রুদ্র মিজান: ‘অরিজিনাল এ গ্রেডের মাল কিনতে নক করুন। আমরাই একমাত্র সততা এবং সফলতার সঙ্গে বহুদিন যাবৎ বিজনেস করে আসছি। ১ লাখ মাল নিলে মোট খরচ পড়বে ১৮ হাজার টাকা। আমাদের মাল স্বয়ংক্রিয়ভাবে সম্পূর্ণ অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ওপর নির্ভর করে, সুদক্ষ গ্রাফিক্স ডিজাইনার দ্বারা তৈরি; যা ইন্ডিয়া থেকে আমদানিকৃত, অত্যাধুনিক কাঁচামাল দিয়ে তৈরি।
নিরাপত্তা সুতা ও জলছাপ দ্বারা নিখুঁতভাবে তৈরিকৃত প্রতিটি নোট। লাগলে অর্ডার করতে ইনবক্সে নক করুন’, এভাবেই জাল টাকা বিক্রির জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিচ্ছে এর কারবারিরা। যেন ফেরিওয়ালাদের মতোই চিৎকার করে জানান দিচ্ছে, টাকা লাগবে টাকা...।
সরাসরি সাক্ষাৎ না করেই কুরিয়ার সার্ভিসে টাকা পৌঁছে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে তারা। ইতোমধ্যে জাল নোট তৈরির কারখানা ও জড়িত বিভিন্ন চক্রের সদস্যদের গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পবিত্র ঈদুল আজহাকে কেন্দ্র করে কয়েক মাস আগে থেকেই নকল টাকা তৈরিতে ব্যস্ত হয়েছে জড়িতরা।
দেশব্যাপী তাদের এজেন্টের কাছে টাকা পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, চলতি সপ্তাহ থেকে টার্গেট নিয়ে জাল টাকা ছড়িয়ে দিতে কাজ করবে জড়িতরা। দীর্ঘদিন থেকেই জাল টাকা শনাক্তে ব্যাংকগুলোকে নানা দিকনির্দেশনা দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। একইভাবে জাল টাকা প্রতিরোধে সক্রিয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তারপরও জাল টাকার ছড়াছড়ি বন্ধ হচ্ছে না। এমনকি ব্যাংকের বুথগুলোয় প্রায়ই পাওয়া যাচ্ছে জাল টাকা।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গত ২০ বছরে সারা দেশে জাল টাকার কারবারিদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ১২ হাজর ৫১২টি। এর মধ্যে ৭ হাজার ১১২টি মামলা বিচারাধীন। এখনো ৫ হাজার ৪০০ মামলার তদন্ত চলছে। কোনো কোনো মামলার তদন্ত শেষ পর্যায়ে রয়েছে। তদন্তসংশ্লিষ্টরা জানান, এসব মামলার সাক্ষীদের পাওয়া যাচ্ছে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাদীদেরও হদিস মেলে না। জামিন নিয়ে আসামিরা লাপাত্তা হয়ে যাচ্ছে।
রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে দেশের বিভিন্ন এলাকায় তৈরি হচ্ছে জাল টাকা। কারখানা শনাক্ত হওয়ার পরই এসব তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। ইউটিউবে এ-সংক্রান্ত কনটেন্ট দেখে অনেকেই আয়ত্তে করছেন জাল টাকা তৈরির কাজ।
টিস্যু পেপার, প্রিন্টার, ল্যাপটপ ও প্রিন্টারের কালি ব্যবহার করেই তৈরি করা হচ্ছে চকচকে নোট। ১৮ থেকে ২৫ হাজার টাকায় কেনা যায় জাল ১ লাখ টাকা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আর কম মূল্যে জাল টাকা বিক্রি করে চক্রের সদস্যরা। সাধারণত ২০ থেকে ৩০ বছর বয়সি বিপথগামীরা রাতারাতি বিত্তশালী হওয়ার জন্য এ অপকর্ম করে থাকে।
গোয়েন্দারা জানান, দেশব্যাপী জাল টাকা তৈরির অন্তত অর্ধশত চক্র রয়েছে। এসব চক্রের সদস্যরা সর্বত্র ছড়িয়ে রয়েছে। ঈদুল আজহাকে কেন্দ্র করে প্রতিটি চক্র কোটি কোটি টাকা বাণিজ্যের টার্গেট নিয়ে মাঠে নেমেছে। ইতোমধ্যে অনেকেই গ্রেপ্তার হয়েছেন। বাকিদের শনাক্তে কাজ করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। গত ২৪ মে ঢাকার অদূরে সাভারের সাদাপুরের পুরানবাড়ী এলাকায় তিনজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
সেখানে পাওয়া গেছে জাল টাকা তৈরির কারখানা। আশপাশের লোকজন জানতেন এটি পোশাক কারখানা। নাম ‘সাউথ বেঙ্গল অ্যাপারেলস’। অভিযানকালে জাল টাকা তৈরির সরঞ্জামসহ ৫০ লাখ জাল টাকা জব্দ করে পুলিশ। পোশাক কারখানায় একসময় জিন্সের প্যান্ট তৈরি হতো। কাজ করতেন বিপুল শ্রমিক। করোনায় বিপর্যস্ত ব্যবসা। বন্ধ হয়ে যায় কারখানা। কারখানার বরিশালের মুলাদী উপজেলার ডিগ্রিরচর খানবাড়ীর মালিক সাখাওয়াত হোসেন খান এবার বিপথগামী হয়ে যান।
দেনা শোধ করতে টাকা তৈরির সরঞ্জাম কেনেন। গ্রাফিক্স ডিজাইনারকে দিয়ে নিখুঁতভাবে কাজ করে প্রিন্ট করেন। মুহূর্তেই তৈরি হয় ঝকঝকে টাকা। বিশ্বস্থ কয়েকজনকে নিয়ে কাপড় তৈরির কারখানায় তৈরি করেন জাল নোট। সেই জাল টাকা দিয়ে সাভার অন্দ মার্কেটে লিচু কিনতে যান সাখাওয়াত। সেখানে গিয়ে সাধারণ মানুষের হাতে ধরা পড়েন। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে তাকে আটক করে পুলিশ।
এ সময় তার কাছে ১৭ হাজার টাকার জাল নোট পাওয়া যায়। এতেই পুলিশের সন্দেহ হয় তিনি জাল নোট তৈরি চক্রের সদস্য। জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া যায় কারখানার তথ্য। তারপরই সেখানে অভিযান চালায় পুলিশ। এ ঘটনায় গ্রেপ্তার অন্যরা হলে মুলাদীর বয়াতিকান্দি গ্রামের নাজমুল হোসেন ও শরীয়তপুরের পালং থানার গয়াধর গ্রামের সুজন মিয়া।
ঈদুল আজহা সামনে রেখে ২ কোটি টাকার জাল নোট ছাপানোর মিশন হাতে নিয়েছিলেন ফরিদুল ইসলাম। ২১ বছর বয়সি এ তরুণকে গত ১০ মে গ্রেপ্তার করেছে সিরাজগঞ্জ জেলা পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)। জব্দ করা হয়েছে ৪ লাখ ৫৬ হাজার টাকার জাল নোট ও জাল টাকা ছাপানোর বিভিন্ন সরঞ্জাম। তিনি সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার মাটিকোড়া গ্রামের বাসিন্দা। এ সময় তার বাড়ি থেকে ৪ লাখ ৫৬ হাজার টাকার জাল নোট পাওয়া যায়।
জিজ্ঞাসাবাদে ফরিদুল ডিবি পুলিশকে তথ্য দিয়েছেন, গত দেড় বছর ধরে তিনি নিজেদের বাড়িতে জাল টাকা তৈরি করতেন। এসব টাকা সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, পাবনা, জামালপুরসহ বিভিন্ন জেলায় স্বল্পমূল্যে বিক্রি করতেন। ঈদুল আজহা উপলক্ষে তিনি ২ কোটি টাকার জাল নোট তৈরির মিশন নিয়ে কাজ করছিলেন।
গত ৯ এপ্রিল রাজধানীর ধলপুরের একটি বাড়িতে অভিযান চালিয়ে জাল নোট তৈরি ও বিক্রি চক্রের সন্ধান পায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। গ্রেপ্তার করা হয় চক্রের প্রধানসহ তিন সদস্যকে। ঈদ টার্গেট করে চক্রটির ৩ থেকে ৫ কোটি জাল টাকা বাজারে ছাড়ার পরিকল্পনা ছিল। তার আগে ২ জানুয়ারি রাজধানীর পল্লবীতে অভিযান চালিয়ে জাল নোট তৈরি চক্রের মূল হোতা ছগির হোসেনসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করে র্যাব।
এ সময় ১ কোটি ২০ লাখ টাকা সমমানের জাল নোট জব্দ করা হয়। গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য রয়েছে, এসব চক্রে বিপুল ছেলেমেয়েরা জড়িত রয়েছে। কয়েক ধাপে কাজ হয় জাল টাকা তৈরির। একটি শ্রেণি সরঞ্জাম আমদানি ও বিক্রি করে। এ শ্রেণির সঙ্গে প্রতিবেশী দেশের অপরাধীরাও জড়িত বলে তথ্য রয়েছে।
তার পরের ধাপে কাজ করেন কারিগররা। তারা সরাসরি জাল টাকা তৈরি করেন। সাধারণত কারিগর ও মালিক আড়ালে থাকেন। ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে কাজ করেন তারা। যে কারণে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তৃতীয় ধাপে যারা কাজ করেন অর্থাৎ এজেন্টের কাছে বিক্রি করেন এবং যারা বিভিন্ন হাটে, শপিংমলে জাল টাকা ছড়িয়ে দেন তারাই গ্রেপ্তার হন বেশি।
জাল টাকা বিক্রি চক্রের সদস্যরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও সক্রিয়। ফেসবুকে বিভিন্ন পেজ ও গ্রুপ খুলে জাল নোট সরবরাহের জন্য গ্রাহক সংগ্রহ করে তারা। এসব গ্রুপে যুক্ত হতে পারছেন যে কেউ। এমনকি ফেসবুকে কথাবার্তার পরে অনেককে যুক্ত করা হচ্ছে জাল নোট কারবারিদের বিভিন্ন এনক্রিপ্টেড অ্যাপসে। আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজর এড়াতে যোগাযোগের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে বিভিন্ন অ্যাপস।
এসব বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেসন্স বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার মো. ফারুক হোসেন বলেন, জাল নোট শনাক্তে গরুর হাটগুলোয় মেশিন থাকবে। সেইসঙ্গে সবাইকে এ বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে। জাল নোটের প্রভাব ঠেকাতে পুলিশ সক্রিয় রয়েছে। এ বিষয়ে ডিএমপির একাধিক ইউনিট অভিযান অব্যাহত রেখেছে বলে জানান তিনি।
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য