শাহীন রহমান: গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আজমত উল্লা খান। মনোনয়নপত্র জমার শুরুতেই ক্ষমতাসীন দলের এই প্রার্থীর বিরুদ্ধে নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গের অভিযোগ ওঠে। নির্বাচন কমিশন থেকে এর ব্যাখ্যা দিতে তাকে নোটিশ দিয়ে তলব করা হয়েছে। জবাব দেয়ার সময়সীমা দেয়া হয়েছে আজ রোববার। সশরীরে হাজির হয়েই তাকে ব্যাখা দিতে হবে। অথচ ইসির এই প্রথম নোটিশ উপেক্ষা করেই দ্বিতীয় দফায় তার বিরুদ্ধে আচরণবিধি ভঙ্গের অভিযোগ উঠেছে।
আজমত উল্লা খানের বারবার এমন আচরণে নির্বাচন কমিশন উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তার বিরুদ্ধে কৈফিয়ৎ তলবে গত বৃহস্পতিবার ইসি জরুরি সভা করেছে। সভায় তার বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া যায় সেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে বলে জানা গেছে। আলোচনা শেষে ওই দিনই তাকে আরো এক দফায় কারণ দর্শানো নোটিশ দেয়া হয়। এর আগে গত ৩০ এপ্রিল আচরণবিধি ভঙ্গের অভিযোগে প্রথমবার নোটিশ দেয়া হয়। উভয় নোটিশে কেন তার প্রার্থিতা বাতিল করা হবে না সে বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে হবে। উভয় নোটিশের জবাবের জন্য আজ রোববার দিন ধার্য করা হয়েছে। আজমত উল্লাকে নির্বাচন কমিশনে উপস্থিত হয়েই ব্যাখ্যা প্রদান করতে হবে।
কর্মকর্তারা জানান, ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীর এমন আচরণে ইসি বেশ ক্ষুব্ধ। এ কারণে গত বৃহস্পতিবার ছুটির দিনে জরুরি বৈঠকে বসেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল। এতে অংশ নেন নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আহসান হাবিব খান (অব.), বেগম রাশেদা সুলতানা, মো. আলমগীর, মো. আনিছুর রহমান, ইসি সচিব মো. জাহাংগীর আলম, অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ। তারা প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন।
বৈঠক শেষে সিইসি এবং অন্য কমিশনাররা তার বিরুদ্ধে প্রার্থিতা বাতিলের হুঁশিয়ারি দেন। এছাড়া শেষবারের মতো হুঁশিয়ারি দিয়ে সতর্ক করা হয়। এছাড়াও গাজীপুরের স্থানীয় সংসদ সদস্য ও প্রতিমন্ত্রীকে শেষবারের মতো সতর্ক করা হয়। প্রতীক বরাদ্দের আগেই প্রার্থীর নির্বাচনী প্রচারে অংশগ্রহণ করায় এ ব্যবস্থা নেয়ায় এ সিদ্ধান্তের কথা জানান ইসির অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ।
ওই দিন উভয়কেই হুঁশিয়ারি চিঠি দেয়া হয়। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, গত ২৭ এপ্রিল মনোনয়নপত্র দাখিলের সময় মেয়র প্রার্থী আজমত উল্লা খানকে নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের জন্য ৩০ এপ্রিল ব্যাখ্যা তলব করা হয়। তা সত্ত্বেও যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী মো. জাহিদ আহসান রাসেল সভা করে আজমত উল্লার পক্ষে ভোট চেয়েছেন। ওই সভায় আজমত উল্লাও উপস্থিত ছিলেন। এটি গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে। এই কার্যক্রম সিটি করপোরেশন (নির্বাচন আচরণ) বিধিমালা, ২০১৬-এর বিধি ৫-এর পরিপন্থি। আচরণ বিধিমালার বিধি ৫ লঙ্ঘনের জন্য বিধি ৩২ অনুযায়ী প্রার্থিতা বাতিলের বিধান রয়েছে।
এতে আরো উল্লেখ করা হয় আজমত উল্লা খানকে ইতোপূর্বে সতর্ক করা সত্ত্বেও প্রতীক বরাদ্দের আগে নির্বাচনী প্রচার চালানোর ফলে আচরণবিধিমালার ৫ বিধি ভঙ্গের দায়ে কেন তার প্রার্থিতা বাতিল করা হবে না, সে বিষয়ে নির্বাচন কমিশনে ব্যক্তিগতভাবে উপস্থিত হয়ে ৭ মে বিকেল ৩টায় ব্যাখ্যা দেয়ার জন্য সভায় সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন। একই সঙ্গে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন উপলক্ষে সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হওয়া সত্ত্বেও প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান সভা করে আজমত উল্লার উপস্থিতিতে তার পক্ষে ভোট চেয়ে সিটি করপোরেশন (নির্বাচন আচরণ) বিধিমালা, ২০১৬ লঙ্ঘন করেছেন। এ জন্য প্রতিমন্ত্রীকে সতর্ক করে তার একান্ত সচিবকে ইসির পক্ষে চিঠি দেয়া হয়েছে।
গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে আগামী ২৫ মে। গত ২৭ এপ্রিল ছিল প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র জমার শেষ দিন। ওই দিন সরকারি দলের মেয়র পদের প্রার্থী আজমত উল্লা রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে নিজের মনোনয়নপত্র দাখিল করেন। মনোনয়নপত্র জমা দিতে গিয়ে ‘মহড়া’ বা প্রার্থীর সঙ্গে পাঁচজনের বেশি লোক না রাখার নির্দেশনা থাকলেও আজমত উল্লাকে দলবলসহ রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে দেখা যায়। মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার আগেই হাজার হাজার নেতাকর্মী সেখানে ভিড় জমান। দলীয় কার্যালয়ের সামনে মিছিল নিয়ে উপস্থিত হন নেতাকর্মীরা। পরে সেখানে সংক্ষিপ্ত আলোচনা ও মোনাজাত হয়। এরপর কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে শহরের রথখোলা এলাকায় বঙ্গতাজ মিলনায়তনে স্থাপিত নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে যান আজমত উল্লা। যাওয়ার পথে কর্মীরা স্লোগান দিতে থাকেন। এসব কারণে নৌকার প্রার্থীর বিরুদ্ধে নির্বাচনী আচরণ বিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ ওঠে।
এই ঘটনার পর নির্বাচন কমিশনার আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, ‘ইসির পক্ষ থেকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে আজমত উল্লাকে। তার কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হবে এবং কমিশনে এসে বিষয়টি ব্যাখ্যা করার জন্য বলা হবে। এর পরেই ব্যাখ্যা জানতে ইসির পক্ষ থেকে তাকে নোটিশ দেয়া হয়। তার বিরুদ্ধে দেয়া উভয় নোটিশের জবাব দিতে হবে আজ। এখন দেখার বিষয় বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বারবার আচরণবিধি ভঙ্গে আজমত উল্লার বিরুদ্ধে কী ধরনের শাস্তিমুলক ব্যবস্থা নেয়া হয়।
এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর বলেন, কিছু না কিছু শাস্তি তো হবেই। কী শাস্তি হবে তা নির্ভর করবে অপরাধের গুরুত্ব বিবেচনায়। তিরস্কার, জেল-জরিমানা এবং প্রার্থিতা বাতিলের বিধানও আছে আইনে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইন থাকলেও তা প্রয়োগে ইসির ব্যর্থতার নজির রয়েছে। স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ বলেন, কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন ছাড়াও জাতীয় সংসদের গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচনে ব্যাপক অনিয়মের জন্য ১৪৫ জনকে দায়ী করেও তাদের শাস্তি নিশ্চিত করতে পারেনি। অথচ ইসির এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে যথেষ্ট ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। সতর্ক করা ছাড়া এখন পর্যন্ত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি তাদের।
ভোরের আকাশ/আসা
মন্তব্য