প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, নির্বাচন কমিশনের (ইসি) কোনো ক্ষমতা রহিত হয়নি বরং সংহত হয়েছে। অনেকেই অবান্তর মন্তব্য করেছে, ইসি নিজের পায়ে নিজেই কুঠার মেরেছে। নির্বাচন কমিশন ভুল করতে পারে কিন্তু কুঠার মারে নাই।
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধনী বিলটি সংসদ পাশ হয়ে রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরে গেজেট হওয়ার পর নির্বাচন ভবনে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরার সময় সোমবার এমন মন্তব্য করেন তিনি। প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ সময় আইনে ধারা ধরে ধরে ব্যাখ্যা করেন। এমনকি তারা কি প্রস্তাব দিয়েছিলেন এবং সরকার থেকে কি রাখা হয়েছে সেসবও বলেন।
কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, আমরা আমাদের প্রজ্ঞা অনুযায়ী আইন মন্ত্রণালয়ে আরপিও সংশোধনের প্রস্তাব পাঠিয়েছিলাম। সেখান থেকে অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে কেবিনেটে অনুমোদিত হয়। সেখানে সামান্য একটু পরিবর্তন উনারা করেননি, আমাদের মতামত চেয়েছিলেন। সেটা হলো ৯১এ(এ)-তে সামান্য পরিবর্তন ছিল। আমরা বলেছিলাম যেকোনো আসন এলাকায় অনিয়ম হলে বন্ধ করে দিতে।
উনারা বলেছিলেন, আমরা শুধু মাত্র যেখানে যে কেন্দ্রে নির্বাচন বাধাগ্রস্ত হবে সেগুলো বন্ধ করে দিতে। এটা আমাদের কাছে খুবই যৌক্তিক মনে হয়েছে। এটি কিন্তু সম্পূর্ণ একটি নতুন ধারা ছিল। যেটা ৯১ এর এ ধারা সেখানে কিন্তু আমরা পরিবর্তন করিনি। এবং সরকার বা সংসদ থেকেও কোনো রকম পরিবর্তন আনা হয়নি। সেদিক থেকে এই আইনটি বিল আকারে পাশ হয়েছিল। রোববার রাষ্ট্রপতির সম্মতির পর গেজেট হয়েছে। আপনাদের উদ্দেশ্যে বলার কারণ হচ্ছে বিভিন্ন মহল থেকে মন্তব্য এসেছে। এতে করে জনগণ বিভ্রান্ত হতে পারে। আমরা মনে করি যেসব ব্যাখ্যা এসেছে সবগুলো সঠিক নয়।
যেমন- প্রথম বলা হয়েছিল কমিশন বুঝে না বুঝে নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মেরেছে। এবং কমিশন গেজেট প্রকাশ হওয়ার পর নির্বাচন বাতিলের ক্ষমতা চেয়েছিল এবং ৯১(এ)-তে সংশোধন এসেছে। আসলে তা হয়নি। সেটা হুবহু আগের মতোই আছে। ৯১এ(এ)-তে নতুন একটি ধারা সংযোজিত হয়েছে। সরকার নিজের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার জন্য আরপিও সংশোধন করেছে, এমন মন্তব্যও এসেছে।
কিন্তু, সরকার আরপিও সংশোধন করে নাই। করেছে, তবে আমাদের প্রস্তাব অনুযায়ী। নির্বাচন কমিশন তার অবস্থান আরও সংহত, দৃঢ় ও শক্তিশালী করার জন্য যে সংশোধনগুলো চেয়েছিল সে সংশোধনগুলোয় সরকার সম্মত হয়েছে। এতে আমাদের ক্ষমতা বেড়েছে। ৯১(এ)-তে সংশোধন হতো তবে আমাদের ক্ষমতা কিছু হেরফের হতো। যেহেতু ওখানে কিছু করা হয়নি, উটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ধারা, যে পোলিং পিরিয়ডে আমরা যে একটি, দুটি বা সমস্ত আসনের নির্বাচন আমরা বাতিল করে দিতে পারি। সেটা হুবুহু আগের মতোই আছে।
তিনি বলেন, ৯১এ(এ) নতুন একটি ধারা সংযোজন করে আমরা যেটা চেয়েছিলাম নির্বাচন হওয়ার পরে গেজেট করার পর আর কোনো কাজ নির্বাচন কমিশনের হাতে থাকে না। সেখানে আমরা বলেছিলাম কোনো কোনো ক্ষেত্রে এমনও হতে পারে, সরকারি ফলাফল প্রকাশের পর বড় ধরণের কোনো বিতর্ক থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে কমিশন সেই বিষয়টি তদন্ত করতে পারবে, গেজেট স্থগিত রেখে।
সেই জায়গায়ে সরকার এবং সংসদ বলেছে সমস্ত আসনের নির্বাচন বাতিল না করে যেই কেন্দ্রে ফলাফল বাধাগ্রস্ত হয়েছে বলে মনে হবে, সেই সেই কেন্দ্রের ফলাফল স্থগিত করতে পারবে। আমরা নিজেরে পায়ে নিজে কুড়াল মারার বিষয়টিৃপাঁচ জনের একটা কমিশন, আমরা নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারা মতো কাজ করবো এটা অবান্তর একটা মন্তব্য। আমি এ বিষয়ে তেমন আর কিছু বলতে চাই নাই।
সিইসি আরও বলেন, সরকার নির্বাচনকে নিয়ন্ত্রণের জন্য আইন সংশোধন করেছে। আমি আগেও বলেছি, এটা সরকার করেনি। সরকার আমদের সম্মান দেখিয়েছে। আমরা যেটা চেয়েছিলাম সেটা নাও করতে পারত, সেটা সরকারের অধিক্ষেত্র। কিন্তু আমরা যেটা চেয়েছিলাম, সেখানে সরকারে সদিচ্ছার প্রতিফলন ঘটেছে। তারা আমাদের প্রস্তাবিত সংশোধনগুলো সংসদে নিয়ে পাশ করে দিয়েছে।
সাবেক এই আইন সচিব বলেন, দুই চারদিন আগেই একটা পত্রিকায় বলা হয়েছে, কমিশন থেকেই ক্ষমতা কমানো প্রস্তাব গিয়েছে। এটি একেবারেই অবান্তর। কমিশন কখনোই তার ক্ষমতা কমানোর প্রস্তাব পাঠায়নি। পাঠাতে পারেও না। আর এতোটা দায়িত্বহীন কমিশন হবে, এটা চিন্তাও করা যায় না। কিছু কিছু জায়গায় পোলিং এবং ইলেকশন শব্দের কথা বলেছে। আমরা তিনটা জায়গায় ইলেকশন শব্দের পরিবর্তে পোলিং দিয়ে প্রতিস্থাপিত করেছি।
এটা হলো ক্লারিক্যাল কারেকশন। ক্লারিক্যাল কারেকশন এবং অ্যামেন্ডমেন্ডের মধ্যে কিন্তু পার্থক্য আছে। অ্যামেন্ডমেন্ডের মধ্যে নীতিগত পার্থক্য থাকে, যেটা অর্থকে পরিবর্তন করে দেয়। ক্লারিক্যাল কারেকশন হচ্ছে জাস্ট সংশোধন। পানি বানান করতে গিয়ে উ-কার দিয়ে ফেলেছিলাম, কেউ সেটা ই-কার দিয়ে করতে পারে, যেটা কারেকশন। এটাকে নিয়ে অপব্যাখ্যা করাটা দুঃখজনক বলে মনে করি।
সাবেক এই বিচারক বলেন, আমরা প্রত্যাশা করবো যারা বিজ্ঞজন আছেন, আমরা পুরো জাতি প্রত্যাশা করছি একটা সুন্দর নির্বাচন হোক। নির্বাচন নিয়ে অহেতুক বিভ্রান্তিকর মন্তব্য করে নির্বাচন কমিশনকে হেয় করা বা খাটো করা যেমন বাঞ্ছনীয় নয়, যেমন নির্বাচন কমিশনকে তারা যদি গঠনমূলক পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করেন, আমরা উপকৃত হবো। আমরা যেকোনো গঠনমূলক সাজেশন বিবেচনায় নিতে সদা প্রস্তুত। আগামী নির্বাচনটাকে সুন্দর করার জন্য আমরা প্রত্যাশা করি যেকোনো আইন বা বিধি বিধানে ভালো কোনো সংশোধন সম্ভব হয় আমরা হয়তো আগামীতেও করবো।
৩১(২)-তে আগের ছিল শুধু ছিল থাকবে ব্যালট পেপারে। এখন সেখানে স্বাক্ষরের বিধানও এনেছি। ভোট গণনার সময় ব্যালটে স্বাক্ষর না পেলে সেটা বাতিল করা হবে। আরেকটা বিষয় হলো আবেদনের ভিত্তিতে এজেন্টদের রেজাল্ট দেবেন। কিন্তু এখন বলা হয়েছে আবেদনের ভিত্তিতে নয়, প্রিজাইডিং কর্মকর্তা এমনিতে সেটা দেবেন। কারও প্রার্থিতা আমরা বাতিল করতে পারি। কিন্তু সে আবারও নমিনেশন জমা দিতে পারবে।
এক্ষেত্রে আমরা বিধান এনেছি কারও যদি অপকর্মের কারণে প্রার্থিতা বাতিল হয়ে যায়, তাহলে সে পরবর্তীতে নতুন নমিনেশন দাখিল করতে পারবে না। নিঃসন্দেহে এটা একটা অগ্রগতি। গণমাধ্যমে প্রচারটা যদি সঠিক হয়, তথ্যটা যদি সঠিকভাবে উপস্থাপিত হয়, তাহলে আমাদের জনগণ প্রাজ্ঞ জনগণ হবেন। তাদের মধ্যে যে বিভ্রান্তি, সেটা নিরসন হবে। বিভ্রান্তি নিয়ে যদি তারা বসবাস করেন তবে তারা অজ্ঞ থেকে যাবেন। আমরা চাই আমাদের জনগণ নির্বাচন বিষয়ে প্রাজ্ঞ হন, প্রাজ্ঞ হয়ে তাদের মতামত যেন ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে ব্যক্ত করতে পারবেন।
আরপিও ৯১এ-ধারায় ইলেকশন শব্দটির পরিবর্তে পোলিং শব্দটি কেন আনা হলো? এমন প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, ইলেকশন শব্দটা হচ্ছে জেনাস। ইলেকশনের আন্ডারে পোলিং। পোলিংয়ের আন্ডারে কখনো ইলেকশন হয় না। তো যেটা হচ্ছে একটা নির্বাচন করে যিনি নির্বাচিত হলেন, উনি পোলড হবে না, উনি নির্বাচিত হবেন। আর পোলিংটা হবে যেই অংশটাতে ভোটাররা গিয়ে ভোট দিবেন। ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়াটাকে পোলিং বলা হয়।
আমাদের আরপিওতে দেখবেন, ইলেকশন আর পোলিং শব্দটা ডেফিনেশনে আছে। এটাকে বিশাল করে দেখানোর চেষ্টা হয়েছে, যে নির্বাচন কমিশন তার পায়ে কুঠার মেরে ফেলেছে। নির্বাচন কমিশন ভুল করতে পারে কিন্তু কুঠার মারে নাই। আমরা বলছি, এটা সুচিন্তিতভাবে এটা কারেকশন করেছি। এখানে আসলে ইলেকশন হবে না, পোলিং হবে।
১৭ জুলাই ঢাকা-১৭ নির্বাচন। এমন কোনো পরিস্থিতি আজকে হলো যে নির্বাচন করার মতো পরিবেশ নেই, সেক্ষেত্রে এখন যে ইলেকশন বাদ দিয়ে পোলিং শব্দটা প্রতিস্থাপন করা হলো এতে কমিশন আজকে চাইলে ভোটটা বন্ধ করে দিতে পারবে?
উত্তরে সিইসি বলেন, আমি এই প্রশ্নের উত্তর দেব না। আপনি (প্রশ্নকারী সাংবাদিক) বুঝে নিজেই উত্তর দেন।
নির্বাচনের আগে কোনো পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে কমিশন ভোট বন্ধ করতে পারবে কিনা?
জানতে চাইলে সিইসি বলেন, নির্বাচনের আগের দিন ভূমিকম্প হয়ে ৫০ লাখ লোক মারা গেছে, কমিশনের কিছু ইনহেরেন্ট পাওয়ার আছে, কমিশন পারবে না কেন। অনিয়ম যদি হয়, নির্বাচনের আগে, আমাদের বিধান আছে তদন্ত করতে হবে। তদন্ত করে অনিয়ম যিনি করেছেন তার প্রার্থিতা বাতিল করার সুস্পষ্ট একটা বিধান আছে।
আমরা যদি দায় নিরূপণ করতে পারি কে অনিয়ম করেছেন, তাহলে তার প্রার্থিতা বাতিল করে নির্বাচন চালিয়ে নিতে পারবো। আর পোলিং বা ইলেকশন শব্দটির কারণে কোনো হেরফের হবে না।
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য