-->

চ্যালেঞ্জে আওয়ামী লীগ ও ইসি

শাহীন রহমান
চ্যালেঞ্জে আওয়ামী লীগ ও ইসি

শাহীন রহমান: গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে সম্পন্ন হয়েছে। এখনো বাকি রয়েছে চার সিটি করপোরেশন নির্বাচন। জাতীয় নির্বাচনের আগে এসব নির্বাচন যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি ইসির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।

 

ইসির চ্যালেঞ্জ হলো গাজীপুরের মতো বাকি চার সিটিতেও ভোট সবার কাছে বিশ্বাসযোগ্য করা। পাশাপাশি চ্যালেঞ্জ রয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জন্য। তাদের চ্যালেঞ্জ হলো গাজীপুরের মতো ভোট হলে কোন কোন সিটিতে দলের প্রার্থীর জন্য বুমেরাং হতে পারে।

 

সংশ্লিষ্ট মনে করছেন, গাজীপুরে সুষ্ঠু ভোট হওয়ায় নৌকা প্রার্থীর ভরাডুবি হয়েছে। বাকি চার সিটি নির্বাচন নির্বাচন গাজীপুরের মতো হলে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থীদের বিজয় অনেকটা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে। দলটির নেতারা মনে করছেন, চার সিটির মধ্যে অন্তত দুটি সিটিতে আওয়ামী লীগ নির্ভার হলে দুটিতে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হতে পারে। গত ২৫ মে ভোট হয় গাজীপুর সিটি করপোরেশনে।

 

অনেকে মনে করছেন, গাজীপুর সিটি নির্বাচন যেভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে, সে চিত্র বাংলাদেশে অনেক বছর দেখা যায়নি। ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীর দাপট এবং তাদের নির্বাচনে জেতানোর জন্য প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যেভাবে তৎপর হয়ে উঠত, বলতে গেলে গাজীপুরে ছিল না।

 

অনেকের ধারণা, নির্বাচনের ঠিক আগের রাতে আমেরিকা নতুন যে ভিসানীতি ঘোষণা করেছে, সেটির প্রভাব পড়েছে নির্বাচনে। এ কারণে মাঠের চিত্র বদলাতে সময় লাগেনি।

 

এ ভোটের ফলও চমক সৃষ্টিকারী। সবাইকে অবাক করে দিয়ে মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন প্রায় অপরিচিত মুখ জায়েদা খাতুন। যদিও সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীরের কারণেই এ বিজয় সম্ভব হয়েছে। তারপরও ক্ষমতাসীনদের বিষয়টি ভাবিয়ে তুলছে। তারা মনে করছেন, দলের মধ্যে অনৈক্যের কারণে এ ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। সামন্যে আরো চারটি নির্বাচন রয়েছে।

 

এখনই ব্যবস্থা নেয়া না হলে সেখানেও এ ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। গাজীপুরে পরাজয়ে দুশ্চিন্তায় ভাবিয়ে তুলছে ক্ষমতাসীদের। বাকি চারটি সিটিতে কী পরিস্থিতি হয়, সেটা নিয়ে এখন পর্যালোচনা করছে দলটি।

 

জানা গেছে, দলটি সবচেয়ে বেশি চিন্তায় রয়েছে বরিশাল ও সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে। ১২ ও ২১ জুন এ দুই সিটির নির্বাচন হবে।

 

মার্কিন ভিসানীতির কারণে গাজীপুরের সুষ্ঠু ভোট হয়েছে কিনা সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে জানকে চাওয়া হয়েছিল নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীরের কাছে।

 

তিনি জবাবে বলেন, ইসির মনে করে না মার্কিন ভিসানীতি গাজীপুর সিটি নির্বাচন সুষ্ঠু করার পেছনে কোনো ভ‚মিকা রেখেছে।

 

তিনি বলেন, সবার ন্যায়সঙ্গত দায়িত্ব পালন করার কারণে সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনা করা সম্ভব হয়েছে। শুধু গাজীপুরের ক্ষেত্রে না, আমরা সবসময় বলেছি, নির্বাচনটা সুষ্ঠু হবে, সুন্দর হবে। গাজীপুরের মতোই আসন্ন সব নির্বাচন সুষ্ঠু করবে ইসি। নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যা যা করার, সবকিছুই করা হবে।

 

ইসি ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, আগামী ১২ জুন অনুষ্ঠিত হবে খুলনা ও বরিশাল সিটিতে। অন্যদিকে ২১ জুন অনুষ্ঠিত হবে সিলেট ও রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচন। ইতোমধ্যে খুলনা ও বরিশাল সিটিতে নির্বাচনে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার সময় শেষ হয়েছে। প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত হয়েছে। প্রার্থীরা এখন নির্বাচনী প্রচারে ব্যস্ত। যদিও দীর্ঘসময় ধরেই সিটি নির্বাচনে অনুপস্থিত রয়েছে বিএনপি।

 

দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে যারাই সিটিতে প্রার্থী হচ্ছেন তাদের দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে গাজীপুরের প্রার্থী হয়েছিল শাহনূর সরকার রনি। দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করা এবং জনপ্রিয়তায় পিছিয়ে থাকার কারণে তার প্রাপ্ত ভোট হাতেগোনা। মেয়র পদে তিনি ভোট পেয়েছেন মাত্র ২৩ হাজার ২৬৫ ভোট।

 

এ আসনের রনির চেয়ে দ্বিগুণ ভোট পেয়েছেন ইসলামী আন্দোলেন বাংলাদেশের হাত পাখার প্রার্থী গাজী আতাউর রহমান। তিনি ৪৫ হাজার ৩৫২ ভোট পেয়েছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ফল নির্ধারণে এ ভোট ভ‚মিকা রেখেছে। জানা গেছে, বরিশাল সিটিতে এ দলের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে।

 

এ সিটির হাতপাখার প্রার্থীর হয়েছে দলটি ভাইস চেয়ারম্যান সৈয়দ মুহম্মাদ ফয়জুল করিম। তিনি ইতোমধ্যে বেশ আলোচনায় রয়েছেন। বরিশালে তাদের বড় ভোটব্যাঙ্ক রয়েছে। অন্যদিকে এ সিটিতে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী হয়েছে আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ। যিনি সদ্য বিদায়ী মেয়র সাদিক আব্দুল্লাহর চাচা। চাচার সঙ্গে তার সম্পর্ক যেমন ভালো নয়। তেমনি রাজনীতিতে তার প্রভাব অনেক কম।

 

মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাদিক আব্দুল্লাহ চাচার সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখছেন। তার জন্য কাজও করছেন না। সংশ্লিষ্ট মনে করছেন সুষ্ঠু ভোট হলে আওয়ামী লীগের প্রার্থী জয়লাভ করা অনেকটা চ্যালেঞ্জ হয়ে পড়বে।

 

এ সিটিতে আওয়ামী লীগের জন্য আরো বড় চ্যালেঞ্জ হলো বিএনপির সাবেক মেয়র আহসান হাবীব কামালের ছেলে কামরুল আহসান রুপমও মেয়র প্রার্থী। তিনি দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে ভোটে প্রার্থী রয়েছে। বরাবরই বরিশালে বিএনপি বড় ভোটব্যাঙ্ক রয়েছে। যদিও বিএনপি ভোটবর্জন ঘোষণা দিয়েছে।

 

তারপর অনেকে মনে করছেন, বরিশালে তার পিতার ব্যাপক প্রভাব আছে। কাউন্সিলর প্রার্থী হওয়ার কারণে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ২৯ তৃণমূল নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করে বিএনপি। এমনকি দলীয় নেতাকর্মীদের ভোট না দেয়ার আহব্বানও জানানো হয়। তার পর দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে কাউন্সিলর পদে দাঁড়ানো ২৯ প্রার্থী মধ্যে ১১ নির্বাচনের জয়লাভ করেছেন। বরিশালেও এ হিসাব-নিকাশ কাজে দিতে পারে। সেক্ষেত্রে ভোটের ফলে ব্যাপক প্রভাব পড়তে পারে।

 

ফলে অনেকেই মনে করছেন, বিএনপি এ সিটি নির্বাচন বর্জন করলেও আওয়ামী লীগ তার প্রার্থীর জন্য নির্ভার হতে পারছে না।

 

অন্যদিকে সিলেট সিটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ২১ জুন। বিএনপি এ নির্বাচন বর্জন করায় বিএনপি জনপ্রিয় নেতা সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী ভোট থেকে সরে দাঁড়িয়েছে। এতেও আশ্বস্ত হতে পারছে না আওয়ামী লীগ। এ সিটির মেয়র পদে মনোনয়নপত্র বাছাইয়ের কাজ শেষে বৈধ প্রার্ধীর তালিকা ঘোষণা করা হয়েছে। যদিও প্রার্থীদের মধ্যে এখনো প্রতীক বরাদ্দ হয়নি।

 

ইসি কর্মকর্তারা জানান, ১ জুন প্রত্যাহার শেষে প্রার্থীদের মধ্যে প্রতীক বরাদ্দ দেয়া হবে। প্রতীক বরাদ্দ নিয়ে মাঠে নেমে পড়বেন প্রার্থীরা। তবে এ সিটি নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ আশঙ্কামুক্ত হতে পারছেন না। দলটির মেয়র পদে প্রার্থী আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী নতুন মুখ। স্থানীয় আওয়ামী লীগের সঙ্গে তার সুম্পর্ক নেই। ফরে প্রথম থেকেই নেতাকর্মীদের সঙ্গে তার দূরত্ব তৈরি হয়েছে। বেশিরভাগ নেতাকর্মী তার সঙ্গে নেই। লন্ডনপ্রবাসী হিসেবে পরিচিত এ প্রার্থীতে তারা উড়ে এসে জুড়ে বসার সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে।

 

তবে জানা গেছে, খুলনা ও রাজশাহীতে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ নেই। ফলে দলের প্রার্থীর বিজয় লাভের দেখতে বড় ধরনের বাধাও দেখছে না আওয়ামী লীগ। এ দুই সিটি নিয়ে তারা অনেক নির্ভার।

 

ইসি কর্মকর্তারা জানান, খুলনা ও বরিশাল সিটিতে নির্বাচনে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার সময় শেষ হয়েছে। প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত হয়েছে। এখন চলছে নির্বাচনি প্রচার। এ দুই সিটিতে ভোট হবে ১২ জুন। রাজশাহী ও সিলেট সিটি নির্বাচনে ১ জুনের মধ্যে মনোনয়ন প্রত্যাহারের সুযোগ রয়েছে।

 

বরিশাল সিটি করপোরেশনে মেয়র পদে চূড়ান্ত প্রার্থীদের মধ্যে রয়েছেন আওয়ামী লীগের আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ, জাতীয় পার্টির মো. ইকবাল হোসেন, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সৈয়দ মোহাম্মদ ফয়জুল করিম, জাকের পার্টির মিজানুর রহমান বাচ্চু, স্বতন্ত্র কামরুল আহসান রুপম ও আলী হোসেন।

 

খুলনায় চূড়ান্ত মেয়র প্রার্থী আওয়ামী লীগের সদ্য সাবেক মেয়র তালুকদার আবদুল খালেক, জাতীয় পার্টির শফিকুল আলম মধু ও ইসলামী আন্দোলন হাফেজ আবদুল আওয়াল। রাজশাহীতে মেয়র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র বৈধ হয়েছে চারজনের।

 

তারা হলেন আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী সদ্য সাবেক সিটি মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন, জাতীয় পার্টির সাইফুল ইসলাম, জাকের পার্টির লতিফ আনোয়ার ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মো. মুরশিদ আলম। সিলেটে বৈধ প্রার্থীরা হলেন আওয়ামী লীগের আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী, জাতীয় পার্টির নজরুল ইসলাম বাবুল, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের হাফেজ মাওলানা মাহমুদুল হাসান, জাকের পার্টির মো. জহিরুল আলম, স্বতন্ত্র মোহাম্মদ আবদুল হানিফ কুটু ও মো. ছালাহ উদ্দিন রিমন।

 

আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এসএম কামাল হোসেন এ বিষয়ে বলেন, ‘গাজীপুরে বিশ্বাস ভঙ্গ হয়েছে। বাকি চারটি সিটিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের সঙ্গে নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। ঐক্যবদ্ধ থাকলে আমাদের প্রার্থীরা জিতবেন।

 

তিনি বলেন, বাকি চার সিটির মধ্যে খুলনা ও রাজশাহীতে কোনো সমস্যা নেই। বরিশাল ও সিলেটে কিছু সমস্যা আছে।

 

এজন্য ওই দুই সিটিতে আওয়ামী লীগের শক্তিশালী কেন্দ্রীয় টিম সেখানে গিয়ে কাজ করছে।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version