রাতের বেলায় অবাধে চলাচলের জন্য আলোকসজ্জার ব্যবস্থা করা।

 

৩. দক্ষ চালক তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ, যানবাহনের ডিজিটাল পদ্ধতিতে ফিটনেস প্রদান ।

 

৪. ধীরগতির যান ও দ্রুতগতির যানের জন্য আলাদা লেনের ব্যবস্থা করা।

 

৫. সড়কে চাদাঁবাজি বন্ধ করা, চালকদের বেতন ও কর্মঘণ্টা নিশ্চিত করা।

 

৬. সড়কে রোড সাইন, রোড মার্কিং স্থাপন করা।

 

৭. সড়ক পরিবহন আইন যথাযতভাবে বাস্তবায়ন করা। ডিজিটাল পদ্ধতিতে ট্রাফিক আইন প্রয়োগ করা।

 

৮. গণপরিবহন বিকশিত করা, নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিআরটিএর সক্ষমতা বৃদ্ধি করা। মানসম্মত সড়ক নির্মাণ ও মেরামত সুনিশ্চিত করা, নিয়মিত রোড সেইফটি অডিট করা।

 

অন্যদের মধ্যে সংগঠনের সহ-সভাপতি তাওহীদুল হক লিটন, যুগ্ম মহাসচিব মনিরুল হক, প্রচার সম্পাদক মাহমুদুল হাসান রাসেল সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version