-->
শিরোনাম

’৯১-এর প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের ছায়া ‘মোখা’য়

নিজস্ব প্রতিবেদক
’৯১-এর প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের ছায়া ‘মোখা’য়

সাগরে সৃষ্ট লঘুচাপ আজকের মধ্যে ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিচ্ছে। তবে আসন্ন এই ঘূর্ণিঝড়ের গতি-প্রকৃতি নিয়ে আগেই বিশ্লেষণ শুরু হয়েছে।

 

ধরন বিশ্লেষণ করে বিশেষজ্ঞরা অনুমান করছেন, মোখা ’৯১ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের শক্তি নিতে পারে। এটি দেশের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূল বিশেষ করে ভোলা থেকে কক্সবাজারের মধ্যবর্তী অঞ্চল দিয়ে অতিক্রম করবে। ব্যাপক শক্তি নিয়েই স্থলভাবে আছড়ে পড়তে পারে।

 

আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বঙ্গোপসাগরে এখন যে শক্তি নিয়ে লঘুচাপটি অবস্থান করছে, সেই শক্তি নিয়েই এটা যদি অগ্রসর হয় তাহলে সেটা নব্বইয়ের দশকের ঘূর্ণিঝড়ের মতোই প্রবল হবে।

 

তারা জানান, ’৯১ সালে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়টি ২২৫ কিলোমিটার শক্তি নিয়ে স্থলভাগে আঘাত হানে। ‘মোখা’তেও ওই ঘূর্ণিঝড়ের ছায়া দেখা যাচ্ছে। তারা বলছেন, গত কয়েক বছর ধরে যে কয়েকটি ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয়েছে, তার মধ্যে এই ঘূর্ণিঝড়টি সবচেয়ে বেশি তাপমাত্রার পানির মধ্যে।

 

এখন বঙ্গোপসাগরের সমুদ্রের পানির তাপমাত্রার যে মানচিত্র দেখা যাচ্ছে তাতে বোঝা যাচ্ছে, যত উত্তর দিকে ঘূর্ণিঝড়টি অগ্রসর হবে, তত বেশি এটি উত্তপ্ত পানির সংস্পর্শে আসবে ।

 

এবার মে মাসের শুরুতেই শুরু হয়েছে ঘূর্ণিঝড় মোখা নিয়ে আলোচনা। ইতোমধ্যে গতি-প্রকৃতি বিশ্লেষণ করে ভারতে উপক‚লীয় রাজ্যে আগেই সতর্কতা জারি করা হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে এ বিষয়ে কোনো সতর্কতা জারি করা হয়নি।

 

আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, আজ ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেয়ার পরই সতর্কতা দেয়া হবে।

 

তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগেই সতর্কতা জারি করা না হলে এখন যেসব জেলেরা গভীর সমুদ্রে মাছ ধরার জন্য বের হচ্ছেন বা ইতোমধ্যে যারা চলে গেছেন তারা ফেরার সময় পাবেন না। ফলে ঝড় আঘাত হানলে তারা বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়তে পারেন।

 

আবহাওয়াবিদ আব্দুল মান্নান বলেন, দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট লঘুচাপটি সুস্পষ্ট লঘুচাপে রূপ নিয়েছে। এটি নিম্নচাপ ও গভীর নিম্নচাপ হয়ে আজ যেকোনো সময় ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেবে। ঘূর্ণিঝড়টি মোখা নাম নিয়ে স্থলভাগের দিকে অগ্রসর হবে।

 

তিনি জানান, বর্তমানে এটি উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমে অবস্থান করলেও এটি কিছুটা ডানে সরে এসে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্বদিকে অগ্রসর হবে। ফলে এটি দেশে দক্ষিণ-পূর্ব উপকূল ও মিয়ানমারের ওপর আঘাত হানার আশঙ্কাই বেশি।

 

তবে তিনি উল্লেখ করেন, আজ ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেয়ার পর ঘূর্ণিঝড় সম্পর্কে বিস্তারিত বলা সম্ভব হবে।

 

তবে আবহাওয়াবিদদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আজ ঘূর্ণিঝড় মোখায় রূপ নেয়ার পর তা ক্রমশ উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম দিক বরাবর এগিয়ে যাবে।

 

আগামীকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত উত্তর-পশ্চিমেই থাকতে পারে ঘূর্ণিঝড়ের অভিমুখ। বৃহস্পতিবারের পর থেকে দিক পরিবর্তন করবে ঘূর্ণিঝড়টি। আচমকাই উল্টোদিকে বাঁক নিতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। এই বাঁক নেয়ার ফলে বৃহস্পতিবারের পর মোখা ধীরে ধীরে উত্তর ও উত্তর-পূর্ব দিকে ঘুরে যাবে। ক্রমশ তা দেশের ভোলা ও কক্সবাজারের মধ্যবর্তী অঞ্চল দিয়ে স্থলভাগের উঠে আসবে।

 

তবে যদি এটি আরো উত্তর-পূর্বদিকে সরে যায়, তাহলে তা মিয়ানমার উপকূলে আঘাত হানতে পারে বলে তারা জানান।

 

আবহাওয়াবিদরা জানান, ঘূর্ণিঝড় মোখার প্রভাবে ইতোমধ্যে দেশে গরমের অনুভূতি বাড়ছে। এই গরম বৃহস্পতিবার পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে।

 

তারা জানায়, বঙ্গোপসাগরে তৈরি হওয়া লঘুচাপের কারণে দখিনাবাতাস প্রবেশের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে। এর পরিবর্তে প্রবেশ করছে উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে আসা শুষ্ক গরম বাতাস। এর কারণেই তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়ে গরমের অনুভূতি বাড়াচ্ছে।

 

আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, আগামীকাল বৃহস্পতিবার পূর্ণাঙ্গ ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে মোখার।

 

এর গতি-প্রকৃতি বিশ্লেষণ করে আবহাওয়াবিদরা বলছেন, ঘূর্ণিঝড়টি প্রাথমিকভাবে ১১ মে উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম দিকে অগ্রসর হবে এরপর ধীরে ধীরে দিক পরিবর্তন করে উত্তর-উত্তর-পূর্বদিকে বাংলাদেশ-মিয়ানমার উপকূলের দিকে অগ্রসর হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

 

এছাড়া বিভিন্ন মডেলও নির্দেশ করছে যে, ঘূর্ণিঝড়টি ১২ মে উত্তর-পূর্ব দিকে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার উপকূল দিয়ে অগ্রসর হওয়ার আশঙ্কা বেশি।

 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন ১২ মে এটি সর্বোচ্চ শক্তিতে থাকবে। আমেরিকান মডেল অনুযায়ী ১৩ তারিখের দিন শেষে বা ১৪ মে ঘূর্ণিঝড়টি আঘাত হানার সম্ভাবনা রয়েছে।

 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন শক্তি ধরে রাখার জন্য যে তিনটি প্রধান শর্ত প্রয়োজন তার তিনটিই আছে এবারের ঘূর্ণিঝড়ে। সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা ২৭ ডিগ্রির ওপরে এবং সমুদ্রে সঞ্চিত শক্তি যথেষ্ট পরিমাণে আছে, ফলে ঘূর্ণিঝড়টি আকারে বড় হবে বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

 

তারা বলছেন, সম্ভাব্য ঘূর্ণিঝড়টি উপকূলে আঘাত করার সময় এটি অত্যন্ত তীব্র ঘূর্ণিঝড় কিংবা তীব্র ঘূর্ণিঝড় হিসেবে উপকূল অতিক্রম করতে পারে। সম্ভাব্য ঘূর্ণিঝড়টি সমুদ্রে থাকা অবস্থায় বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ওঠার আশঙ্কা রয়েছে ১৬০ থেকে ১৯০ কিলোমিটার।

 

এবং উপকূলে আঘাত হানার সময় বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ওঠার আশঙ্কা রয়েছে ১৩০ থেকে ১৭০ কিলোমিটার। তারা বলছেন চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, ভোলা ও নোয়াখালী এই চারটি জেলার ওপর দিয়ে বয়ে যেতে পারে ঘূর্ণিঝড়টি।

 

১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়টি হওয়ার আগে সাগর ও আবহাওয়ার যে পরিস্থিতি ছিল, এ বছরেও সেরকম পরিস্থিতি মডেলে দেখা যাচ্ছে বলে উল্লেখ করেন আবহাওয়া বিশেষজ্ঞ মোস্তফা কামাল পলাশ।

 

আমেরিকার নৌবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত জয়েন্ট টাইফুন ওয়ার্নিং সেন্টার থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে মোস্তফা কামাল পলাশ জানাচ্ছেন, এখন যে স্থানে লঘুচাপটি অবস্থান করছে, সেখানকার পানির তাপমাত্রা এখন ৩১ থেকে ৩২ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড।

 

১৯৯১ সালের ২৯-৩০ এপ্রিলের ঘূর্ণিঝড়কে আখ্যা দেয়া হয় ‘শতাব্দীর প্রচন্ড তম ঘূর্ণিঝড়’ হিসেবে, যাতে ১ লাখ ৩৮ হাজার মানুষ মারা যায় বলে জানা যায়। যদিও বেসরকারি সংগঠনের দাবি অনেক মাছ ধরার ট্রলার সাগরে ডুবে গিয়ে নিখোঁজ হয়েছিলেন অনেকে।

 

এছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত হয় এক কোটি মানুষ। ১২-২২ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছাসের প্রবল ঘূর্ণিঝড়টিতে বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ২২৫ কিলোমিটার।

 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বঙ্গোপসাগরে এখন যে শক্তি নিয়ে লঘুচাপটি অবস্থান করছে সেই শক্তি নিয়েই এটা যদি অগ্রসর হয়, তাহলে সেটা নব্বইয়ের দশকের ঘূর্ণিঝড়ের মতোই প্রবল হবে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version