ঘূর্ণিঝড় মোখা সাড়ে চারশ কিলোমিটারজুড়ে তাণ্ডব চালাতে পারে। কেননা, এটির ব্যাস সাড়ে চারশ কিলোমিটার। এক্ষেত্রে মিয়ানমার উপকূলেই প্রথম আঘাত হানতে পারে। ভারত ও বাংলাদেশের আবহাওয়াবিদরা এমন তথ্য জানিয়েছেন।
আবহাওয়াবিদ মো. বজলুর রশিদ জানিয়েছেন, প্রবল ঘূর্ণিঝড়টির ব্যাস সাড়ে চারশ কিলোমিটার। অর্থাৎ এর কেন্দ্রের চারপাশে দুইশ কিলোমিটারের বেশি এলাকাজুড়ে প্রবল ঝড়-বৃষ্টি হবে। মিয়ানমারের অংশে ঝড়-জলোচ্ছ্বাস বেশি হবে। দেশটির রাখাইন রাজ্যেই ক্ষতি হবে বেশি।
তিনি বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের ডান পাশে টর্নেডো হয় এবং জলোচ্ছ্বাস অধিক উচ্চতার হয়ে থাকে। কক্সবাজার উপকূলেও প্রভাব থাকবে। তবে সেন্টমার্টিন বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। বড় জোয়ারের সঙ্গে জলোচ্ছ্বাস মিলিত হলে সেন্টমার্টিন দ্বীপ কিছু সময়ের জন্য পানির নিচে চলে যেতে পারে। তবে সেটা স্থায়ী নয়। সেন্টমার্টিনে আঘাত হানার আগে মিয়ানমারের স্থলভাগে আঘাত হানতে পারে।
ভারতের আবহাওয়া বিজ্ঞানী ড. আনন্দ কুমার দাশ জানিয়েছেন, কক্সবাজার ও মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের কিয়াকপিউ বন্দরের মাঝ দিয়ে স্থলভাগে উঠে আসবে মোখা। এক্ষেত্রে এটি সিত্তে বন্দর এলাকা দিয়ে আঘাত হানবে। ফলে ওই বন্দর ও আশপাশের এলাকা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। আন্তর্জাতিক দুর্যোগ সতর্কতা বিষয়ক সংস্থা গ্লোবাল ডিজাস্টার অ্যালার্ট অ্যান্ড কো-অর্ডিনেশন সিস্টেম (জিডিএসিএস) জানিয়েছে, ঘূর্ণিঝড়ে মিয়ানমারের প্রায় ৩০ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এদের মধ্যে দুই লাখ মানুষ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এছাড়া বাংলাদেশের ১০ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী হুমকির মুখে রয়েছে। তিন মিটার উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে হতে পারে মোখার প্রভাবে।
ঝড়টি শনিবার সকালে গতির সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছিল, সে সময় গতিবেগ উঠে যাচ্ছিল ২২০ কিলোমিটার। তবে সেটি এখন কমতে শুরু করেছে। রাতের মধ্যে এটি ২০০ কিলোমিটারের নিচে নেমে আসবে বলে জানিয়েছে উত্তর ভারত সাগরে সৃষ্টি হওয়া ঘূর্ণিঝড় পর্যবেক্ষণ সংস্থা আঞ্চলিক বিশেষায়িত আবহাওয়া বিষয়ক কেন্দ্র (আরএসএমসি)। সংস্থাটির বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, রোববার দুপুরে উপকূলে আছড়ে পড়বে। সে সময় এর গতিবেগ থাকবে ১৭৫ কিলোমিটার। এক্ষেত্রে কয়েক ঘণ্টা ধরে তাণ্ডব চালিয়ে স্থলভাগে উঠে আসবে ঝড়টি। এক্ষেত্রে সোমবার (১৫ মে) শক্তিক্ষয় করে গভীর নিম্নচাপে পরিণত হতে পারে।
এদিকে মোখার ভয়াবহতা মোকাবিলায় কক্সবাজারে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত তোলা হয়েছে। এর মানে হচ্ছে বন্দর প্রচণ্ড বা সর্বোচ্চ তীব্রতার ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ এক সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড়ের কবলে নিপতিত। ঝড়ে বাতাসের সর্বোচ্চ একটানা গতিবেগ ঘণ্টায় ৮৯ কিলোমিটার বা তার ঊর্ধ্বে হতে পারে। ঝড়টি বন্দরের ওপর বা কাছ দিয়ে উপকূল অতিক্রম করবে। এছাড়া চট্টগ্রাম ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে আট নম্বর মহাবিপদ সংকেত এবং মোংলা সমুদ্রবন্দররে চার নম্বর স্থানীয় হুঁশিয়ারি সংকেত তোলা হয়েছে । আট নম্বর সংকেতের মানে হলো বন্দর প্রচণ্ড বা সর্বোচ্চ তীব্রতার ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়তে পারে। ঝড়ে বাতাসের সর্বোচ্চ একটানা গতিবেগ ঘণ্টায় ৮৯ কিমি. বা তার ঊর্ধ্বে হতে পারে। ঝড়টি বন্দরকে বাম দিকে রেখে উপকূল অতিক্রম করবে। এর চার নম্বর সংকেতের মানে হলো বন্দর ঘূর্ণিঝড়কবলিত। বাতাসের সম্ভাব্য গতিবেগ ঘণ্টায় ৫১-৬১ কিমি. তবে ঘূর্ণিঝড়ের চূড়ান্ত প্রস্তুতি নেয়ার মতো তেমন বিপজ্জনক সময় এখনো আসেনি। এদিকে উপকূলীয় জেলা কক্সবাজার এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরগুলো দশ নম্বর মহাবিপদ সংকেতের আওতায় থাকবে।
উপকূলীয় জেলা চট্টগ্রাম, ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরগুলো আট নম্বর মহাবিপদ সংকেতের আওতায় থাকবে। আবহাওয়াবিদ বজলুর রশিদ জানিয়েছেন, ঘূর্ণিঝড়টির অগ্রবর্তী অংশ ও বায়ুচাপ পার্থক্যের আধিক্যের প্রভাবে উপকূলীয় জেলা কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরগুলোর নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৮-১২ ফুট অধিক উচ্চতার বায়ুতাড়িত জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে।
উপকূলীয় জেলা ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরগুলোর নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৫-৭ ফুট অধিক উচ্চতার বায়ুতাড়িত জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে। অন্যদিকে চট্টগ্রাম, সিলেট ও বরিশাল বিভাগে ভারী (৪৪-৮৮ মিমি) থেকে অতি ভারী (২৮৯ মিমি) বর্ষণ হতে পারে। অতি ভারী বর্ষণের প্রভাবে কক্সবাজার, বান্দরবান, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলের কোথাও কোথাও ভূমিধস হতে পারে। এ অবস্থায় উত্তর বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত সব মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে বলা হয়েছে।ঘূর্ণিঝড় মোখা নামটি ইয়েমেনের দেয়া। কফির জন্য বিখ্যাত স্থানীয় একটি বন্দরের নাম মোখা। কালক্রমে সেখানকার কফির নামকরণও করা হয়েছে মোখা। ইংরেজিতে শব্দটি Mocha লেখা হলেও এর উচ্চারণ হচ্ছে Mokha।
বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার ঘূর্ণিঝড় সংক্রান্ত আঞ্চলিক সংস্থা এসকাপ আরব সাগর ও বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হওয়ার ঘূর্ণিঝড়গুলোর নাম ঠিক করে। এক্ষেত্রে এসকাপ সদস্যভুক্ত ১৩টি দেশের দেয়া নামের তালিকা থেকে পর্যায়ক্রমে এক একটি ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ করা হয়। বর্তমানে যে তালিকা রয়েছে, সেখানে ১৬৯টি ঘূর্ণিঝড়ের নাম দেয়া আছে। এর মধ্যে মোখা নামটি ১৩ নম্বর। অর্থাৎ ওই তালিকা থেকে পরবর্তী ১৫৬ ঝড়ের নাম ঠিক করা হবে।
মন্তব্য