-->

উৎসবমুখর ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে গাজীপুর সিটিতে ভোট গ্রহণ চলছে

নিজস্ব প্রতিবেদক
উৎসবমুখর ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে গাজীপুর সিটিতে ভোট গ্রহণ চলছে

গাজীপুর সিটি করপোরেশনে ভোট আজ। সকাল ৮টা থেকে ভোট শুরু হবে। বিরতি ছাড়াই চলবে বেলা ৪টা পর্যন্ত। এই সিটির মেয়র ৫৭টি ওয়ার্ডের কাউন্সিলর কে হবেন, তা নির্ধারণ করবেন ভোটাররা।

 

নিজের পছন্দের প্রার্থী বাছাইয়ে ভোট দেবেন প্রায় ১১ লাখ ৭৯ হাজার ৪৭৬ জন ভোটার। সব কেন্দ্রে ইভিএমে ভোট নেয়া হবে। কেন্দ্রে নিরাপত্তা ও ভোট কারচুপি রোধে ৪৮০ কেন্দ্রের সবগুলোতেই বসানো হয়েছে সিসি ক্যামেরা। আগারগাঁও নির্বাচন অফিস থেকে সার্বক্ষণিক ভোট পর্যবেক্ষণ করবে ইসি সচিবালয়।

 

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ প্রার্থীর আশাবাদ এবং প্রধান দুই স্বতন্ত্র প্রার্থীর শঙ্কার মধ্য দিয়ে মঙ্গলবার রাত ১২টা থেকে বন্ধ হয়ে গেছে সব ধরনের নির্বাচনী প্রচারণা। প্রিসাইডিং অফিসারদের মাধ্যমে কড়া নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে কেন্দ্রগুলোতে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন তথা ইভিএমসহ অন্যান্য নির্বাচনী সরঞ্জাম পৌঁছানো হয়েছে।

 

এদিকে গাজীপুর সিটি নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে ইসি। এই নির্বাচনকে নিজেদের জন্য অ্যাসিড টেস্ট হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে নির্বাচনী এলাকা নিরাপত্তার চাদরে মোড়ানো হয়েছে। নগরজুড়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রায় ১৩ হাজার সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে।

 

৪৮০টি ভোটকেন্দ্রের মধ্যে ৩৫১টি কেন্দ্র গুরুত্বপূর্ণ ধরে নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। নির্বাচনে ৫৭টি ওয়ার্ডে ৫৭ জন ম্যাজিস্ট্রেট এবং অতিরিক্ত ১৯ জনসহ সর্বমোট ৭৪ জন ম্যাজিস্ট্রেট এবং জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট দায়িত্ব পালন করবেন।

 

এ ছাড়াও র‌্যাবের ৩০টি টিম এবং ২০ প্লাটুন বিজিবিসহ সর্বমোট প্রায় ১৩ হাজার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করবেন।

 

গত ১৫ দিন জমজমাট প্রচারণার পাশাপাশি বিভিন্ন স্থানে অন্য প্রার্থীদের প্রচার-প্রচারণায় বাধা দেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে ক্ষমতাসীন দলের কর্মীদের বিরুদ্ধে। টেবিল ঘড়ি প্রতীকের প্রার্থী জায়েদা খাতুনের গণসংযোগে হামলা ও গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটেছে।

 

ইসি কমিশনার মো. আলমগীর বলেছেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। সব ধরনের অনিয়মের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এজেন্টের স্বাক্ষর ছাড়া কোনো ফলাফলশিট গ্রহণ করা হবে না।

 

গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মোল্যা নজরুল ইসলাম বলেন, ‘গাজীপুরসহ পুরো বিশ্বের লোকজন তাকিয়ে আছে আমাদের এই নির্বাচনের দিকে। আমরা যেকোনো মূল্যে একটি সুষ্ঠু ও সুন্দর নির্বাচন উপহার দিতে চাই। নির্বাচন উপলক্ষে প্রায় ১৩ হাজার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে।

 

নির্বাচন যেন সুষ্ঠু ও সুন্দর হয়, সে লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি। আমরা গাজীপুরবাসীকে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন করে দেখিয়ে দিতে চাই। মোট ৪৮০টি ভোটকেন্দ্রের মধ্যে ৩৫১টি কেন্দ্র আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। সেই কেন্দ্রগুলোকে আমরা আলাদাভাবে নজরদারিতে রাখব এবং সেখানে ফোর্স বাড়িয়ে দেব।

 

তিনি আরো বলেন, প্রিসাইডিং অফিসারের নেতৃত্বে ভোটকেন্দ্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা কাজ করবে। পাশাপাশি মোবাইল টিম, স্ট্রাইকিং ফোর্স, রিজার্ভ ফোর্স, র‌্যাব ও বিজিবি থাকবে। সবাই সম্মিলিতভাবে ভোটার ও ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তা দেবে। সেক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলার কোনো ব্যাঘাত ঘটলে প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করলে আমরা যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

 

নির্বাচনে ভোটের দিন প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে প্রার্থীদের এজেন্টদের উপস্থিতি নিশ্চিত করা হবে বলে জানিয়েছেন ওই নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. ফরিদুল ইসলাম।

 

তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশনসহ সবার একটাই চাওয়া, যেকোনো মূল্যে গাজীপুরে একটি মডেল নির্বাচন উপহার দেয়া। এই লক্ষ্যে প্রায় ৫ স্তরের নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। পুরো নগরকে নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে ফেলা হয়েছে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সবদিক থেকে প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে।

 

গাজীপুর সিটি ভোটে মেয়র পদে আটজন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এছাড়া ৫৭টি ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পদের জন্য ২৪৬ জন এবং ১৯টি সংরক্ষিত ওয়ার্ডের বিপরীতে ৭৯ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছেন। মেয়র পদের প্রার্থীদের মধ্যে মাছ প্রতীকে গণফ্রন্টের আতিকুল ইসলাম, নৌকা প্রতীকে আওয়ামী লীগের অ্যাডভোকেট মো. আজমত উল্লা খান, লাঙ্গল প্রতীকে জাতীয় পার্টির এমএম নিয়াজ উদ্দিন, হাতপাখা প্রতীকে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের গাজী আতাউর রহমান, গোলাপ ফুল প্রতীকে জাকের পার্টির মো. রাজু আহমেদ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।

 

এছাড়া স্বতন্ত্র থেকে মেয়র পদে টেবিল ঘড়ি প্রতীকে জায়েদা খাতুন (সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের মা), ঘোড়া প্রতীকে মো. হারুন-অর-রশীদ ও হাতি প্রতীকে সরকার শাহনূর ইসলাম প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।

 

এই সিটি নির্বাচনে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী মো. আজমত উল্লা খান। ইসির নিবন্ধিত মোট ৫টি দল এই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছে। তবে মূল প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি ভোট বর্জনের ঘোষণা দেয়ায় তাদের প্রার্থী নেই। তবে স্থানীয় বিএনপি নেতা শাহনূর ইসলাম রনি মেয়র পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনী করছেন।

 

বিএনপি নেতার ভাতিজা এবং বিএনপি সমর্থক হওয়ায় স্থানীয়ভাবে তার বেশ জনপ্রিয়তা রয়েছে।

 

এ কারণে গাজীপুর সিটিতে তার একটি ভোটব্যাংক রয়েছে। অন্যদিকে এই সিটির সাবেক মেয়র মো. জাহাঙ্গীরের প্রার্থিতা বাতিল হলেও তার মা জায়েদা খাতুন ভোটে রয়েছেন। গাজীপুরে জাহাঙ্গীরের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। ফলে মেয়র পদে জায়েদা খাতুনকে বড় ফ্যাক্টর হিসেবেও গণ্য করা হচ্ছে। এই তিন প্রার্থী ছাড়া অন্য কোনো প্রার্থী ভোটের মাঠে বড় ধরনের প্রভাব সৃষ্টি করতে পারবে না বলে স্থানীয় ভোটাররা মনে করছেন।

 

তবে বিএনপি ভোট বর্জন করায় এবং ভোট না দেয়ার আহব্বান জানানোয় ভোটারদের মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনা অনেক কম রয়েছে। বিএনপি সমর্থিত ভোটারদের ভোট নিয়ে আগ্রহ কম দেয়া গেছে। এছাড়াও মূল প্রতিদ্বন্দ্বী মাঠে না থাকায় এবারের ভোট নিয়ে মানুষের আগ্রহ অনেক কম রয়েছে বলে জানা গেছে।

 

তবে তারা জানান, গাজীপুরের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের প্রচুর সমর্থক আছে, তাই নির্বাচনের দিন পরিস্থিতি বদলে যেতে পারে। কারণ, জাহাঙ্গীরের সমর্থকরা নীরবে পর্দার আড়ালে কাজ করছেন। জায়েদা খাতুন (স্বতন্ত্র ও জাহাঙ্গীরের মা) অবশ্যই আজমতের সঙ্গে ভালো প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। যেহেতু বিএনপি নির্বাচন বর্জন করেছে, তাই ভোটের মূল লড়াই হবে আজমত ও জায়েদার মধ্যে।

 

স্থানীয়রা জানান, গাজীপুর ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের দুর্গ হিসেবে পরিচিত হলেও জাহাঙ্গীরের সমর্থকরা জায়েদার পক্ষে কাজ করছেন।

 

জানা গেছে, অধিকাংশ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা প্রকাশ্যে আজমত উল্লা পক্ষে কাজ করছেন। কিন্তু যারা জাহাঙ্গীরের অনুসারী বলে পরিচিত তারা আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীকে ভোট নাও দিতে পারে।

 

এছাড়াও বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্য হাসান উদ্দিন সরকারের ভাস্তে ও স্বতন্ত্র প্রার্থী সরকার শাহনূর ইসলাম রনি টঙ্গীতে বেশ জনপ্রিয়। ফলে টঙ্গীর ভোট রনির পক্ষে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

 

২০১৩ সালে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের প্রথম ও নির্দলীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সমর্থন নিয়ে প্রার্থী হয়ে পরাজিত হয়েছিলেন আজমত উল্লা খান। ওই সময়ে তার বিপরীতে দলের ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী হয়েছিলেন জাহাঙ্গীর আলম।

 

শেষ মুহূর্তে তিনি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ালেও ব্যালটে তার নাম থেকে যায়। ওই ভোটে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী এম এ মান্নানের কাছে আজমত উল্লার পরাজয়ের পেছনে জাহাঙ্গীরের প্রার্থিতা ও বিরোধিতাকে কারণ হিসেবে ধরা হয়।

 

এরপর ২০১৮ সালের দলীয় প্রতীকের নির্বাচনে জাহাঙ্গীরকে নৌকার টিকিট দেয় আওয়ামী লীগ; ধানের শীষে বিএনপির প্রার্থী হাসানউদ্দিন সরকারকে হারিয়ে নগর ভবনে নৌকা ভেড়ান জাহাঙ্গীর। এবার দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে চাইলেও শেষ পর্যন্ত তা আটকে যায়; কিন্তু মা জায়েদা খাতুনকে স্বতন্ত্র প্রার্থী করে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর বিরুদ্ধেই তৎপর জাহাঙ্গীর।

 

অন্যদিকে বিএনপির বর্জনের মধ্যে দলের কর্মী এবং আগের নির্বাচনে দলের প্রার্থী হাসানউদ্দিন সরকারের ভাতিজা রনি সরকার স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে রয়েছেন। টঙ্গীতে আওয়ামী লীগ নেতা আহসান উল্লাহ মাস্টার হত্যার মামলায় মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত কারাবন্দি বিএনপি নেতা নুরুল ইসলাম সরকারের ছেলে রনি।

 

এই নুরুল ইসলামকে হারিয়ে ১৯৯৫ সালে প্রথমবার টঙ্গী পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী আজমত উল্লা।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version