ইমরান খান: রাজধানী ও এর আশপাশের এলাকা ঘিরে যানজট নিরসনের লক্ষ্যে ২০১৭ সালে ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের প্রকল্পটি অনুমোদন করেছিল সরকার। মূল প্রকল্পের ব্যয় ধরা ছিল ১৬ হাজার ৯০১ কোটি ৩২ লাখ টাকা। যার মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি অর্থ ঋণ দেয়ার কথা বলেছিল চীন। যার অঙ্ক ছিল ১০ হাজার ৯৪৯ কোটি টাকা। প্রকল্পের ব্যয় বেড়েছে। বেড়েছে মেয়াদও।
তবে এক্ষেত্রে চীনের ঋণ আর বাড়ছে না। মেয়াদ ও ব্যয় বাড়ানো হলেও এখনো পর্যন্ত নকশা প্রণয়ন হয়নি এ প্রকল্পের। কর্তৃপক্ষের দাবি, চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ঋণসংক্রান্ত জটিলতার কারণেই প্রকল্পে এই ধীরগতি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জনগুরুত্বপূর্ণ এই মেগা প্রকল্পের নির্দিষ্ট সময়সীমা শেষে বাড়তি মেয়াদে শুরু হয়েছে নির্মাণ কাজ। এর আগে প্রথম মেয়াদে পাঁচ বছরে কাজ শুরুই হয়নি। সরকার ২০১৭ সালের অক্টোবরে ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পটি অনুমোদন করেছিল। ২৪ কিলোমিটার এক্সপ্রেসওয়ের কাজ শেষ করার কথা ছিল ২০২২ সালের জুনের শেষের দিকে।
কিন্তু তারপরেই মেয়াদ বাড়ানো হয় চার বছর। মেয়াদ বাড়ানোর পর গেল বছরের নভেম্বরে নির্মাণ কাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হলেও এখনো নকশা প্রণয়ন হয়নি এই মেগা প্রকল্পের।
সূত্র বলছে, ঢাকা-আশুলিয়া চার লেনের ২৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ প্রকল্পটি বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে জিটুজি ভিত্তিতে চুক্তি হয়। প্রকল্পটির পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে ছিল চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট-এক্সপোর্ট করপোরেশন (সিএমসি)।
চুক্তি অনুযায়ী, ২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে প্রকল্পটির কাজ দেয়া হয়েছিল চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট করপোরেশনকে (সিএমসি)। এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের জন্য বাজেট ছিল ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার। শর্ত ছিল মোট প্রকল্প ব্যয়ের ৮৫ শতাংশের টাকা দেবে চীন সরকার এবং ১৫ ভাগ ফান্ড থাকবে বাংলাদেশ সরকারের এক্সিম ব্যাংক থেকে।
জানা গেছে, চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিএমসিকে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে প্রথম কিস্তি বাবদ ৩২.৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পরিশোধ করেছিল বাংলাদেশ সরকার, যা প্রকল্প ব্যয়ের ১৫ শতাংশ। আর অক্টোবরে বাকি ৮৫ শতাংশ ১৭০.৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পরিশোধ করেছিল চীন সরকার। ঋণ চুক্তির জটিলতা নিরসনের পর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান প্রকল্পের মূল নকশা তৈরি করতে যৌথভাবে দুই কোম্পানিকে নিয়োগ দেয়া হয়।
ডিজাইন রিভিউ এবং সুপারভিশন কনসালট্যান্টস হিসেবে নকশা রিভিউ এবং নির্মাণ কাজ তদারকির জন্য পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ এবং পরামর্শক প্রতিষ্ঠান স্পেনের টেকনিকা ওয়াই প্রয়োকটস ও দক্ষিণ কোরিয়ার ডিওএইচডব্লিউএ এবং বাংলাদেশের ডিডিসির মধ্যে। ২০২৩ সালের ১৩ এপ্রিল সিএমসিকে চিঠি দেয় ঢাকা আশুলিয়া মহাসড়কের কাজে নিয়োজিত পরামর্শক প্রতিষ্ঠান টিপসা। যার অনুলিপি দেয়া হয় বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষকে (বিবিএ)-কে।
সিএমসি ও বিবিএতে পাঠানো তত্ত্বাবধানে কোম্পানির চিঠিতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বেশকিছু সীমাবদ্ধতার অভিযোগ করে। বিশেষ করে, ভূমি অধিগ্রহণে জটিলতা ও ড্রয়িংয়ে অগ্রাধিকারের বিষয়ে জোর দেয়া হয়। বলা হয়, ভূমি অধিগ্রহণে জটিলতা ও ড্রয়িংয়ে অগ্রাধিকার নিশ্চিত হলে ১ ও ৩ ধারায় ঠিকাদার কাজ শুরু করতে পারতেন। বর্তমানে ডিজাইনের অভাবে এটা সম্ভব হচ্ছে না।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকল্পের ধীরগতির কারণে কাজের ব্যয় বৃদ্ধি পাবে। যদিও তারা বাংলাদেশ সরকারের টাকার অবমূল্যায়নকে দুষছেন। এই প্রকল্পের জন্য সিএমসিকে নির্বাচন করা হলেও তারা আরো তিন জন চীনা সাব-কন্ট্রাক্টরকে পুরো প্রকল্পটি সাবকন্ট্রাক্ট করেছে, যা চুক্তিবর্হিভূত।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চুক্তিতে স্বাক্ষর করার এবং পেমেন্ট পাওয়ার পাঁচ বছরেরও বেশি সময় পরে সিএমসির উচিত অন্তত প্রকল্পের নকশা প্রণয়ন করা। যেহেতু এই প্রকল্পটি চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে একটি জিটুজি প্রকল্প। সেক্ষেত্রে চীনারা সিএমসি তার প্রতিশ্রুতি পূরণ করে তা নিশ্চিত করতে সরকারের উচিত সিএমসিকে পর্যবেক্ষণ করা। একই সঙ্গে সময়সীমার বিষয়টি বিবিএর শুরু থেকেই খুব কঠোরভাবে নজর রাখা ও সিএমসি কর্মকর্তাদের দ্বারা পরিচালিত হতে না দেয়ার বিষয়ে আরো সতর্ক হওয়া উচিত ছিল।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক শাহাবুদ্দিন খান ভোরের আকাশকে বলেন, এটা একটা বড় কাজ। প্রজেক্ট এরিয়াও অনেক বড়। পুরো প্রকল্পের এলাকাজুড়ে শ্রমিকদের বাড়িঘর বানানো ও নির্মাণসামগ্রী বসাতে একটু সময় লাগে। মূল কাজ শুরু হয়েছে জানুয়ারি থেকে। ৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। নকশা প্রণয়নের কাজটা আমাদের না। সেটা ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব। তবে আমাদের জানামতে নকশা প্রণয়নের কাজ চলছে। ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় প্রকল্পের খরচ ৬৫১ কোটি টাকা বেড়েছে বলেও জানান তিনি।
জনগুরুত্বপূর্ণ এই প্রকল্পটি হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরকে নবীনগর-চন্দ্রা মহাসড়কের আবদুল্লাহপুর, আশুলিয়া, বাইপাইল এবং ঢাকা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের সঙ্গে সংযুক্ত করবে।
এতে ৩০ জেলার মানুষ দ্রুত ও সহজে রাজধানীতে যাতায়াত করতে পারবে। প্রকল্পের আওতায় ১০.৮৩ কিলোমিটার র্যাম্প, ১.৯৫ কিলোমিটার দুটি দীর্ঘ ফ্লাইওভার, ১৪.২৮ কিলোমিটার চার লেনের রাস্তা এবং এক্সপ্রেসওয়ের উভয় পাশে ১৮ কিলোমিটার ড্রেন নির্মাণ করা হবে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প কর্মকর্তারা।
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য