-->
শিরোনাম

দাম বাড়ানো কেবলই অজুহাত

শাহীন রহমান
দাম বাড়ানো কেবলই অজুহাত

শাহীন রহমান: বিশ্ববাজারে সয়াবিন তেলের দাম এখন নিম্নমুখী। গত চার মাস ধরে বিশ্ববাজারে সয়াবিন তেলের দাম কমছেই। স্বভাবতই প্রশ্ন জেগেছে আন্তর্জাতিক বাজারে কমলেও দেশের বাজারের দাম কেন বাড়ানো হলো। শুল্ক সুবিধা প্রত্যাহারই কি এর প্রধান কারণ? নাকি ব্যবসায়ীদের অতি মুনাফার লোভ?

 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অতিরিক্ত মুনাফার লোভেই ভোক্তাদের ফাঁদে ফেলে বাড়ানো হয়েছে তেলের দাম। সরকারকে চাপে ফেলেই তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ব্যবসায়ীরা অতি মুনাফা করতে ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। ইতোমধ্যে বাড়তি তেলের দামের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে বাজারে।

 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দাম বাড়ার পাঁয়তারা শুরুর পরই বাজারে তেলের কৃত্রিম সংকট তৈরি করা হয়। ব্যবসায়ীরা নিজেরা আলোচনা করে গত বুধবার দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলেও বিষয়টি গোপন রাখা হয়। এ ফাঁকে বাজারে তেলে সংকট শুরু হয়। বৃহস্পতিবার থেকে তেলের দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেয়া হয়েছে।

 

শুক্রবার বাজার ঘুরে নতুন দামে তেল বিক্রি করতে দেখা গেছে। তেলের দাম বাড়ার কারণে ক্রেতারাও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। তারা বলছেন, বাজারে সব দ্রব্যের দামই ঊর্ধ্বমুখী। দীর্ঘদিন ধরেই তেলে দাম বাড়তি। এরপর নতুন করে দাম বাড়ানোর এ সিদ্ধান্ত একেবারের অযৌক্তিক।

 

মিরপুর বাজারে দুলাল মাহমুদ নামে এক ক্রেতা বলেন, দ্রব্যমূল্য এখন সাধারণ মানুষের জন্য আতঙ্কের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সব পণ্যের দাম বাড়তি। কমার কোনো লক্ষণ নেই। আন্তর্জাতিক বাজারের কথা বলে দাম বাড়িয়ে চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে সাধারণ মানুষের ঘাড়ে। এভাবে ফাঁদে ফেলে ক্রমাগত দাম বাড়ানো হলে আমরা কোথাও যাব। কার কাছে প্রতিকার পাব। সরকার তো মানুষের কথা ভাবছে না। শুধু ব্যবসায়ীদের স্বার্থের কথা ভেবে তাদের দাবির কাছেই নতি স্বীকার করছে।

 

জানা গেছে, বিশ্ববাজারে সয়াবিন তেলের দাম আগের চেয়ে নিম্নমুখী। বিশ্বব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, বিশ্ববাজারে প্রতিটন সয়াবিনের দাম এখন ১ হাজার ৩০ ডলার। গত মার্চেও এ দাম ছিল ১ হাজার ১৩০ ডলার। তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, প্রতি ডলার ১০৫ টাকা হিসাবে প্রতি লিটার সয়াবিনের ক্রয়মূল্য পড়ে ১০৮ টাকা ১৫ পয়সা। এর সঙ্গে ১৫ শতাংশ ভ্যাট যোগ করলে সয়াবিনের আমদানিমূল্য পড়ে ১২৩ টাকার কিছু বেশি।

 

এর সঙ্গে উৎপাদন ভ্যাট, বিক্রয় ভ্যাট যোগ করলে এ দাম আরো একটু বেশি পড়বে। অথচ দাম বাড়িয়ে প্রতি লিটার সয়াবিনের খুচরা মূল্য রাখা হচ্ছে ১৯৯ টাকা। সয়াবিনের এ মূল্য আমদানি ব্যয়ের সঙ্গে বাজারমূল্যের ফারাক অনেক বেশি। বিশেজ্ঞরা বলছেন, অতি মুনাফার কারণে সাধারণ জনগণকে জিম্মি করতেই সয়াবিনের এ দাম বাড়ানো হয়েছে। শুল্ক সুবিধা প্রত্যাহারে কথা বলে তেলে দাম বাড়ানো হলেও মানুষের কথা একবারও ভাবেনি সরকার।

 

ভোজ্যতেল আমদানিতে সাধারণত ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট দেয়ার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু সরকার এতদিন ৫ শতাংশ ভ্যাট কার্যকর রেখে ১০ শতাংশ প্রত্যাহার করে নেয়ায় এর আগে প্রতি লিটার সয়াবিনের দাম ছিল ১৮৭ টাকা। শুল্ক সুবিধা প্রত্যাহারের কারণে এখন লিটারপ্রতি ১২ টাকা বাড়িয়ে ১৯৯ টাকা করা হয়েছে, যা অন্যায় হিসেবে দেখছেন সাধারণ ভোক্তারা।

 

তারা বলছেন, এ অন্যায়ের প্রতিকার করার কোনো জয়গা নেই। মুখ বুজে সহ্য করা ছাড়া কোনো উপায় নেই।

 

ব্যবসায়ী ও সরকারি তথ্যানুযায়ী, সরকারের পক্ষ থেকে সয়াবিন তেলের সর্বশেষ দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল গত ১৫ ডিসেম্বর। ওই সময় বোতলজাত প্রতি লিটার সয়াবিন তেলের দাম কমিয়ে ১৮৭ টাকা নির্ধারণ করা হয়। বাজারে সয়াবিন তেলের প্রতি লিটারের দাম প্রথমবারের মতো সর্বোচ্চ ২০৫ টাকায় উঠেছিল গত বছর জুনে। এরপর কয়েক দফায় দাম সমন্বয়ের ফলে এ দাম কমে অক্টোবরে ১৭৮ টাকায় নামলেও এখন আবার তা ১৯৯ টাকায় উঠেছে।

 

এদিকে বাজারের চিনির পরিণতিও তেলের মতোই জানা গেছে। প্রতি কেজি খোলা চিনি ১৪০ টাকায় বিক্রি হলে বাজারের প্যাকেটজাত চিনির সংকট রয়েছে। এর আগে সরকার চিনির দাম নির্ধারণ করে দিলেও সেই দামে বিক্রি হতে দেখা যায়নি। এ অবস্থার মধ্যে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করেই চিনির দাম বাড়ানো হয়েছে। ব্যবসায়ীদের এ কারসাজির রোধ করতে সরকারের কঠোর কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যাচ্ছে না।

 

সরেজমিন কয়েকটি বাজারে দেখা গেছে, বাজারে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে তেল ও চিনির দাম। খুচরা বাজারে কোথাও মিলছে না প্যাকেটজাত চিনি। খোলা চিনি কিনতে হলে খুঁজতে হচ্ছে দু-চার দোকান। কয়েকদিনের ব্যবধানে দাম আরো বেড়ে এখন বিক্রি হচ্ছে ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকা কেজিপ্রতি, যা গত সপ্তাহে ১২০-১২৫ টাকার মধ্যে ছিল।

 

অনেক ব্যবসায়ী অভিযোগ করেছেন, তারা ঈদের পর থেকে কোনো চিনির সরবরাহ পাননি। কোম্পানিগুলোর প্রতিনিধিরা অন্য পণ্যের অর্ডার নিলেও চিনি নেই বলে সাফ জানিয়ে দিচ্ছে।

 

শুধু তেল আর চিনি নয়। বাজারে এখন বাড়তির দিকে পেঁয়াজের দাম। অথচ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, এবারের দেশে পেয়াজের বাম্পার ফলন হয়েছে। তাদের হিসাব মতো দেশে পেঁয়াজের চাহিদা বছরের ৩০ লাখ টন। অথচ চাহিদার চেয়ে এবার বেশি হয়েছে পেঁয়াজের উৎপাদন। দেশে বাম্পার উৎপাদন হওয়ায় ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ রয়েছে। আর এ সুযোগে বাড়ানো হচ্ছে পেঁয়াজের দাম। ফলে কৃষক সুফল পাচ্ছেন না। এদিকে দেশের বোরো ধানের বাম্পার ফলন হওয়ায় মোটা ও চিকন সব ধরনের চালের দাম কিছুটা কমলেও খুচরা পর্যায়ে এর সুফল নেই।

 

জানা গেছে, পাইকারি বাজারে চালের দাম কেজিতে ৫ থেকে ৬ টাকা কমলেও খুচরা বাজারে কমেছে মাত্র ২ থেকে ৩ টাকা। এদিকে প্রতিদিন ভোগাচ্ছে সবজির মূল্য। ৫০ টাকার নিচে কোনো সবজি রাজধানীর বাজারে পাওয়া যায় না। এতদিন পেঁপের দামে স্বস্তি থাকলেও সম্প্রতি দাম বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। কেজিপ্রতি পেঁপে বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকায়, যা কয়দিন আগের ২৫ থেকে ৩০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে।

 

বাজারে ঈদের মধ্যে বেড়ে যাওয়া ব্রয়লার মুরগির দাম কমেনি। বিক্রি হচ্ছে ২৪০ থেকে ২৫০ টাকা কেজি দরে। সোনালি মুরগির কেজি ৩৪০ থেকে ৩৫০ টাকা। এর সঙ্গে গত দুদিন ধরে বাড়ছে ডিমের দাম। ১০ টাকা বেড়ে প্রতি ডজন ফার্মের ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৪০ টাকায়।

 

এদিকে ঈদের পর আলুর দাম উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়েছে। সারা বছরই স্থিতিশীল থাকলেও মৌসুমের শুরুতে আলুর অস্থিতিশীল বাজারকে অস্বাভাবিক মনে করছেন ক্রেতারা। দফায় দফায় দাম বেড়ে খুচরা বাজারে আলুর কেজি বিক্রি হচ্ছে ৩০ থেকে ৪০ টাকা, যা ঈদের আগে ২০ থেকে ২৫ টাকার মধ্যে ছিল। আর গত বছরের এ সময় আলুর দাম ছিল ১৬ থেকে ২০ টাকা।

 

মিরপুর বাজারের আলু বিক্রেতারা জানান, এ বছর দেশে আলুর বাম্পার ফলন হয়েছে। অথচ হঠাৎ করে সবজি জাতীয় পণ্যটির দাম বেড়ে গেছে। এটা ব্যবসায়ীদের কারসাজি, যা দেখার কেউ নেই। বাজার ঘুরে দেখা গেছে, করলা প্রতি কেজি ৮০-১০০ টাকা, ঢ্যাঁড়শ ৬০-৭০ টাকা, পটোল ৫০-৮০ টাকা, বেগুন ৬০-৮০ টাকা, বরবটি ৮০-১০০ টাকা, কাঁকরোল ৬০-৮০ টাকা, চিচিঙ্গা ৬০-৮০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।

 

এদিকে ঈদের আগে ৭৫০ টাকা প্রতি কেজি গরুর মাংস বিক্রি হলেও হঠাৎ বেড়ে এখন ৮০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ঈদের সময় এ দাম বাড়লে এখানো সেই দামে বিক্রি করতে দেখা গেছে। বিক্রেতারা বলছেন, গরুর দাম বেশি, সব ধরনের খরচও বেশি। তাই ৮০০ টাকায় বিক্রি না করলে লোকসান হয়ে যায়।

 

অন্যদিকে ক্রেতাদের অভিযোগ, ঈদের অজুহাতে গরুর মাংসের দাম বাড়ানোর পর এখনো বাড়তি দামেই কিনতে হচ্ছে। অন্যদিকে প্রতি কেজি খাসির মাংস বিক্রি হচ্ছে ১১০০ টাকায়। মাছের দামও বাড়তি যাচ্ছে বাজারে।

 

বাজার ঘুরে দেখা গেছে, প্রতি কেজি চাষের কই বিক্রি হচ্ছে ৩০০ টাকায়, শিং মাছ আকার ভেদে প্রতি কেজি ৪৫০ থেকে ৫৫০ টাকা, পাঙ্গাস মাছ প্রতি কেজি ২২০ টাকা, রুই মাছ প্রতি কেজি ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা, তেলাপিয়া প্রতি কেজি ২২০ থেকে ২৫০ টাকা, চিংড়ি আকারভেদে ৬৫০ থেকে ৭০০ টাকা, পাবদা মাছ আকারভেদে প্রতি কেজি ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা, বড় টেংরা প্রতি কেজি ৭০০ টাকা, শোল মাছ আকারভেদে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা, কাতল মাছ প্রতি কেজি ৩২০ থেকে ৩৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version