-->
শিরোনাম
বিদ্যুৎ পানি সংকট

ঘূর্ণিঝড় মোখার প্রভাব সেন্টমার্টিন যেন এক বিরানভূমি

নিজস্ব প্রতিবেদক
ঘূর্ণিঝড় মোখার প্রভাব সেন্টমার্টিন যেন এক বিরানভূমি

ঘূর্ণিঝড় মোখা চলে গেছে। তবে দেশের টেকনাফ উপকূল ও সেন্টমার্টিনে রেখে গেছে মারাত্মক ক্ষত, যা সারতে সময় লাগবে অনেক। যদিও মোখা চলে যাওয়ার পর টেকনাফ ও সেন্টমার্টিন বাসিন্দরা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। তবে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানি সংকটের মতো মারাত্মক সমস্যা এখন প্রকট আকার ধারণ করেছে।

 

মোখার সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে সেন্টমার্টিন দ্বীপে। এরপর এই তালিকায় রয়েছে টেনাফের দক্ষিণে অবস্থিত শাহপরীর দ্বীপ। ঘূর্ণিঝড় চলে যাওয়ার পর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ক্ষয়ক্ষতির একটি পরিসংখ্যান দেয়া হয়েছে।

 

সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, এবারের ঝড়ে প্রাণহানি না হলেও কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলা ও প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিনের ১২ হাজার ঘরবাড়ির ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে এই দুটি এলাকায় দুই হাজার বাড়িঘর সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে। আংশিক ক্ষতি হয়েছে ১০ হাজার ঘরবাড়ির। তবে প্রচুর গাছপালা ভেঙে পড়েছে। আহত হয়েছেন ১০ থেকে ১২ জন।

 

ঘূর্ণিঝড় চলে গেছে আজ তিন দিন হলো। আক্রান্ত এলাকায় ঘূর্ণিঝড় মোখার আঘাতে খুঁটি ভেঙে বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে পড়ায় তিন দিন ধরে বিদ্যুৎহীন টেকনাফ উপজেলার শাহ পরীর দ্বীপ। দেখা দিয়েছে খাবার পানির তীব্র সংকট। অন্যদিকে সেন্টমার্টিনে ঝুপড়িঘরগুলো মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। আধাপাকা ঘর ভেঙে পড়েছে।

 

কোনো কোনো ভবনের টিনের ছাউনি উড়ে গেছে, নারকেলগাছগুলোর মাথা ভাঙা। ঝড়ে এখন সেন্টমার্টিন পরিণত হয়েছে অচেনা এক দ্বীপে।

 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মোখায় কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সাবরাং ইউনিয়নের শাহপরীর দ্বীপের জেলেপল্লিগুলো। এখানকার ৯৫ ভাগ ঘরবাড়িই বিধ্বস্ত হয়েছে। পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। এক-দুই কিলোমিটার দূর থেকে পানি এনে কোনোরকমে তৃষ্ণা মেটাচ্ছেন জেলেপাড়ার ৫০০ পরিবার।

 

শাহপরীর দ্বীপ ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আবদুস সালাম বলেন, ঘূর্ণিঝড়ে এই ওয়ার্ডের জেলেপল্লিগুলো একেবারে লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। জালিয়া পাড়া, ক্যাম্প পাড়া, বেড়িবাঁধের পূর্ব-পশ্চিম পাশে বেড়ার তৈরি ৪০০টি ও টিনশেডের ২০০টি ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দোকানপাট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৫০টির মতো। অনেক দোকানের মালামাল নষ্ট হয়েছে। তবে ঘূর্ণিঝড়ের পর সবচেয়ে বেশি সংকট দেখা দিয়েছে খাবার পানির। পুরো জেলেপল্লিতে বিদ্যুৎ না থাকায় এই সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে।

 

স্থানীয়রা জানিয়েছেন, এলাকায় পানি লবণাক্ত হওয়ায় আগে থেকেই সংকট চলছিল। এখানে ডিপটিউবওয়েলের সংখ্যাও কম। তারপরও পাইপ দিয়ে দুই-তিন কিলোমিটার দূর থেকে পানি আনত জালিয়াপাড়ার মানুষ। ঘূর্ণিঝড় মোখার কারণে এখন বিদ্যুৎ নেই। তাই ডিপটিউবওয়েলে পানি তুলতে পারছে না, আবার পাইপের মাধ্যমেও আনতে পারছে না। ফলে পানি আনতে এক-দুই কিলোমিটার দূরে যেতে হয়।

 

সাবরাং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নূর হোসেন বলেন, ঘূর্ণিঝড় মোখার আঘাতে আমার ইউনিয়নে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শাহপরীর দ্বীপে। তার মধ্যে জালিয়াপাড়া জেলেপল্লিগুলো খুব ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

 

তিনি বলেন, আগে থেকে জালিয়াপাড়া বেড়িবাঁধ এলাকায় পানির সংকট ছিল। ঘূর্ণিঝড়ের পর এই সংকট আরো বেড়েছে।

 

এদিকে মোখার আঘাতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত জনপদ সেন্টমার্টিন। দ্বীপের বাসিন্দারা জানান, আগে কখনো তারা সেন্টমার্টিনে এমন ঝড় কখনো দেখেননি। দ্বীপে দরিদ্র মানুষের ঘরবাড়ি টিকে নেই। দ্বীপটিতে ১১ হাজারের মতো মানুষের বাস। এদের আয় মূলত পর্যটককেন্দ্রিক।

 

কিন্তু ঝড়ের আগেই দ্বীপে নৌযান চলাচল বন্ধ ঘোষণা করা হয়। ঝড় চলে যাওয়ার পরও সেখানে স্বাভাবিক নৌচলাচল শুরু হয়নি। নারিকেল জিনজিরা নামে খ্যাত দ্বীপটির নারকেলগাছগুলো মোখার আঘাতে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রাতে মাথা গোঁজার ব্যবস্থা নেই অনেকের। ঘরের টিনের চালা উড়ে গেছে।

 

সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান বলেন, দ্বীপে ১ হাজার ৯০০টির মতো ঘরবাড়ি আছে। ৭০০টির মতো ঘরবাড়ি প্রায় পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়েছে। এসব কাঁচা অথবা ঝুপড়ি টিন, চাটাই অথবা ত্রিপল দিয়ে তৈরি। আরো ৩০০টির মতো ঘর আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দোকানপাট, হোটেল, রিসোর্টও ক্ষতির মুখে পড়েছে। অনেক গাছপালা ভেঙেছে।

 

সেন্টমার্টিনের বিদ্যুতর অন্যতম উৎস হলো সৌরবিদ্যুৎ ও জেনারেটর। এখন সৌরবিদ্যুতের আলো পাওয়া যাচ্ছে না। জেনারেটর চালানোর মতো জ্বালানি তেল নেই। সুপেয় পানির সংকটও দেখা দিয়েছে।

 

স্থানীয়রা জানান, দ্বীপের বিভিন্ন জায়গায় খাওয়ার পানির সংকট আগেই ছিল। এখন সেটা আরো বেড়েছে। টিউবওয়েলের পানি লবণাক্ত। ঝড়ের পরে লবণাক্ততা আরো বেড়েছে।

 

দ্বীপের ক্ষতিগ্রস্তের এই তালিকায় রয়েছে রেস্তোরাঁ ও রিসোর্ট, বিদ্যালয়, মাদরাসা ও মসজিদ। কবে নাগাদ শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা যাবে, তা নিশ্চিত নন। দ্বীপে মানুষের জীবিকার অন্যতম উৎস মাছ ধরা। ঝড়ের কারণে এখনো তাও বন্ধ রয়েছে।

 

কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. শাহীন ইমরান বলেন, যেসব বাড়ি পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়েছে, সেগুলোর তালিকা করা হচ্ছে। পুনর্বাসনের কাজ শুরু হচ্ছে। যাদের ঘরবাড়ি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাদের নগদ অর্থসহায়তা দেয়া হবে। জেলা প্রশাসন ও কোস্টগার্ডের পক্ষ থেকে কিছু ত্রাণসামগ্রীও বিতরণ করা হয়েছে।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version