-->
শিরোনাম

বড় ভূমিকম্পের ইঙ্গিত

শাহীন রহমান
বড় ভূমিকম্পের ইঙ্গিত

শাহীন রহমান: রাজধানী ঢাকা এবং দেশের বিভিন্ন এলাকায় শুক্রবার ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। এদিন সকালে ১০টা ৪৬ মিনিট ১৫ সেকেন্ডে এ ভূমিকম্প অনুভূত হয়।

 

আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে রাজধানী ঢাকা থেকে ২০২ কিলোমিটার উত্তর-পূর্ব দিকে এ ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল। রিখটার স্কেলে এ ভূমিকম্প ছিল ৪.৫ মাত্রার।

 

তবে যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা বা ইউএস জিওলজিক্যাল সার্ভের তথ্যানুযায়ী, শুক্রবার সকাল ১০টা ৪৬ মিনিটে এ ভূমিকম্প অনুভূত হয়। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৫। ভূমিকম্পের উপকেন্দ্র ছিল সিলেট শহর থেকে ২৩.৮ কিলোমটার দক্ষিণ-পূর্বে, মৌলভীবাজার থেকে ৪০ কিলোমিটার উত্তরপূর্বে, ভারতের আসামের করিমগঞ্জ থেকে ৩৪.৩ কিলোমিটার পশ্চিম দক্ষিণ-পশ্চিমে। ভূমিকম্পটির উৎপত্তিস্থল ছিল ভূপৃষ্ঠের ১০ কিলোমিটার গভীরে।

 

আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভূকম্পন পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের সহকারী আবহাওয়াবিদ মিজানুর রহমান জানান, সিলেটের গোলাপগঞ্জ এলাকার কাছাকাছি এ ভূমিকম্পের উৎপত্তি হয়। প্রাথমিকভাবে কোনো ধরনের ক্ষয়ক্ষতির তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে দেশের অভ্যন্তর থেকে ঘনঘন ভূমিকম্পের উৎপত্তি উদ্বেগ বাড়িয়ে দিচ্ছে।

 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগের উৎপত্তি হওয়া বেশিরভাগ ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল ছিল দেশের বাইরে। কিন্তু সম্প্রতি সময়ে দেশের অভ্যন্তর থেকে ভূমিকম্পের উৎপত্তি বড় ধরনের আশঙ্কা তৈরি করছে। তাদের মতে এ ধরনের ভূমিকম্প ইঙ্গিত দিচ্ছে আগামীতে বড় ধরনের ভূমিকম্প ঝুঁকিতে রয়েছে দেশ।

 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুক্রবারের যেখান থেকে ছোট মাত্রার ভূমিকম্পের উৎপত্তি হয়েছে ১৯১৮ ঠিক এর কাছাকাছি একটি বড় ভূমিকম্প উৎপত্তি হয়। রিখটার স্কেলে যার মাত্রা ছিল ছিল ৭.৬। শ্রীমঙ্গল ভূমিকম্প নামে পরিচিত ভূমিকম্পটি রশিদপুর চ্যুতিতে সংঘটিত হয়েছিল। ভূতাত্ত্বিক ভাবে সক্রিয় অঞ্চলে ছোট ছোট ভূমিকম্প হওয়ার অর্থ এখানকার ভূ-অভ্যন্তরে শক্তি সঞ্চিত হচ্ছে।

 

এর বহিঃপ্রকাশ ঘটছে মাঝেমধ্যে। তবে ভূ-অভ্যন্তরস্থল প্রবল শক্তি সঞ্চয় করে আছে। ভূতাত্তিকভাবে সক্রিয় এ প্লেট বাউন্ডারি ও চ্যুতি অঞ্চলের ছোটখাটো ভূমিকম্প ইঙ্গিত দেয়, আরো কোনো বড় ভূমিকম্প আসতে পারে। শুক্রবার সকালে দেশের পাশাপাশি সীমান্তের অপর পাশে ভারতেও ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। তবে রাজধানীতে ঢাকাতে বড় ধরনের ঝাঁকুনি সৃষ্টি না করলেও সিলেট শহরে ভূমিকম্পের ঝাঁকুনি ছিল আঁতকে ওঠার মতো। এ ভূমিকম্প ৮ থেকে ১০ সেকেন্ড স্থায়ী হয়েছে। এ সময় আতঙ্কে বিভিন্ন বহুতল ভবন থেকে বাসিন্দারা রাস্তায় নেমে আসেন। ভূমিকম্পের সময় বাইরে প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছিল। এ অবস্থাতেই অনেকে ভবন থেকে রাস্তায় নেমে আসেন। সিলেটের লোকজন এতে আতঙ্কিত হলেও এ ভূমিকম্পে কোনো ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি।

 

এর আগে গত ৫ মে ঢাকায় সর্বশেষ ভূমিকম্প হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্তিক জরিপ সংস্থা ইউএসজিএস এর হিসেব অনুযায়ী তখন ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৪.৩।

 

আমেরিকান সংস্থাটির তথ্যানুযায়ী, ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকার কাছে বিক্রমপুরের দোহার থেকে প্রায় ১৪ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে। এ ভূমিকম্পের কেন্দ্র ছিল ভূপৃষ্ঠ থেকে ১০ কিলোমিটার গভীরে। বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলকে এমনিতেই ভূমিকম্প প্রবণ অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করেন বিজ্ঞানিরা।

 

ভূতত্ত বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের সিলেট থেকে চট্টগ্রাম অঞ্চলে কয়েকটি প্লেট থাকার কারণে এসব এলাকা ভূমিকম্পের বড় ঝুঁকিতে রয়েছে। সুনামগঞ্জ, জাফলং অংশে ডাউকি ফল্টের পূর্বপ্রান্তেও ভূমিকম্পের ঝুঁকি রয়েছে বলে বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন। এসব ফল্টে ভূমিকম্প হলে ঢাকাসহ সারা বাংলাদেশে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা বা বিপদের মাত্রা অনেক বেশি বলে আশঙ্কা করছেন বিজ্ঞানীরা।

 

তারা বলছেন শুক্রবার সকালে ভূমিকম্পের এ উৎপত্তিস্থলের এলাকা দেশের সবচেয়ে ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চল হিসেবে পরিচিত। ১৫০ বছরের বেশি সময় ধরে বড় বড় ভূমিকম্পের ইতিহাস আছে।

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজাস্টার সায়েন্স অ্যান্ড ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্স বিভাগের অধ্যাপক এএসএম মাকসুদ কামাল বলেন, এ অঞ্চলে বারবার ছোটমাত্রার ভূমিকম্প সংঘটিত হয়ে আসছে। এ এলাকা ভারত-বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চল। অর্ধশতাব্দী পরপর এ অঞ্চলে বড় ভূমিকম্প আঘাত হানে। যেমন ১৮৬৯, ১৮৯৭, ১৯১৮, ১৯৫০ সালে এ সক্রিয় ভূতাত্তিক প্লেট অঞ্চলে বড় বড় ভূমিকম্প সংঘটিত হয়েছিল। এ ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চল ‘আসাম সিনটেকসিস’ নামে পরিচিত। এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে আঘাত হানা তুরস্কের ভূমিকম্পটি অনুরূপ সক্রিয় ভূতাত্তিক অঞ্চলে সংঘটিত হয়েছিল।

 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিলেটের এ সীমান্তসংলগ্ন অঞ্চলে তিনটি টেকটোনিক সংযোগস্থল। এ কারণে আশেপাশে একাধিক ভূচ্যুতি বা ফাটল রেখা রয়েছে। তারা বলেন দেশের অভ্যন্তরে যেসব ফাটল রেরখা রয়েছে তার মধ্যে সিলেট সীমানায় আবস্থিত ডাউকি ফল্ট অধিক সক্রিয় অবস্থায় রয়েছে। এ ডাউকি ফল্টে এর আগে ১৮৯৭ সালে ভয়াবহ ভূকিম্পের উৎপত্তির রেকর্ড রয়েছে।

 

তারা বলেন, ডাউকি চ্যুতি খুব বড়। এটি পূর্ব-পশ্চিমে ৩০০ কিলোমিটার বিন্তৃত। ডাউকি ফল্টের কারণে রাজধানী ঢাকাও বড় ধরনের ভূমিকম্প ঝুঁকিতে রয়েছে। এখান থেকে ১৮৯৭ বড় ধরনের ভূমিকম্পের ফলে মেঘালয় এলাকা একেবারে পুরো ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৮.৩।

 

কিন্তু রাজধানী ঢাকা সেই উৎপত্তিস্থল থেকে ছিল প্রায় ২৩০ কিলোমিটার দূরে। সেই ভূমিকম্পে ঢাকায় ৭ থেকে ৮ তীব্রতার বেশি ভূকম্পন অনুভূত হয়েছে।

 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিলেটের এ এলাকায় থেকে বড় ধরনের ভূমিকম্প উৎপত্তি হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। ৭ থেকে ৮ মাত্রা ভূমিকম্প হলেও এর সরাসরি প্রভাব পড়বে রাজধানী ঢাকায়। তারা বলছেন ঢাকা থেকে ২০০ থেকে ৩০০ কিলোমিটার দূরে সংঘটিত হলেও ঢাকার ভূগাঠনিক অবস্থা, বিস্তৃত অঞ্চলে নরম মাটি ও দুর্বল অবকাঠামো হওয়ার কারণে ক্ষয়ক্ষতি আরো বেড়ে যাবে।

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আকতার বলছেন, উত্তরে তিব্বত সাব-প্লেট, ইন্ডিয়ান প্লেট এবং দক্ষিণে বার্মা সাব-প্লেটের সংযোগস্থলে বাংলাদেশের অবস্থান। ফলে সিলেট-সুনামগঞ্জ হয়ে, কিশোরগঞ্জ চট্টগ্রাম হয়ে একেবারে দক্ষিণ সুমাত্রা পর্যন্ত চলে গেছে।

 

তিনি বলেন, ইন্ডিয়া প্লেট পূর্ব দিকে বার্মা প্লেটের নীচে তলিয়ে যাচ্ছে আর বার্মা প্লেট পশ্চিম দিকে অগ্রসর হচ্ছে। ফলে সেখানে যে পরিমাণ শক্তি জমা হচ্ছে, তাতে আট মাত্রার অধিক ভূমিকম্প হতে পারে। এটা যেমন একবারে হতে পারে, আবার কয়েকবারেও হতে পারে। তবে যেকোনো সময় বড় ধরনের ভূমিকম্প হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন। সাধারণত এ ধরনের ক্ষেত্রে ৭ বা ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হয়ে থাকে।

 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন সুনামগঞ্জ, জাফলং অংশে ডাউকি ফল্টের পূর্বপ্রান্তেও ভূমিকম্পের ঝুঁকি রয়েছে। এসব ফল্টে ভূমিকম্প হলে ঢাকাসহ সারা দেশে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা বা বিপদের মাত্রা অনেক বেশি হবে।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version