-->
বিশ্ব নারী উত্ত্যক্তকরণ প্রতিরোধ দিবস আজ

দরকার জোরালো সামাজিক আন্দোলন

নিখিল মানখিন
দরকার জোরালো সামাজিক আন্দোলন

নিখিল মানখিন: কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারীতে উত্ত্যক্তের অভিযোগে গত ১২ জুন মোকলেছুর রহমান শান্ত নামে এক যুবককে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। ভুক্তভোগী ছাত্রীর বাবা বাদী হয়ে থানায় এজাহার দিলে পুলিশ ওই যুবককে গ্রেপ্তার দেখিয়ে কুড়িগ্রাম জেলহাজতে পাঠিয়েছে। উপজেলার দেওয়ানের খামার গ্রামের মোকলেছুর দীর্ঘদিন ধরে একই গ্রামের নবম শ্রেণির ওই ছাত্রীকে উত্ত্যক্ত করে আসছিলেন।

 

এ বিষয়ে কয়েকবার গ্রাম্য বিচার হলেও কোনো সুরাহা হয়নি। গত ১১ জুন মোকলেছুর ওই ছাত্রীর পথরোধ করলে তার চিৎকারে স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে বলে জানায় এলাকাবাসী।

 

শুধু ভূরুঙ্গামারীর এ ছাত্রীটি নন, প্রতিদিন দেশের আনাচে-কানাচে নানাজনের দ্বারা নানাভাবে উত্ত্যক্তের শিকার হচ্ছেন হাজার হাজার নারী। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ঝামেলা এড়াতে এবং সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির কথা ভেবে উত্ত্যক্তের শিকার হওয়ার ক্ষোভ ও কষ্ট নীরবে সহ্য করে চলেন ভুক্তভোগীরা। মাদরাসায় নবম শ্রেণিতে পড়ুয়া মেয়েকে উত্ত্যক্তের প্রতিবাদ করে হামলার শিকার হয়েছেন নোয়াখালীর কবিরহাট উপজেলার ধানশালিক ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. সাহাব উদ্দিন। গত ৪ জুন রাত ৯টার দিকে পার্শ্ববর্তী চাপরাশিরহাট ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের রামেশ্বর গ্রামের খেবারগো মোকামে এ ঘটনা ঘটে।

 

গত ৫ জুন বিকেলে চেয়ারম্যান মো. সাহাব উদ্দিন ধানশালিক ইউনিয়ন পরিষদের নিজ কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে এ তথ্য জানান।

 

তিনি বলেন, মেয়ে চাপরাশিরহাট এ রব সিনিয়র মাদরাসায় নবম শ্রেণিতে পড়ে। মাদরাসায় আসা-যাওয়ার পথে স্থানীয় আকাশ, একরাম, দিপু ও টুটুলসহ বখাটেরা মেয়েকে উত্ত্যক্ত করে আসছে। তারা নানাভাবে যৌন হয়রানিসহ বিভিন্ন কুপ্রস্তাব দেয়। এতে রাজি না হলে অ্যাসিড মারারও হুমকি দেয়। বিষয়টি জানালে আমার ছেলে অভিযুক্তদের জিজ্ঞাসা করতে যায়। এ সময় বখাটেরা ছেলেকে বেধড়ক মারধর করে আটকে রাখে।

 

রাজধানীর কুড়িল বিশ্ব রোডের একটি পোশাক কারখানায় কাজ করেন শেফালী বেগম। পরিবার নিয়ে থাকেন জগন্নাথপুরে। যাওয়া-আসার পথে নানা অঙ্গভঙ্গিমা করে এক বখাটে তাকে উত্ত্যক্ত করত। এক দিন সন্ধ্যায় বাসায় ফেরার পথে একা পেয়ে শ্লীলতাহানির চেষ্টা করা হয়। চিৎকার দিলে পালিয়ে যায় ছেলেটি। পরবর্তী দিনগুলোয় দলবদ্ধভাবে যাওয়া-আসা করায় ছেলেটির উত্ত্যক্ত থেকে রেহাই পায় শেফালী বেগম।

 

গত ৭ জুন বিকালে মৌলভীবাজার সরকারি কলেজ দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীকে ইভটিজিংয়ের অভিযোগে ২ যুবককে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। মৌলভীবাজার সরকারি কলেজ প্রাঙ্গণ এলাকায় ইভটিজিংয়ের ঘটনা ঘটে।

 

উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সাদিয়া সুলতানা গণমাধ্যমকর্মীদের জানান, ওই কলেজছাত্রীকে নানাভাবে উত্ত্যক্ত করছিল কলেজের ২ যুবক। এমন অভিযোগ শিক্ষদের কাছে করলে তাদের কলেজে আটক করে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে পেনাল কোড-১৮৬০ এর ৫০৯ ধারা মোতাবেক প্রত্যেককে ৫ হাজার টাকা করে মোট ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। পরে তাদের মুচলেকা রেখে অভিভাবকদের জিম্মায় ছেড়ে দেয়া হয়েছে বলে জানায় ভ্রাম্যমান আদালত।

 

জে জাহেদ, চট্টগ্রাম: চট্টগ্রাম কর্ণফুলী উপজেলার শিকলবাহা ইউনিয়নের একটি বিদ্যালয়ের ছাত্রীদের উত্ত্যক্ত করার অভিযোগে কাজল গত ২৮ মে শেখ নামে এক বখাটেকে ১৫ দিনের কারাদন্ড দিয়েছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। কর্ণফুলী উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট পিযুষ কুমার চৌধুরী এ আদেশ দেন।

 

ম্যাজিস্ট্রেট পিযুষ কুমার চৌধুরী বলেন, বেশ কিছুদিন ধরে উপজেলার শিকলবাহা ইউনিয়নের মহিউদ্দিন উচ্চবিদ্যালয়ের ছাত্রীদের আসা-যাওয়ার পথে অভিযুক্ত কাজল শেখসহ কয়েকজন বখাটে উত্ত্যক্ত করত। ২৮ মে স্কুলের কয়েকজন ছাত্রীকে উত্ত্যক্ত করার অভিযোগে তাকে আটক করে এ সাজা দেয়া হয় বলে সাংবদিকদের জানান ম্যাজিস্ট্রেট।

 

বিশেষজ্ঞরা জানান, সাধারণত কোনো নারী বা কিশোরীকে তার স্বাভাবিক চলাফেরা বা কাজকর্ম করা অবস্থায় অশালীন মন্তব্য করা, ভয় দেখানো, তার নাম ধরে ডাকা এবং চিৎকার করা, বিকৃত নামে ডাকা, কোনো কিছু ছুড়ে দেয়া, ব্যক্তিত্বে লাগে এমন মন্তব্য করা, যোগ্যতা নিয়ে টিটকারী করা, তাকে নিয়ে অহেতুক হাস্যরসের উদ্রেক করা, রাস্তায় হাঁটতে বাধা দেয়া, অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করা, ইঙ্গিতপূর্ণ ইশারা দেয়া, সিগারেটের ধোঁয়া গায়ে ছাড়া, উদ্দেশ্যমূলকভাবে পিছু নেয়া, অশ্লীলভাবে প্রেম নিবেদন করা, উদ্দেশ্যমূলকভাবে গান-ছড়া বা কবিতা আবৃত্তি করা, চিঠি লেখা, পথ রোধ করে দাঁড়ানো, প্রেমে সাড়া না দিলে হুমকি প্রদান ইত্যাদি উত্ত্যক্তকরণের মধ্যে পড়ে।

 

‘নারীদের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট ও মানসিক স্বাস্থের প্রভাব’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে আঁচল ফাউন্ডেশন। বৈষম্য, যৌন হয়রানি ও নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির সম্মুখীন হয়েছেন এমন ১ হাজার ১৪ নারীর সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছে। জরিপে অংশ নেন সারা দেশের বিভিন্ন জেলা ও বিভাগের ১৮ থেকে ৩০ বছর বয়সি নারীরা।

 

গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের ৬৯.৯২ শতাংশ নারী শারীরিক গঠন নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্যের শিকার হচ্ছেন। ৩৭.২৪ শতাংশ নারীকে শরীরের গঠন নিয়ে আত্মীয়রা হেয় করেছে। বন্ধুর কাছে হেয় হয়েছে ২২ শতাংশ।

 

এমনকি পরিবার থেকে এ ধরনের মন্তব্য শুনেছেন বলে জানায় ১৪.২৫ শতাংশ। শারীরিক গঠন নিয়ে পথচারীর কাছ থেকে নেতিবাচক কথা শুনেছেন ১১.৮৫ শতাংশ নারী। ওজনের কারণে নেতিবাচক মন্তব্যের শিকার হতে হয় বলে ৩৯.৪৯ শতাংশ নারী মনে করেন।

 

গায়ের রঙের কারণেও ৩৬.৯৫ শতাংশ নারী এ ধরনের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যান। এছাড়া উচ্চতা, মুখাবয়বের গঠন, কণ্ঠস্বর প্রভৃতি বিষয় নিয়ে নারীরা বিরূপ মন্তব্য শুনে থাকেন। ২৩.৭৭ শতাংশ নারী সম্মতি ছাড়াই পরিবার থেকে বিয়ের চাপের সম্মুখীন হয়েছেন বলে জরিপে উঠে এসেছে। ৬৫.৫৮ শতাংশ নারী যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন বলে জরিপে জানা গেছে। এর মধ্যে ৩৫.৪৯ শতাংশ নারী বিকৃত যৌন ইচ্ছার প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত বা কুদৃষ্টির শিকার হয়েছেন। ২৯.৬২ শতাংশ নারীকে আপত্তিকর স্পর্শের ভুক্তভোগী হতে হয়েছে। আর বিভিন্ন জায়গায় ইভ টিজিংয়ের শিকার হয়েছেন ২২.২৬ শতাংশ। গণপরিবহনে ৪৫.২৭ শতাংশ নারী যৌন হয়রানির শিকার হন বলে জরিপে উঠে এসেছে।

 

জরিপ অনুযায়ী, অনলাইনে বিড়ম্বনার শিকার হন ৪৩.৮৯ শতাংশ নারী। এর মধ্যে কুরুচিপূর্ণ মেসেজ পাঠিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলা হয়েছে ৬১.১২ শতাংশকে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের আইডি হ্যাকিংয়ের শিকার হয়েছে ১০.৩৪ শতাংশ। ৯.৮৯ শতাংশ ব্যক্তিগত ও সংবেদনশীল ছবি নিয়ে দুর্ভোগ পোহান বলে আঁচল ফাউন্ডেশনের গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

 

নারী উত্ত্যক্তকরণ ঘটনা: নারী উত্ত্যক্তকরণ ঘটনার শেষ নেই। প্রতি মুহূর্তে দেশের কোথাও না কোথাও ভিন্ন ভিন্ন কৌশলে নারী উত্ত্যক্তকরণের ঘটনা ঘটছে। দেশব্যাপী জোরালো সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে পারলে দেশে নারী উত্ত্যক্তের মাত্রা কমিয়ে আনা সম্ভব বলে গবেষণা প্রতিবেদনে বেরিয়ে এসেছে।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version