-->

নিত্যপণ্যের তুলনায় বাড়েনি তামাকপণ্যের দাম

আরিফ সাওন
নিত্যপণ্যের তুলনায় বাড়েনি তামাকপণ্যের দাম

আরিফ সাওন: নিত্যপণ্যের দাম যতটা বেড়েছে, সেই তুলনায় জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর তামাকপণ্যের দাম খুব একটা বাড়েনি। এক বছরে তামাকপণ্যের দাম বেড়েছে মাত্র ২ শতাংশ। সেখানে কোনো কোনো নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে ৭০ শতাংশের বেশি।

 

তামাকবিরোধী গবেষণা ও অ্যাডভোকেসি প্রতিষ্ঠান প্রজ্ঞার তথ্যানুযায়ী, এ এক বছরে খোলা আটার দাম বেড়েছে ৭১.৭, ব্রয়লার মুরগির ৫২.৯, চিনির ৪৩.৯, ডিমের ২২.৩, গুঁড়া দুধের ২১.২, মসুর ডালের ১৪.৫ এবং মোটা চালের দাম বেড়েছে ৯.৯ শতাংশ।

 

কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ২০২২ সালের ৭ মার্চ থেকে ২০২৩ সালে ৭ মার্চ পর্যন্ত আট বিভাগের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের গড় খুচরা মূল্য বিশ্লেষণ করে এ তথ্য প্রকাশ করেছে প্রজ্ঞা।

 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তামাকজনিত কারণে বছরে ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। সেই হিসাবে দিনে গড়ে ৪৫০ জনের মৃত্যু হয়। তাছাড়া তামাকজনিত রোগের কারণে বছরে ব্যয় হয় ৩০ হাজার কোটি টাকা। তাই তামাকের ব্যবহার কমাতে দাম বাড়ানোর বিকল্প নেই।

 

তারা বলছেন, দাম বাড়লে ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেলে, তামাকের ব্যবহার কমে আসবে।

 

বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এ সময়ে তামাকপণ্যের মধ্যে উচ্চস্তরের সিগারের দাম বেড়েছে ৮.৮ শতাংশ, প্রিমিয়াম স্তরের সিগারেটের ৫.২, মধ্যম স্তরের সিগারেটের ৩.২ ও নিম্নস্তরের সিগারেটের দাম ২.৬ শতাংশ। দাম বাড়েনি বিড়ি, জর্দা ও গুলের।

 

প্রজ্ঞার তামাক নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক প্রকল্প প্রধান হাসান শাহরিয়ার বলেন, সিগারেট বাজারের ৭৫ শতাংশ দখলে থাকা নিম্ন স্তরের সিগারেটের দাম চলতি বাজেটে বাড়ানো হয়েছে মাত্র ২.৫৬ শতাংশ। বহুল ব্যবহৃত জর্দা, গুল ও বিড়ির দাম অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। ফলে নিত্যপণ্যের তুলনায় তামাকপণ্য আরো সস্তা হয়েছে। অর্থাৎ তামাকপণ্যের প্রকৃতমূল্য হ্রাস পাওয়ায় তরুণ ও নিম্নআয়ের মানুষ এসব পণ্য ব্যবহারে উৎসাহিত হবে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ।

 

তিনি বলেন, গবেষণায় দেখা গেছে, তামাকের ওপর কার্যকরভাবে করারোপ করলে তামাকের ব্যবহার হ্রাস পায় এবং রাজস্ব আয়ও বৃদ্ধি পায়। ফিলিপাইন, তুরস্ক, মেক্সিকো ও সাউথ আফ্রিকা এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

 

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্রাটেজিক স্টাডিজের (বিআইআইএসএস) রিসার্চ ডিরেক্টর ড. মাহফুজ কবীর বলেন, ফিলিপাইনে ২০১২ সালে সিন ট্যাক্স রিফর্ম অ্যাক্ট পাস করে সিগারেটের ওপর সুনির্দিষ্ট কর আরোপ এবং মূল্য স্তরের সংখ্যা ২০১৩ সালে ৪টি থেকে ২টি এবং ২০১৭ সালে একক করকাঠামো প্রচলন করা হয়।

 

এ আইনে প্রথম বছরে (২০১৩) সিগারেটের গড় মূল্যবৃদ্ধি করা হয় ৪৪ শতাংশ এবং বহুল প্রচলিত নিম্নস্তরের সিগারেটের খুচরা মূল্যের এক্সাইজ অংশ ১৫.৮ শতাংশ থেকে বাড়ানো হয় ৪৫ শতাংশ পর্যন্ত এবং ২০১৭ সালে সিগারেটের গড় মূল্য ২০১২ সালের তুলনায় বৃদ্ধি করা হয় ৭৮ শতাংশ। ফিলিপাইন সরকারের এ পদক্ষেপের ফলে ২০১২ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে দেশটিতে সিগারেট বিক্রি ২৮.১ শতাংশ হ্রাস পায় এবং রাজস্ব বৃদ্ধি পায় তিনগুণেরও বেশি।

 

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ২০০৯ থেকে ২০১৫ সাল সময়ের মধ্যে ফিলিপাইনে ধূমপানের হার ২৮.৩ শতাংশ থেকে হ্রাস পেয়ে ২২.৭ শতাংশে নেমে আসে।

 

প্রজ্ঞার নির্বাহী পরিচালক এবিএম জুবায়ের বলেন, বাংলাদেশে বর্তমানে তামাক ব্যবহারকারীদের মধ্যে ৫০ শতাংশের বেশি মানুষ ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহার করেন। বাস্তবতা হলো মোট তামাক রাজস্বের মাত্র ০.১৫ শতাংশ (২০২০-২১ অর্থবছর) আসে ধোঁয়াবিহীন তামাক থেকে। ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্য থেকে সরকারের বাড়তি রাজস্ব আয়ের ব্যাপক সুযোগ রয়েছে।

 

দাম বাড়লে যেহেতু ব্যবহার কমে, সেজন্য তামাকপণ্যের দামবৃদ্ধির প্রস্তাব দিয়েছে তামাকবিরোধী সংগঠনগুলো। প্রজ্ঞার মিডিয়া ম্যানেজার অব টোব্যাকো কন্ট্রোল প্রোগ্রাম মো. মেহেদি হাসান বলেন, নিম্নস্তরে প্রতি ১০ শলাকা সিগারেটের খুচরা মূল্য ৪০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫৫ টাকা নির্ধারণ করে ৩৫.৭৫ টাকা অর্থাৎ ৬৫ শতাংশ সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্কারোপের প্রস্তাব করা হয়েছে।

 

তিনি জানান, মধ্যম স্তরে ১০ শলাকা সিগারেটের খুচরা মূল্য ৬৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৭০ টাকা নির্ধারণ করে ৪৫.৫০ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্কারোপ, উচ্চস্তরে ১০ শলাকা সিগারেটের খুচরা মূল্য ১১১ টাকা থেকে ১২০ টাকা নির্ধারণ করে ৭৮.০০ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্কারোপ এবং প্রিমিয়াম স্তরে প্রতি ১০ শলাকা সিগারেটের খুচরা মূল্য ১৪২ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৫০ টাকা নির্ধারণ করে ৯৭.৫০ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্কারোপের প্রস্তাব করা হয়েছে।

 

একইসঙ্গে বিড়ি, গুল এবং জর্দার দাম বাড়িয়ে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ক্রয়ক্ষমতার বাইরে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।

 

তামাকবিরোধী সংগঠনগুলো বলছে, এ বাজেট প্রস্তাব বাস্তবায়ন করা হলে সরকারের ৯ হাজার ৬০০ কোটি টাকা অতিরিক্ত রাজস্ব আয় অর্জিত হবে এবং ৪ লাখ ৮৮ হাজার প্রাপ্তবয়স্ক এবং ৪ লাখ ৯২ হাজার তরুণ জনগোষ্ঠীর অকাল মৃত্যু রোধ করা সম্ভব হবে।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version