-->
শিরোনাম

ইতিবাচক নির্বাচনের ধারায় ফিরবে দেশ

শাহীন রহমান
ইতিবাচক নির্বাচনের ধারায় ফিরবে দেশ

শাহীন রহমান: গাজীপুর সিটি নির্বাচনের পরেই সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়টি নিয়ে দেশে জোরেশোরে আলোচনা শুরু হয়েছে।

 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গাজীপুর সিটির নির্বাচনের এই চিত্র দেশে বহুদিন ধরেই অনুপস্থিত। আগে অনুষ্ঠিত নির্বাচন সাধারণ ভোটারদের যেমন আশা জাগাতে পারেনি, তেমনি কোনো পক্ষই নির্বাচন নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেনি। কিন্তু হঠাৎ করেই গাজীপুর সিটি নির্বাচন তাদের সে ধারণা অনেকটাই পাল্টে দিয়েছে।

 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গাজীপুর সিটি ভোটের যে বিশ্লেষণ তাতে মনে হচ্ছে সব পক্ষই খুশি। এই নির্বাচন নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো পক্ষের অভিযোগ নেই। আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পরাজয় হলেও দলটির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এতে গণতন্ত্রের বিজয় হয়েছে।

 

অন্যদিকে বিএনপিও বলছে, এতে সরকার ভোট সুষ্ঠু দেখাতে গিয়ে ভোটের আসল চিত্র ফুটে উঠেছে।

 

তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গাজীপুর নির্বাচন আগামীতে দেশে ইতিবাচক নির্বাচনের প্রভাব তৈরি করবে, যা বহুদিন ধরে দেশে ভোটের সংস্কৃতিতে অনুপস্থিত ছিল। এছাড়া এমন নির্বাচন ভোটার এবং প্রার্থীদের মধ্যে আস্থা ফেরাতে সহায়তা করবে। তবে জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু করতে প্রয়োজন রাজনৈতিক ঐকমত্য।

 

বিশেষজ্ঞরা জাতীয় নির্বাচনের আগে সিটি নির্বাচনকে ইসির জন্য টেস্টকেস হিসেবে বিবেচনা করছে। যদিও বর্তমান ইসি দায়িত্ব নেয়ার পর বহু নির্বাচন পরিচালনা করেছেন। সেসব নির্বাচন নিয়ে বড় ধরনের অভিযোগ না উঠলেও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো খুশি হতে পারেনি। আগের ভোটগুলোতে ভোটার উপস্থিতি যেমন কম ছিল, সহিংতা না হলেও ভয়ভীতি দেখানোর সংস্কৃতি কাজ করেছে মারাত্মকভাবে।

 

সম্প্রতি ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনের প্রতিদ্ব›দ্বী প্রার্থী বিএনপি নেতার হঠাৎ নিখোঁজ হওয়ার মতো ঘটনাও ভোটাররা সহজভাবে নেয়নি। ফলে তাদের মধ্যে আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়া নিয়ে সবসময়ই একটি সংশয় ছিল। হঠাৎ করেই গাজীপুর নির্বাচন সেই ধারণায় ছেদ ফেলে দিয়েছে।

 

পরে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সময়ই বলে দেবে জাতীয় নির্বাচনে এর প্রভাব কতটা পড়বে।

 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন যেভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে, সে চিত্র দেশে অনেক বছর দেখা যায়নি। নানা কারণে এই নির্বাচনের একটা বাড়তি গুরুত্ব আছে। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, নির্বাচনের সময় ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীর দাপট এবং তাদের নির্বাচনে জেতানোর জন্য প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যেভাবে তৎপর হয়ে উঠত, সে চিত্র গাজীপুরে ছিল না।

 

অনেকের ধারণা, নির্বাচনের ঠিক আগের রাতে আমেরিকা নতুন যে ভিসানীতি ঘোষণা করেছে, সেটির প্রভাব পড়েছে নির্বাচনে। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক গোবিন্দ চক্রবর্তী মনে করেন, এই নির্বাচন নিয়ে সব পক্ষই সন্তুষ্ট এবং এটা একটা ইতিবাচক প্রভাব তৈরি করবে যে, সরকার এবং নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন দিতে সচেষ্ট।

 

আগামী ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে পরের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে অনুষ্ঠিত হবে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন। নির্বাচনের এই টাইমলাইন ধরেই এগিয়ে যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন। তবে দলীয় সরকারের নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিরোধিতা করে আসছে বিএনপি। তারা একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানে দাবি জানিয়ে আসছে।

 

এ অবস্থায় গাজীপুরের নির্বাচন সুষ্ঠু হলেও বিএনপি এটাকে সরকারের চাল হিসেবে মনে করছে।

 

বিএনপি সূত্র জানিয়েছে, তারা এখানো নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানে জন্য হার্ডলাইনে অবস্থান করছেন।

 

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী জানিয়েছেন, তারা কোনোভাবে এ সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে না। প্রয়োজনের আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করা হবে। এছাড়াও তিনি গাজীপুর সিটির ভোট সুষ্ঠু করা সরকারের চাল হিসেবে দেখছেন বলে সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে মন্তব্য করেছেন।

 

এদিকে গাজীপুর সিটি নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হওয়ায় ইসি ব্যাপক খুশি। জাতীয় নির্বাচনে আগে এমন একটা নির্বাচন উপহার দিতে পেরে নিজেদের অনেকটা নির্ভার মনে করছেন। তারা প্রত্যাশা করছেন বরিশাল, খুলনা, রাজশাহী এবং সিলেট সিটি নির্বাচনটাও এমনি হবে। ফলে জাতীয় নির্বাচনের আগে ভোটারদের আস্থা ফেরানোর একটা ইতিবাচক ধারা তৈরি হবে ইসির প্রতি।

 

তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিটি নির্বাচন এবং জাতীয় নির্বাচন দুটি ভিন্ন বিষয়, ভিন্ন ইস্যু। সিটি নির্বাচন সুষ্ঠু হলেই জাতীয় নির্বাচন কতটা সুষ্ঠু হবে, তা নিয়ে এখনই স্পষ্ট করা যাবে না। এটা নির্ভর করবে আগামী দিনগুলোতে রাজনৈতিক দলের কর্মকান্ডের ওপর। যেহেতু জাতীয় নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হবে, সেখানে দলের একটা প্রভাববলয় থেকে যাবে।

 

ফলে ইসি ইচ্ছা করলেও সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনা করা তাদের জন্য বেশ কঠিন। তবে রাজনৈতিদক দলগুলো এক হয়ে বা ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি গ্রহণযোগ্য ব্যবস্থা নিলে ভোটের পরিবেশ ভিন্ন হতো। তবে এ বিষয়ে এখনই নিশ্চিত করে কিছু বলার সময় আসেনি।

 

সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, গাজীপুর নির্বাচনে দৃশ্যমান অনিয়ম ও সহিংসতা হয়নি বলেই প্রতীয়মান হয়েছে। তবে এটা এই নয় যে, এই নির্বাচনটি যেভাবে হয়েছে দেশের সব নির্বাচন সেভাবে হবে।

 

তিনি বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিসা প্রদানের ক্ষেত্রে যে বিধিনিষেধের কথা বলেছে, সেটার জন্য ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ প্রশাসনের লোকজন এমনকি খোদ নির্বাচন কমিশনকে দায়িত্বশীল আচরণ করতে হয়তো বাধ্য করেছে। কারণ তাদের মাথার ওপর একটি খড়্গ চেপেছে।

 

তিনি বলেন, বাকি সিটি করপোরেশনগুলোর নির্বাচনও এ ধরনের গ্রহণযোগ্য হবে। তবে কোনোভাবেই বলা যাবে না, আগামী জাতীয় নির্বাচন এমনটা হবে। কারণ জাতীয় নির্বাচনের হিসাব-নিকাশ ভিন্ন। সেখানে ক্ষমতার রদবদলের প্রশ্ন রয়েছে। কাজেই গাজীপুরে শান্তিপূর্ণ হয়েছে বলেই সংসদ নির্বাচনে এমন হবে, তা কোনোভাবেই বলা যায় না।

 

তবে জানা গেছে, গাজীপুর নির্বাচন সুষ্ঠু হলেও বিএনপি নির্বাচন নিয়ে আগের অবস্থানেই রয়েছে। দলটি মনে করছে, নিরপেক্ষ নির্বাচন ছাড়া মানুষ কোনোভাবেই ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ পাবে না। ফলে গাজীপুর সিটি নির্বাচনকে আপাতদৃষ্টে যতই সুষ্ঠু মনে হোক, এতে করে এখনো বিরোধী দল বিএনপির আস্থা অর্জন করা যায়নি। তবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ গাজীপুর নির্বাচনকে দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচনের দৃষ্টান্ত হিসেবে মনে করছে।

 

কৃষিমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, সরকারের কাজ নির্বাচন কমিশনকে সুষ্ঠু নির্বাচন করতে সহায়তা দেয়া। গাজীপুরে সেই লক্ষ্য অর্জন হয়েছে।

 

তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু করতে প্রয়োজন সব দলের স্বতঃস্ফর্ত অংশগ্রহণ। সহিংসতার রাজনীতি থেকে বের হয়ে এসে দলগুলো পরস্পরকে একটি আস্থার জায়গা তৈরি করতে পারলে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন অবশ্যই সুষ্ঠু হবে।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version