-->
শিরোনাম

বঙ্গোপসাগরে মে মাসে কেন এত ঘূর্ণিঝড়

শাহীন রহমান
বঙ্গোপসাগরে মে মাসে কেন এত ঘূর্ণিঝড়

শাহীন রহমান: বিশ্বের যেসব দেশে প্রাকৃতিক বিপর্যয় বেশি হয়, তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। প্রতি বছর এপ্রিল-মে এবং অক্টোবর-নভেম্বরে দেশের ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানছে।

 

তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এভূখন্ডে যত ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে তার বেশিরভাগই হয়েছে মে মাসে। এরপরই রয়েছে অক্টোবর-নভেম্বর। প্রশ্ন হচ্ছে, মে মাসে দেশের উপকূলে এত বেশি ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে কেন?

 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড়ের দুটি মৌসুম রয়েছে। একটি বর্ষার আগে অর্থাৎ এপ্রিলের শেষ থেকে মে মাসে এবং আরেকটি বর্ষার পড়ে অক্টোবর-নভেম্বর মাসে। সে সময় দেশে উপকূলে ঘূর্ণিঝড়ের আশঙ্কা বেড়ে যায় অনেকগুণ।

 

আবহাওয়া অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক সমরেন্দ্র সরকার বলেছেন, এ দুটি সময়ে সাগরের উপরিভাগের তাপমাত্রা অনেক বেশি থাকে। বায়ুমন্ডলের বিন্যাস এ সময়ে ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির উপযোগী থাকে। গোলার্ধ পরিবর্তনের নিয়মের কারণে মে মাসে সূর্যের অবস্থান থাকে বঙ্গোপসাগরের ওপর। ফলে বঙ্গোপসাগর অতি উত্তপ্ত হয়ে যায়।

 

জোর্তিবিজ্ঞানীদের মতে, বছরে একবার করে সূর্যের উত্তরায়ন ও দক্ষিণায়ন ঘটে। অর্থাৎ সূর্য যখন দক্ষিণ গোলার্ধে অবস্থান করে, তখন দক্ষিণ গোলার্ধ চরম উষ্ণ হয়ে ওঠে। বিপরীতভাবে তখন উত্তর গোলার্ধে শীত নামে। বিপরীতে সূর্য যখন উত্তর গোলার্ধে অবস্থান করে, তখন উত্তর গোলার্ধ উষ্ণ হয়ে পড়ে। তখন দক্ষিণ গোলার্ধে বিপরীত অবস্থান তৈরি হয়।

 

কিন্তু এ উত্তর ও দক্ষিণ গোলার্ধে সূর্যের যাত্রাকালে (এপ্রিল-মে এবং অক্টোবর-নবেম্বর মাস) সাগরের ওপর খাড়াভাবে কিরণ পড়ে। তখন সাগরের উপরিভাগ গরম হয়ে ওঠে।

 

আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাগরের স্বাভাবিক তাপমাত্রা ২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তাপমাত্রা এর বেশি হলে ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির আশঙ্কা অনেক বেড়ে যায়। এ কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠে যে পানিটা আছে, সেটা সুপ্ত তাপ নিয়ে বায়ুমন্ডলে প্রবেশ করে। এটা বায়ুমন্ডলে যত প্রবেশ করবে ঘূর্ণিঝড়, তত শক্তিশালী হয় এবং এ কারণে এ সময়ে ঘূর্ণিঝড় বেশি শক্তিশালী হয়।

 

বিশেষজ্ঞরা বলেন, তাপমাত্রা বেড়ে গেলে সমুদ্রের কোনো স্থানে সাগরে বাতাসের চাপ কমে যায়। ফলে সেখানে লঘুচাপ তৈরি হয়। এ প্রবণতা আরো বেড়ে গেলে একসময় নিম্নচাপ বা ঘূর্ণিঝড়ের সৃষ্টি হয়।

 

তারা জানান, সমুদ্রপৃষ্ঠের পানির তাপমাত্রা ২৬.৫ বা ২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি থাকলে ঘূর্ণিঝড়ের পরিবেশ তৈরি হয়। যদি কোনো নিম্নচাপ ঘণ্টায় ৬২ কিলোমিটার গতিবেগ অর্জন করে, তখন সেটাকে আঞ্চলিক ঝড় বলে মনে করা হয়। কিন্তু সেটি যদি ঘণ্টায় ১১৯ কিলোমিটার (৭৪ মাইল) গতিবেগ অর্জন করে, তখন সেটাকে সাইক্লোন বা ঘূর্ণিঝড় বলা হয়। যাত্রাপথ কম হলে ঝড়ের শক্তি বাড়ে, কিন্তু যাত্রাপথ দীর্ঘ হলে এর শক্তি কিছুটা ক্ষয় হতে পারে।

 

এছাড়া সমুদ্রের উপরিভাগের তাপমাত্রা ঝড়ের শক্তিসঞ্চয়ের অনুক‚ল না হলে স্থলভাগে পৌঁছানোর আগেই ঝড়ের গতি কমে যেতে পারে।

 

‘৭০ সালের অত্যন্ত তীব্র ভোলা ঘূর্ণিঝড় ছিল একটি শক্তিশালী ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড় যা ১৯৭০ সালের ১৩ নভেম্বর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) দক্ষিণাঞ্চলে আঘাত হানে। এ পর্যন্ত রেকর্ডকৃত ঘূর্ণিঝড়গুলোর মধ্যে এটি সবচেয়ে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় এবং এটি সর্বকালের সবচেয়ে ভয়ংকরতম প্রাকৃতিক দুর্যোগের একটি।

 

এছাড়া ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল প্রলয়ংকরী ঝড়ে ১ লাখ ৪০ হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটে। এছাড়া ২০০৭ সালে ৭ নভেম্বর আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় সিডর। এবারের মোখার গতি প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্যও ছিল একই রকম। শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়ে তালিকায় মোখা নাম নিয়েছে। যদিও এর বেশিরভাগ মিয়ানমারের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে।

 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খরা, বন্যা, ভূমিকম্প, ভূমিধসের মতো একাধিক প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের বার বার সাক্ষী হচ্ছে বাংলাদেশ। ঘূর্ণিঝড়ের হাত থেকেই রেহাই মিলছে না। প্রায় প্রতি বছর দেশে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানছে। কারণ ঘূর্ণিঝড় সবচেয়ে বেশি সৃষ্টি হয় বঙ্গোপসাগরে। তুলনায় আরব সাগরে অনেকটাই কম।

 

যদি অনুপাতের হিসাবে দেখা হয়, তাহলে বঙ্গোপসাগর এবং আরব সাগরে ঘূর্ণিঝড়ের অনুপাত হবে ৪:১।

 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সম্প্রতি বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় বেশি শক্তিশালী হয়ে পড়ছে। এর বিধ্বংসী আঘাত উপকূলকে তছনছ করে দিচ্ছে। এ শক্তিশালী হওয়ার পেছনে আবহাওয়া বিজ্ঞানীদের যুক্তি হচ্ছে, এর নেপথ্যে রয়েছে বিশ্ব উষ্ণায়ন। ফলে সাগরের সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় চরিত্র বদলাচ্ছে, যার প্রভাব পড়ছে দেশের উপকূলে।

 

তারা বলেন, বর্তমানে যেসব ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হচ্ছে, সেগুলো অনেক দিন ধরে শক্তি সঞ্চয় করে রাখছে। একটি উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে আম্ফানের কথা। স্থলভাগে বিপুল শক্তি নিয়ে আছড়ে পড়েছিল সেটি। ফলে ধ্বসংলীলাও অনেক বেশি হয়েছে। সমুদ্রের উপরিতল যত গরম হবে এবং তার সঙ্গে যদি হাওয়া অনুকূল হয়, ঘূর্ণিঝড় তত বেশি শক্তি সঞ্চয় করতে পারে এবং সেই শক্তি অনেক দিন ধরে রাখতে পারে।

 

এবার ঘূর্ণিঝড় মোখার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। দ্রুত শক্তি সঞ্চয় করে অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়। সেই বিপুল শক্তিতে ঘণ্টায় ২০০ কিলোমিটার বেগে স্থলভাগে আছড়ে পড়ে।

 

তারা বলেন, ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির পদ্ধতিতে কোনো বদল আসেনি। আবহাওয়ার পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রের উপরিতলের উষ্ণতা বাড়ছে। এর সঙ্গে বৃদ্ধি পাচ্ছে সমুদ্রের তাপ ধরে রাখার মাত্রা। ফলে সাম্প্রতিক অতীতে ঘূর্ণিঝড় দ্রুত গতিতে শক্তি বৃদ্ধি করছে। বিশ্বে যত গ্রিন হাউস গ্যাস তৈরি হয়, তার ৯০ শতাংশ যায় সমুদ্রগর্ভে। ফলে বৃদ্ধি পায় সমুদ্রের তাপমাত্রা। ২০২২ সালে সমুদ্রের তাপমাত্রা সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধি পেয়েছিল। এমনটাই বলছে ডব্লিউএমওর ‘স্টেট অব দ্য গ্লোবাল ক্লাইমেট’ এর রিপোর্ট।

 

মে মাসে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড়গুলো: ১৯৪১ সালের মে মাসে ঘূর্ণিঝড়ের সঙ্গে তীব্র স্রোত মেঘনা নদীর পূর্ব মোহনায় আঘাত হানে। ১৯৪৮ সালে ১৯ মে একটি ঘূর্ণিঝড়টি আঘাত হানে চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী মধ্যবর্তী ব-দ্বীপে। প্রায় ১ হাজার ২০০ অধিবাসী প্রাণ এবং ২০ হাজার গবাদিপশু মারা যায়।

 

১৯৫৮ সালের ১৯ মে একটি ঘূর্ণিঝড় মেঘনা নদীর পূর্ব পশ্চিম মোহনার পূর্ব বরিশাল ও নোয়াখালী ওপর আঘাত হানে। প্রাণ হারান ৮৭০ অধিবাসী। ১৪ হাজার ৫০০ গবাদিপশু মারা যায় এবং ক্ষেতের ফসল বিনষ্ট হয়। ১৯৬১ সালের মে মাসে তীব্র ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে বাগেরহাট ও খুলনা অঞ্চলে। বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১৬১ কিলোমিটার। প্রায় সাড়ে ১১ হাজার মানুষ মারা যান সেই ঝড়ে। ২৫ হাজার গবাদিপশুও প্রাণ হারায়।

 

১৯৬৩ সালে ২৮-২৯ মে তীব্র ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত করে হয় চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, কক্সবাজার এবং সন্দ্বীপ, কুতুবদিয়া, হাতিয়া এবং মহেশখালী উপকূলীয় অঞ্চলগুলো। চট্টগ্রামে জলোচ্ছাসের মাত্রা ছিল ৪.৩-৫.২ মিটার, বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২০৩ কিলোমিটার এবং কক্সবাজারে ঘণ্টায় ১৬৪ কিলোমিটার।

 

সেই ঝড়ে প্রাণ হারান ১১ হাজার ৫২০ জন। ১১-১২ মে ১৯৬৫ সালে তীব্র ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে বরিশাল ও বাকেরগঞ্জে। বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১৬২ কিলোমিটার এবং জলোচ্ছাসের মাত্রা ছিল ৩.৭ মিটার। ওই ঘূর্ণিঝড়ে মৃত্যু হয় ১৯ হাজার ২৭৯ জনের।

 

১৯৭৫ সালের ৯-১২ মে একটি শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় ভোলা, কক্সবাজার ও খুলনাকে বিধ্বস্ত করে দেয়। বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ৯৬.৫- ১১২.৬ কিলোমিটার। ওই ঝড়ে মারা যান ৫ জন। ১৯৮৫ সালের ২৪-২৫ মে উরিরচরের ঘূর্ণিঝড় নামে পরিচিত তীব্র ঘূর্ণিঝড়টি চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, নোয়াখালী এবং উপক‚লীয় অঞ্চলে (সন্দ্বীপ হাতিয়া ও উড়ির চর) আঘাত হানে।

 

চট্টগ্রামে বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১৫৪ কিলোমিটার, সন্দ্বীপে ১৪০ কিলোমিটার, কক্সবাজারে ১০০ কিলোমিটার এবং ঝড়ের কারণে জোয়ারের উচ্চতা ৩.০-৪.৬ মিটার ছিল। সেই ঝড়ে প্রাণ হারান ঊপকূলের ১১ হাজার ৬৯ জন বাসিন্দা। মারা যায় ১ লাখ ৩৫ হাজারের বেশি গবাদিপশু।

 

এছাড়া প্রায় ৯৫ হাজার ঘরবাড়ি এবং ৭৪ কিলোমিটার রাস্তা ও বাঁধ বিধ্বস্ত হয়। ঘূর্ণিঝড় নার্গিস উত্তর ভারত মহাসাগরে সৃষ্টি হওয়া একটি ঘূর্ণিঝড়, যা ২০০৮ সালের ৩ মে বার্মার উপকূলে আঘাত হানে।

 

ঘূর্ণিঝড় আইলা ২০০৯ সালের ২৫ মে পশ্চিমবঙ্গ-খুলনা উপকূলীয় এলাকায় আঘাত হানে। যার বাতাসের গতিবেগ ছিল ৭০-৯০ কিলোমিটার পর্যন্ত। সেই ঘূর্ণিঝড়ে ভারতের ১৪৯ জন ও বাংলাদেশের ১৯৩ জনের মৃত্যু হয়। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশে উপকূলে প্রায় ৩ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়।

 

ঘূর্ণিঝড় মহাসেন নোয়াখালী-চট্টগ্রাম উপকূলে আঘাত হানে ২০১৩ সালের ১৬ মে। তাতে প্রাণ হারান ১৭ জন। ২০১৬ সালের ২১ মে বরিশাল-চট্টগ্রাম উপক‚লে ৪-৫ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছাস তৈরি করে ঘূর্ণিঝড় ‘রোয়ানু’। সেই ঘূর্ণিঝড়ে লাখখানেক পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়, চট্টগ্রামে মৃত্যু হয় ২৪ জনের। ২০১৭ সালের ৩০ মে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার উপকূলে আঘাত হানে প্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’। ঘণ্টায় ১১০ কিলোমিটার বেগের বাতাসের শক্তি নিয়ে আঘাত হানে এটি।

 

২০১৯ সালের মে মাসে (২-৩ মে) ভারতের উড়িষ্যা উপকূলের দিকে আঘাত হানে। এর পরের দিন ফণী দুর্বল হয়ে ক্রান্তীয় ঝড় হিসেবে কলকাতা ও পরে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বয়ে যায়। ওই ঝড়ে প্রাণ হারান ৯ জন। ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। ২০২০ সালের ২০ মে সুপার সাইক্লোন আম্ফান বাংলাদেশে আঘাত হানে।

 

২০২১ সালের ২৬ মে ঘূর্ণিঝড় ইয়াস আঘাত হানে। ২০২২ সালের মে মাসে আঘাত হানে, তবে অন্ধ্রপ্রদেশে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বেশি। বাংলাদেশে সেই তুলনায় কম ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

 

সর্বশেষ গত ১৪ মে দেশের উপকূলে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় মোখা। এটি দেশের টেকনাফ ও সেন্টমার্টিনে আঘাত করে। তবে প্রাণহানি না হলেও অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এর বেশিরভাগ অংশ মিয়ানমারের উপকূল দিয়ে বয়ে যায়। কিন্তু ক্ষতচিহ্ন রেখে গেছে টেকনাফ ও সেন্টমার্টিনে।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version