-->
শিরোনাম

নির্বাচনী বছরে আসছে জনকল্যাণমূলক বাজেট

শাহীন রহমান
নির্বাচনী বছরে আসছে জনকল্যাণমূলক বাজেট

শাহীন রহমান: একাদশ জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশন শুরু হচ্ছে আজ থেকে। বিকেল ৫টায় জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে অধিবেশন শুরু হবে। জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।

 

রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন সংবিধানের ৭২ অনুচ্ছেদের ধারা (১) অনুযায়ী তাকে দেয়া প্রদত্ত ক্ষমতাবলে সংসদের ২৩তম অধিবেশন আহব্বান করেন।

 

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল আগামীকাল বৃহস্পতিবার নতুন অর্থবছরের জাতীয় বাজেট পেশ করবেন। ২৫ জুন সংসদে প্রস্তাবিত বাজেট পাস হতে পারে বলে জানা গেছে।

 

বর্তমান সরকারের মেয়াদে এটাই শেষ বাজেট। তাই এবারের বাজেট কেমন হতে পারে তা নিয়ে সর্বত্র আলোচনা শুরু হয়েছে।

 

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এবারের বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং উচ্চ জিডিপি প্রবৃদ্ধির গতি বজায় রাখার লক্ষ্যে বাজেটের আকার হচ্ছে ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার। তবে এই সরকারের শেষ বাজেট জনতুষ্টি না জন্যকল্যাণমূলক হবে সেটাই এখন আলোচনার বিষয়বস্তু।

 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ক্রমাগত দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ওপর ব্যাপক প্রভাব সৃষ্টি করছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে সমাজের একটি বড় অংশের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। এর সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়ছে দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষের জীবনযাপনে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নতুন করে করের বোঝা যেন আর বাড়ানো না হয়, সেদিকেই সরকারের নজর দিতে হবে।

 

এ কারণে নির্বাচন সামনে থাকলেও বাজেটে জনতুষ্টির সুযোগ কম। ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক ও অর্থনীতিবিদ এমএম আকাশ বলেছেন, বাজেটে সাধারণ মানুষের চাওয়া একটা কর এবং দ্রব্যমূল্য যেন আর না বাড়ে। তবে সবসময় দেখা যায় ভ্যাট ও প্রত্যক্ষ কর বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের ওপর চাপানো হয়। এর ফলে দ্রব্যমূল্য বাড়ে। তবে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা জটিল হওয়ার কারণে সরকারের চেষ্টা থাকবে পরোক্ষ কর না বাড়ানোর।

 

তবে বাজেট পেশের পর দ্রব্যমূল্য আরো বেড়ে যায় কিনা সে আশঙ্কা রয়েছে সাধারণ মানুষের মধ্যে। তারা বলছেন, নতুন বাজেটের পর নিত্যপণ্যের বাজার একটু নাগালের মধ্যে যেন আসে। দেশে এখনো মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে। অথচ ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, চীনসহ নানা দেশে মূল্যস্ফীতি কমতে শুরু করেছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে তাই বাজেটে টেকসই উদ্যোগ নেয়ার কথা বলেন।

 

সানেমের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক রায়হান বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য কী করা হচ্ছে, বাজেটে সেটার পরিষ্কার ধারণা তৈরি করতে হবে। দেশে চলমান সংকটগুলো কীভাবে সামলানো হবে, তার সুস্পষ্ট পরিকল্পনাও বাজেটে থাকা দরকার। না হলে বৃহৎ সংখ্যার জনগোষ্ঠী মূল্যস্ফীতির চাপে বড় ধরনের বিপদে পড়ে যাবে।

 

বর্তমান সরকারের মেয়াদে এটাই শেষ বাজেট হলেও অর্থনীতির সংকটময় অবস্থা বিবেচনা করে জনতুষ্টির চেয়ে জনকল্যাণ বাজেটের কথাই বেশি ভাবতে হচ্ছে সরকারকে।

 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নির্বাচন সামনে রেখে সরকার সাধারণত ‘জনতুষ্টিমূলক’ বা ‘ভোট টানার’ বাজেট দিয়ে থাকে। এবারের বাজেটটি দিতে হচ্ছে ভিন্ন ও তুলনামূলকভাবে অধিকততর সংকটময় একটি অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে।

 

এ কারণে নতুন বাজেটে জনতুষ্টির তুলনায় সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার দিকেই সরকারের বেশি মনোযোগ থাকবে। তারা বলছেন, বাজেট সামনে রেখে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ আরেকটি নতুন প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে। অর্থনীতির সংকট মোকাবিলায় সরকারকে আইএমএফের কাছ থেকে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ নিতে হচ্ছে।

 

ঋণের প্রথম কিস্তির অর্থ ইতোমধ্যে পাওয়া গেছে। এই ঋণের বেশ কিছু শর্ত রয়েছে, যার মধ্যে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ভর্তুকি কমানো অন্যতম। ভর্তুকি কমাতে সরকার জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে গড়ে ৫০ শতাংশ। কয়েক দফায় দাম বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুতের। গ্যাসের দামও বাড়ানো হয়েছে। আগামীতে আরো দাম বাড়ানোর প্রয়োজন হতে পারে।

 

জনতুষ্টিমূলক না হলেও সরকারকে আর্থিক শৃঙ্খলার জন্য এ ধরনের পদক্ষেপ নিতে হচ্ছে। আইএমএফের ঋণের পরবর্তী কিস্তিগুলো পেতে আগামীতে নতুন কর আরোপ, সুদের হার বাড়ানো, মুদ্রার বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়ার মতো বিভিন্ন সংস্কারের মধ্যে যেতে হবে, যা জনপ্রিয় নাও হতে পারে বলেও মন্তব্য করেন তারা।

 

তবে তারা বলছেন, ভিন্নভাবে হলেও বাজেটে নির্বাচনী ভাবনা থেকেও কিছু উদ্যোগ নেয়া হতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে দৃশ্যমান বড় প্রকল্পের উদ্বোধন কিংবা বাস্তবায়ন জোরদার করে ভোটারদের ভাবনাকে প্রভাবিত করার চেষ্টা হবে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সমন্বয় করে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বার্ষিক ইনক্রিমেন্টের হার বাড়তে পারে।

 

ইতোমধ্যে আগামী অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ অনুমোদন করেছে। তাতে অগ্রাধিকার তালিকার প্রকল্পগুলোতে বড় অঙ্কের বরাদ্দ রাখা হয়েছে।

 

বরাদ্দের বিবেচনায় শীর্ষ ১০টি প্রকল্পের মধ্যে মেট্রোরেল, পদ্মা সেতু রেল সংযোগ, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সম্প্রসারণ, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ ৯টি ভৌত অবকাঠামো প্রকল্প রয়েছে।

 

পরিকল্পনা কমিশন গত মার্চে এডিপি প্রণয়নের যে নীতিমালা প্রকাশ করে, সেখানে ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্পে অগ্রাধিকার দেয়ার পাশাপাশি ধীরগতির প্রকল্পে বরাদ্দ কমিয়ে দ্রুত গতির প্রকল্পে বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। বরাদ্দের ক্ষেত্রে বিশ্ব অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় খাদ্য নিরাপত্তা এবং কৃষি খাতে বিশেষ জোর দেয়ার তাগিদ রয়েছে ওই নীতিমালায়।

 

দারিদ্র্য বিমোচনের সঙ্গে সরাসরি সংশ্লিষ্ট প্রকল্পে অগ্রাধিকার দেয়ার কথা বলা হয়েছে। এসব পদক্ষেপের সঙ্গে নির্বাচনী ভাবনার যোগসূত্র থাকতে পারে বলে ধারণা করা যায়।

 

সম্প্রতি পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেছেন, সরকার জনতুষ্টির নয়, জনকল্যাণের বাজেট দিতে যাচ্ছে। ব্যয়ের ক্ষেত্রে কৃচ্ছ্রসাধনের প্রয়াসও আগামী অর্থবছরে বজায় থাকবে।

 

বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, অর্থনীতি যাতে আরো সংকটে না পড়ে, সেদিকেই বেশি মনোযোগ রয়েছে সরকারের। এ জন্য আয় বাড়ানো এবং ব্যয়ের ক্ষেত্রে সংযত হওয়ার পদক্ষেপ থাকবে।

 

অন্যদিকে জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা, দারিদ্র্যবান্ধব বিভিন্ন কর্মসূচি, বড় অবকাঠামো প্রকল্পে অগ্রাধিকার দেয়ার মতো কিছু পদক্ষেপ থাকবে। ফলে একটি ‘মিশ্র ঝুড়ির’ বাজেট করার সম্ভাবনাই প্রবল হচ্ছে।

 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, রিজার্ভ ও ডলার সংকট, আইএমএফের শর্ত এসব বিবেচনায় রেখে জাতীয় নির্বাচনের আগে এই বাজেট পেশ করা হচ্ছে। ফলে সরকারকে জনতুষ্টির বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে।

 

তবে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, নির্বাচন সামনে থাকলেও বাজেটে জনতুষ্টির তেমন সুযোগ নেই। আর এত বড় বাজেটের অর্থ কোথা থেকে আসবে, সেটাই এখন প্রধান চ্যালেঞ্জ।

 

সিপিডির ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান মনে করেন, ‘নির্বাচনের আগে বাজেট হলেও তথাকথিত জনতুষ্টির বাজেট করার সুযোগ নেই। সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী বাড়াতে হবে। সাধারণ মানুষের ওপর প্রভাব পড়ে এমন পণ্যে হয়তো নতুন কর আরোপ করা হবে না। তবে বিলাস পণ্যে কর বাড়বে। করমুক্ত আয়সীমা বাড়তে পারে এবারের বাজেটে।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version