-->
শিরোনাম

ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’ আতঙ্কে উপকূলবাসী

নিজস্ব প্রতিবেদক
ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’ আতঙ্কে উপকূলবাসী

ঘূর্ণিঝড় মোখা উপকূলে ধেয়ে আসায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন উপকূলের বাসিন্দারা। এদিকে দুর্যোগপূর্ণ এলাকা থেকে লোকজনকে নিরাপদে সরিয়ে নিতে প্রস্তুতি শুরু করেছে জেলা প্রশাসন। কক্সবাজার উপকূলে মোখার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। শুরু হয়েছে হালকা থেকে মাঝারি মাত্রার বৃষ্টিপাত। ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছে মোংলা কোস্ট গার্ড পশ্চিম জোন। শুক্রবার সকাল থেকে উপকূলের ১৪ স্টেশন থেকে সতর্কীকরণ মাইকিং করা হচ্ছে।

 

এরদিকে সেন্ট মার্টিনে বড় জলোচ্ছ্বাসের আশংকা দেখা দিয়েছে। মানুষজন চরম আতঙ্কে আছেন। ফলে দলে দলে মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ে ছুটছে। দ্বীপ অনেকে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য কাঠের ট্রলার ও দ্রুতগতির স্পিডবোটে চড়ে ৩৪ কিলোমিটার দূরে টেকনাফ সদরে আশ্রয় নিচ্ছেন। শুক্রবার বেলা তিনটা পর্যন্ত পাঁচ শতাধিক মানুষ সেন্ট মার্টিন দ্বীপ ছেড়েছেন বলে জানা গেছে। তাঁদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু।

 

এদিকে উপকূলের বাসিন্দারা বলছেন, ঝড়ে তারা নিজেদের রক্ষা করলেও বসত ঘর, ফসলি জমি, গবাদি পশু ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে তারা কিছুতেই ঘুরে দাঁড়াতে পারছেন না। উপকুলের স্থানীয় জানিয়েছেন ঝড় এলেই তাদের ক্ষতির মুখে পড়তে হয়। বিশেষ করে জলোচ্ছ্বাসে আক্রান্ত হন তারা। আসন্ন ঘূর্ণিঝড় মোখা সম্পর্কে জানলেও রয়েছেন ভয়ের মধ্যে। উপকূল জুড়ে বিরাজ করছে আতঙ্ক-উৎকণ্ঠা। এমন পরিস্থিতিতে তাদের দাবি উঁচু বাঁধের। উপকূলের বাসিন্দা সিরাজ উদ্দিন, ি বলেন, একটি ঘূর্ণিঝড় আসবে সেটা জেনেছি, আমাদের ভীষণ ভয় হচ্ছে। ঝড়ের সময় মানুষ আশ্রয় কেন্দ্রে গেলেও, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ঘরবাড়ি। জলোচ্ছ্বাসের কারণে এবারও আমরা ক্ষতির মুখে পড়তে পারি। আমরা চাই বাঁধগুলো যেন আরও উঁচু হয়।

 

এদিকে মোখার ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনতে উপকূল ও নদীতে সচেতনতামূলক প্রচারণা করছে রেড ক্রিসেন্ট ও কোস্ট গার্ড। এ বিষয়ে রেড ক্রিসেন্ট ভোলা ইউনিটের সাধারণ সম্পাদক আজিজুল ইসলাম বলেন, প্রাথমিকভাবে আমরা মানুষকে ঝড়টির বিষয়ে সচেতন করছি। সতর্কতা সংকেত বাড়ানো হলে পরবর্তী পদক্ষেপ নেবো। ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনতে সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন ভোলার জেলা প্রশাসক মো. তৌফিক ই-লাহী চৌধূরী। তিনি বলেন, তিন ধাপে আমরা প্রস্তুতি নিয়েছি। ৭৪৬টি আশ্রয়কেন্দ্র এবং ১৩ হাজার ৬০০ ভলান্টিয়ার প্রস্তুত রাখা হয়েছে। খোলা হয়েছে ৮টি কন্ট্রোল রুম। ক্ষতি কমিয়ে আনতে আমরা সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিয়েছি।

 

এদিকে ঘূর্ণিঝড় মোখা মোকাবিলায় সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছে মোংলা কোস্ট গার্ড পশ্চিম জোন। শুক্রবার সকাল থেকে উপকূলের ১৪ স্টেশন থেকে সতর্কীকরণ মাইকিং করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে বঙ্গোগসাগর, সুন্দরবনের নদ-নদী ও মোংলা বন্দরের পশুর চ্যানেলে চলাচলরত দেশি-বিদেশি বাণিজ্যিক জাহাজের নাবিক, জেলে-মাঝিমাল্লাদের নিরাপদে সরে যেতে বলা হচ্ছে। ঘূর্ণিঝড় শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোস্টগার্ডের এ প্রচারণা চলবে। কোস্টগার্ড পশ্চিম জোনের (মোংলা) অপারেশনাল অফিসার লে. কমান্ডার তারেক আহমেদ বলেন, সুন্দরবন উপকূলে সতর্কীকরণ ও সচেতনতামূলক প্রচারণা চালানো হচ্ছে। ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী উদ্ধার তৎপরতার জন্য কোস্টগার্ডের হাই স্পিডবোট ও জাহাজ প্রস্তুত রাখা হয়েছে।

 

কক্সবাজারে মোখার প্রভাব শুরু : এদিকে ঘূর্ণিঝড় মোখার প্রভাব কক্সবাজার দৃশ্যমান হওয়া শুরু করেছে। আকাশ কালো মেঘে ঢাকা রয়েছে। এরপর গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিপাত অব্যাহত রয়েছে। তবে এখনও বাতাসের তীব্রতা লক্ষ্য করা যায়নি। কক্সবাজার আবহাওয়া অফিসের সহকারি আবহাওয়াবিদ আবদুর রহমান জানিয়েছেন, মোখার প্রভাবে মাঝারি মানের এই বৃষ্টিপাত, তা থেমে থেমে আবারও হতে পারে। মোখার কারণে সাগর স্বাভাবিক পরিস্থিতির চেয়ে একটু উত্তাল রয়েছে বলে জানিয়েছেন, সৈকতের নিরাপত্তায় নিয়োজিত সী সেফ লাইফ গার্ড সংস্থার সিনিয়র লাইফ গার্ড কর্মী মোহাম্মদ শুক্কুর। তিনি বলেন, পর্যটকদের সতর্ক করতে লাল পতাকা টাঙানো হয়েছে। আর পর্যটকদের হাঁটু পানির নিচে নামতে দেওয়া হচ্ছে না। প্রশাসনের নির্দেশনা মতে ৪ নম্বর সংকেত হলে সৈকতের পানিতে নামা বন্ধ করা হবে।

 

সেন্টমার্টিন থেকে নিরাপদ আশ্রয়ে ছুটছে মানুষজন : এদিকে আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে ঘূর্ণিঝড় মোখা রবিবার দুপুর নাগাদ যখন বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে আঘাত করবে, তখন সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ার কথা বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বে বঙ্গোপসাগরের ওপর অবস্থিত সেন্ট মার্টিন দ্বীপে। ঘূর্ণিঝড়টি উপকূলীয় অঞ্চলের কাছে দিয়ে যাওয়ার সময় ৫ থেকে ৭ ফুট উঁচু ঢেউ আঘাত করতে পারে। আর এই ভয়ে সে ন্টমার্টিন থেকে দলে দলে লোকজন নিরাপদ আশ্রয়ে ছুটছে। সেন্ট মার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ফিরোজ আহমদ খান বলেন, ঘূর্ণিঝড় আতঙ্কে দ্বীপের লোকজন টেকনাফে যাওয়া শুরু করেছে। শুক্রবার বেলা তিনটা নাগাদ পাঁচ শতাধিক মানুষ কয়েকটি কাঠের ট্রলার ও স্পিডবোটে করে টেকনাফে গেছেন। আরও কিছু লোক টেকনাফ যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তাঁদের ধারণা, ঘূর্ণিঝড় মোখার আঘাতে সেন্ট মার্টিন দ্বীপ লন্ডভন্ড হতে পারে।

 

সেন্ট মার্টিন–টেকনাফ সার্ভিস ট্রলার মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, শুক্রবার বেলা ১১টার দিকে দুটি কাঠের ট্রলার ও কয়েকটি স্পিডবোটে করে আড়াই শতাধিক মানুষ সেন্ট মার্টিন ছেড়ে টেকনাফের উদ্দেশে রওনা দিয়েছেন। এরপর আরও মানুষ সেন্ট মার্টিন ছেড়েছেন কি না, তাঁর জানা নেই। স্থানীয় লোকজন জানান, আজ শুক্রবার দুপুরে জুমার নামাজে দ্বীপের একাধিক মসজিদে ঘূর্ণিঝড় মোখা থেকে জানমাল রক্ষার জন্য বিশেষ মোনাজাত করেন মুসল্লিরা। এরপর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যরা বিভিন্ন ওয়ার্ডে প্রচারণা শুরু করেন। সেন্ট মার্টিন বাজারের প্রচারণায় অংশ নেন ইউপি চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান।

 

প্রচারণায় বলা হচ্ছে, ঘূর্ণিঝড় মোখা এখন ১ হাজার কিলোমিটার দূরে অবস্থান করছে। কাছাকাছি অবস্থানে চলে এলে লোকজনকে আশ্রয়কেন্দ্রে চলে আসার জন্য মাইকিং করে জানানো হবে। তখন দ্রুত ঘর ছেড়ে লোকজনকে আশ্রয়শিবিরে যেতে হবে। তখন প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, শুকনা খাবারও সঙ্গে রাখতে হবে। টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. কামরুজ্জামান বলেন, ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় সেন্ট মার্টিন দ্বীপে তিনটি সাইক্লোন শেল্টারসহ ৩৭টি হোটেল প্রস্তুত রাখা হয়েছে। তাতে সাত হাজারের বেশি মানুষ আশ্রয় নিতে পারবেন। মানুষজনকে সচেতন করতে এলাকায় মাইকিং করা হচ্ছে। পরিস্থিতি অনুযায়ী মানুষকে সাইক্লোন শেল্টারে আনা হবে। সেখানে পর্যাপ্ত পরিমাণে শুকনা খাবার মজুত রাখা হয়েছে।

 

ঝুকিতে রোহিঙ্গা ক্যাম্প : এ দিকে ঝুর্ণিঝড় মোখার কারণে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলার ৩৩টি শিবিরে ১২ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা ঝুকিতে রে য়ছে। ঘূর্ণিঝড় মোখা আঘাত হানলে টেকনাফের পাশাপাশি রোহিঙ্গা শিবিরে ক্ষয়ক্ষতি বেশির আশঙ্কা করা হচ্ছে। সেই লক্ষ্যে রোহিঙ্গা শিবিরের নিকটবর্তী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেওয়ার জন্য জেলা প্রশাসনকে অনুরোধ জানিয়েছে শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয়।

 

কক্সবাজার অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. সামছু দ্দৌজা নয়ন জানান, সম্ভাব্য দুর্যোগ মোকাবিলায় সমন্বিতভাবে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা, আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচিসহ রোহিঙ্গা শিবিরে কর্মরত আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো সে লক্ষ্যে কাজ করছে। ঘুর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির স্বেচ্ছ্বাসেবক, রেডক্রিসেন্টসহ অন্যান্য স্বেচ্ছ্বাসেবকরা প্রস্তুত রয়েছে।

 

তিনি জানান, পরিস্থিতি বিবেচনায় সেনাবাহিনী, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন, পুলিশ সেখানে সমন্বিতভাবে কাজ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। প্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছে ফায়ার সার্ভিসের ইউনিটগুলোকে। এছাড়াও স্বাস্থ্য বিভাগের জরুরি মেডিকেল টিম ও মোবাইল মেডিকেল টিম প্রস্তুত রয়েছে। সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হলে তাৎক্ষণিক কাজ করবে ‘সাইট ম্যানেজমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপ’। ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হলে জরুরিভাবে সরবরাহের জন্য ত্রিপল, বাঁশ, সুতলি দেওয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে বলে জানান তিনি। ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী ভূমিধস কিংবা বন্যা দেখা দিলে সেখান থেকে রোহিঙ্গাদের সরিয়ে নেওয়ারও প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।

 

ভোরের আকাশ/আসা

মন্তব্য

Beta version