-->
বিশ্ব শরণার্থী দিবস আজ

পাইলট প্রকল্পেই আটকে আছে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন

নিখিল মানখিন
পাইলট প্রকল্পেই আটকে আছে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন

নিখিল মানখিন: বিশ্ব ভূ-রাজনীতির থাবায় পড়েছে মিয়ানমার থেকে আসা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের ‘ প্রত্যাবাসন’ উদ্যোগ। রোহিঙ্গাদের নিজ দেশ মিয়ানমারে মর্যাদাপূর্ণ স্থায়ী প্রত্যাবাসনের মধ্যেই এই সংকটের সমাধান বলে মনে করছে বাংলাদেশ। জাতিসংঘসহ বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলোর সহযোগিতা আদায়ে বর্তমান সরকারের ক‚টনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে।

 

চীনের মধ্যস্থতায় রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য একটি পাইলট প্রকল্প নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার। কিন্তু গত ৮ জুন জেনেভা থেকে মিয়ানমার বিষয়ক বিশেষ র‌্যাপোর্টিয়ার টম এন্ড্রুস ওই পাইলট প্রকল্প অবিলম্বে স্থগিত করার জন্য আহব্বান জানিয়েছেন। গোটা বিষয়টি বাংলাদেশ সরকার গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে।

 

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের আগমন শুরু ১৯৭৮ সালে। এরপর থেকে কারণে-অকারণে দলে দলে অনুপ্রবেশ করে রোহিঙ্গারা।

 

সর্বশেষ ২০১৬ সালের ৯ অক্টোবর ও ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর থেকে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের আগমন ঘটে বানের স্রোতের মতো। রাখাইনে সহিংস ঘটনায় প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে আসে সাড়ে ৭ লাখ রোহিঙ্গা। নতুন-পুরাতন মিলিয়ে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বর্তমানে কক্সবাজারের উখিয়া, টেকনাফের ৩৩টি ক্যাম্প ও ভাসানচরে আছে।

 

নৃবিজ্ঞানী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. রাহমান নাসির উদ্দিন ভোরের আকাশকে বলেন, বাংলাদেশ রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের জন্য শুরু থেকেই প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার ওপর জোর দিয়ে আসছে। তারই ধারাবাহিকতায় ২০১৭ সালের নভেম্বরের ২৩ তারিখ বাংলাদেশ-মিয়ানমারের মধ্যে একটা প্রত্যাবাসন চুক্তি হয়।

 

২০১৭ সালের ডিসেম্বরের ১৯ তারিখ একটা টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে একটা ‘ফিজিক্যাল অ্যারেঞ্জমেন্ট’ চুক্তি হয়, যার শর্ত অনুযায়ী প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর থেকে দুই বছরের মধ্যে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হবে। তার ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সালের ১৫ নভেম্বরের এবং ২০১৯ সালের ২২ আগস্ট দুই দফা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করার সব ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করা হলেও সেটা ব্যর্থ হয়, কারণ রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরে যেতে রাজি হয়নি।

 

অধ্যাপক ড. রাহমান নাসির উদ্দিন বলেন, সেনা অভ্যুত্থানের কারণে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাবে বলে মনে হয় না। কারণ সু চির সরকার রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া নিয়ে যেভাবে এগোচ্ছিল এবং বাংলাদেশের সঙ্গে যে চুক্তি করেছিল তাতে সামরিক বাহিনীর সমর্থন ছিল।

 

রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরতে রাজি না হওয়ার কারণ হচ্ছে, মিয়ানমার তাদের কোথায় নিয়ে যাবে, তাদের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেয়া হবে কিনা, তাদের জীবনের নিরাপত্তা দেয়া হবে কিনা, তাদের মানবিক মর্যাদা দেয়া হবে কিনা, তাদের ফেলে আসা বসতভিটা ফেরত দেয়া হবে কিনা তার কোনো বিশ্বাসযোগ্য আশ্বাস তারা দেশটির পক্ষ থেকে পায়নি। ফলে প্রথম এবং দ্বিতীয় দফা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া ব্যর্থ হয়।

 

২০২০ সালে করোনাভাইরাসের প্রকোপের কারণে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া প্রায় বন্ধ ছিল কিন্তু ২০২১ সালের জানুয়ারির ১৯ তারিখ চীনের দূতিয়ালিতে আবার প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করার জন্য বাংলাদেশের ও মিয়ানমারের পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু হঠাৎ করে মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের কারণে এ প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাবে কিনা, তা নিয়ে একটা শঙ্কা ও সংশয় তৈরি হয়েছে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে সু চির সরকারও তেমন কিছু করেনি।

 

কিছু চুক্তি, কয়েকবার বৈঠক, দ্বিপক্ষীয় সফর এবং প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করার ‘নাটক’ করা ছাড়া প্রত্যাবাসন ইস্যুতে তেমন উল্লেখযোগ্য এবং কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি মিয়ানমার। এখন বাংলাদেশের কাজ হবে মিয়ানমারের সঙ্গে চলমান প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া সক্রিয় রাখা এবং সেটাকে বেগবান করা বলে জানান অধ্যাপক ড. রাহমান নাসির উদ্দিন।

 

পাইলট প্রকল্প স্থগিতের আহবান জাতিসংঘের: গত ৮ জুন জেনেভা থেকে মিয়ানমারবিষয়ক বিশেষ র‌্যাপোর্টিয়ার টম এন্ড্রুস ওই পাইলট প্রকল্প অবিলম্বে স্থগিত করার জন্য আহব্বান জানিয়েছেন।

 

বিশেষ র‌্যাপোর্টিয়ার টম জানান, রোহিঙ্গারা ফেরত গেলে তাদের জীবন ও স্বাধীনতা ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। বিভিন্ন রিপোর্টের ভিত্তিতে তিনি অভিযোগ করেন, ‘বাংলাদেশ প্রতারণামূলক ও বলপূর্বক পদ্ধতির মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে চাইছে।’

 

তার দাবি, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ফেরত যাওয়ার মতো পরিবেশ বিরাজ করছে না। যারা এর বিরোধিতা করছে, বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষ রোহিঙ্গাদের গ্রেপ্তার, দলিলপত্র ছিনিয়ে নেয়ার ভীতি এবং অন্যান্য ভয় দেখাচ্ছে বলে অভিযোগ করেন বিশেষ র‌্যাপোর্টিয়ার টম এন্ড্রুস।

 

এদিকে, পাইলট প্রকল্পের অধীনে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিরোধিতা করার কোনো কারণ দেখছেন না পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম।

 

গত ১১ জুন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, এটি একটি ট্রায়াল এবং এর মাধ্যমে খুব ছোট আকারে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য রোহিঙ্গাদের রাখাইনে পাঠানো হবে। সেখানে অস্বস্তিবোধ করলে তাদের ফিরিয়ে নিয়ে আসার সুযোগ রয়েছে।

 

প্রতিমন্ত্রী বলেন, রোহিঙ্গারা স্বেচ্ছায় যাচ্ছেন। এটি দেখার জন্য জাতিসংঘের সঙ্গে যে প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা হয়েছে, সেটি বলবৎ আছে। তবে জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার সার্টিফিকেট নিয়ে রোহিঙ্গাদের যেতে হবে এ ধরনের কোনো চুক্তি করা হয়নি। কিন্তু আমাদের প্রচেষ্টা সম্পর্কে তাদের জানানো হয়েছে। তাদের আমরা অবহিত রেখেছি বলে জানান প্রতিমন্ত্রী।

 

প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘তিনি মিয়ানমারবিষয়ক র‌্যাপোর্টিয়ার। তার কার্যক্রম মিয়ানমারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা উচিত। কিন্তু তিনি যেন পরিস্থিতি আরো ভালোমতো বুঝতে পারেন, সেজন্য আমরা তাকে বাংলাদেশে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। তিনি কক্সবাজার ঘুরে গেছেন। কিন্তু যে বিষয়গুলো তিনি বলেছেন এবং যে ভাষায় বলেছেন, এটি আমাদের প্রচেষ্টাকে খাটো এবং অসম্মান প্রকাশ করে। আমরা বিষয়টি জাতিসংঘকে জানাব।

 

এদিকে, দ্রুত মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন শুরু করার দাবিতে সমাবেশ করেছেন উখিয়া-টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্পে বসবাসরত রোহিঙ্গারা। গত ৮ জুন সকাল ১০টার দিকে ১৩টি ক্যাম্পে রোহিঙ্গারা এ কর্মসূচির আয়োজন করেন।

 

সমাবেশে রোহিঙ্গা কমিউনিটি নেতারা বলেন, মিয়ানমারে নির্যাতন-নিপীড়ন, হত্যা, ধর্ষণ চলাকালীন সময়ে প্রাণের ভয়ে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছি। বাংলাদেশ সরকার মানবিক কারণে আশ্রয় দিয়েছে। যার জন্য রোহিঙ্গারা কৃতজ্ঞ। এখানে ছয় বছর ধরে ক্যাম্পে বন্দি জীবনযাপন করছি। আমরা দ্রুত মিয়ানমারে নিজ ভিটায় ফিরতে চাই বলে জানান রোহিঙ্গা কমিউনিটি নেতারা। রোহিঙ্গারা ‘খুবই’ হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে : মন্ত্রিসভা কমিটি

 

মন্ত্রী মোজাম্মেল হকের ভাষায়, রোহিঙ্গারা নানা অপরাধে লিপ্ত হলেও মানবিক কারণে তাদের ওপর কঠোর হওয়া যাচ্ছে না। আবার দেশের আইনে এই বিদেশিদের বিচারও করা যাচ্ছে না। বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের আইনশৃঙ্খলার জন্য বড় হুমকি হিসেবে দেখছে এ সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি।

 

গত ১৩ জুন সচিবালয়ে আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে রোহিঙ্গাদের নিয়ে আলোচনা ওঠে। এদিনই উখিয়ায় শরণার্থী শিবিরে নিজেদের মধ্যে গোলাগুলিতে একজন রোহিঙ্গা নিহত হন।

 

কমিটির সভাপতি আ ক ম মোজাম্মেল হকের ভাষায়, রোহিঙ্গারা নানা অপরাধ কর্মকান্ডে লিপ্ত হলেও মানবিক কারণে তাদের ওপর কঠোর হওয়া যাচ্ছে না। আবার দেশের আইনে এই বিদেশিদের বিচারও করা যাচ্ছে না।

 

মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রী মোজাম্মেল হক বলেন, আমাদের জন্য দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার, মিয়ানমার থেকে যেসব রোহিঙ্গা এসে এদেশে আশ্রয় নিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী সদয় হয়ে আশ্রয় দিয়েছেন, তারা আইনশৃঙ্খলার প্রতি খুবই হুমকিস্বরূপ আর কি। নিজেরা আইনশৃঙ্খলা মানতে চায় না। তাদের জন্য ভাসানচরে থাকার ব্যবস্থা হয়েছে সেখানে যে সুব্যবস্থা আছে, সেখানেও তারা যাচ্ছে না।

 

কমিটি রোহিঙ্গাদের নিয়ে উদ্বিগ্ন জানিয়ে তিনি বলেন, সেখানে মাদক, নাশকতা ইত্যাদি বন্ধ করা যাচ্ছে না। আমরা ওদেরকে আইডি কার্ড না দিলেও ওরা যেভাবেই হোক সিম কার্ড এনে ব্যবহার করে। আমাদের দেশ থেকে পাচ্ছে না, কিন্তু মিয়ানমার থেকে সিম কার্ড এনে সেগুলো ব্যবহার করে। তারা অত্যন্ত আনরুলি আপনারা দেখেছেন।

 

রোহিঙ্গাদের অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ার বিষয়টি তুলে তিনি বলেন, সেখানে বিভিন্ন স্থানীয় ক্রাইমের সঙ্গে, জাতীয় ক্রাইমের সঙ্গে নিজেদেরকে জড়িয়ে ফেলছে এবং নিজেদের মধ্যেও মারামারি, হানাহানি, মাদক ইত্যাদি নিয়ে যেভাবে আছে, মানবিক কারণে কিছু বলাও যায় না।

 

যেহেতু তারা আশ্রিত, আমাদের দেশের আইন দিয়ে তাদের গ্রেপ্তারও করা যায় না, বিচারও করা যায় না। কারণ তারা তো আমাদের দেশের নাগরিক না। তাদেরকে বিচার করা, গ্রেপ্তার করার দেশে কোনো আইন নেই। কিছু করাও যায় না আইনানুগভাবে।

 

প্রত্যাবাসন নিশ্চিতে সহায়তা বাড়ানোর আহব্বান: জোরপূর্বক বিতাড়িত মিয়ানমারের নাগরিক রোহিঙ্গাদের দ্রুত নিজ দেশে নিরাপদ, মর্যাদাপূর্ণ ও স্থায়ী প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সমর্থন ও সহায়তা বাড়ানোর আহব্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ।

 

গত ১১ জুন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণকারী মিয়ানমারের নাগরিকদের মানবিক সহায়তায় সাড়াদান সংক্রান্ত উচ্চপর্যায়ের এক সভায় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এ আহব্বান জানানো হয়। এই বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব তোফাজ্জল হোসেন মিয়া।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version