ময়মনসিংহ-৬ (ফুলবাড়িয়া) আসনে সম্ভাব্য প্রার্থীরা ভোটের প্রস্তুতি নিয়ে মাঠ গুছাচ্ছেন। ভোটারদের মাঝেও চলছে নানা আলোচনা। মাঠে অধিক সরব থেকে ব্যাপকভাবে কাজ করছেন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী নেতারা। সেই তুলনায় অনেকটাই নীরব বিএনপি। মহাজোটের শক্তিশালী অবস্থানে আছে জাপা ও জাসদ।
ফুলবাড়িয়া উপজেলার ১৩টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা নিয়ে জাতীয় সংসদের ১৫১ ময়মনসিংহ-৬ (ফুলবাড়িয়া) আসন গঠিত। জেলার রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ আসনে মোট ভোটার ৩,৮৪,৬০০ জন। তার মধ্যে পুরুষ ১,৯৩,৫৫৮, নারী ১,৯১,০৪০, তৃতীয় লিঙ্গ ২ জন রয়েছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের প্রবীণ রাজনীতিবিদ বর্তমান এমপি অ্যাডভোকেট মোসলেম উদ্দিন নৌকা প্রতীক নিয়ে এ আসন থেকে ৬ বার এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। এবারো তিনি ভোটের লড়াইয়ে অনুসারীদের সঙ্গে করে এলাকায় কাজ করে যাচ্ছেন।
এছাড়াও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নানা প্রক্রিয়ায় নির্বাচনী মাঠ গোছাতে কাজ করছে। আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশী একাধিক নেতা মসজিদ, মাদরাসা, স্কুল-কলেজ, নানা সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ, তৃণমূল পর্যায়ে নেতাকর্মীদের ঘরে ঘরে গিয়ে খোঁজ-খবর নিচ্ছেন।
দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে নৌকার জোরালো দাবিদার বর্তমান এমপির পুত্র উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি অ্যাডভোকেট ইমদাদুল হক সেলিম। তিনি উপজেলার ইউনিয়ন থেকে শুরু করে তৃণমূলের ওয়ার্ডগুলোতে আওয়ামী লীগের দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে সভা-সমাবেশ করে সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকান্ড তুলে ধরে গণসংযোগ করে যাচ্ছেন। মূল দলের পাশাপাশি স্থানীয় আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনের দু-একজন ছাড়া নেতাকর্মীদের সবাই ঐক্যবদ্ধ অবস্থান নিয়ে তার সঙ্গে রয়েছেন বলে তিনি জানান।
এ ছাড়া আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী অন্যরা হলেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য অ্যাডভোকেট মোসলেম উদ্দিন এমপি, উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য অ্যাডভোকেট আব্দুর রাজ্জাক, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আলহাজ অ্যাডভোকেট ইমদাদুল হক সেলিম, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মো. হারুন অর রশীদ হারুন, সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. আব্দুল মান্নান, মহানগর যুবলীগ (উত্তর) আইনবিষয়ক সম্পাদক ও সন্ত্রাস দমন ট্রাইব্যুনালের পিপি অ্যাডভোকেট গোলাম ছারোয়ার খান জাকির, উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য শেখ গোলাম মোস্তফা তপন তালুকদার, অ্যাডভোকেট খাইরুল ইসলাম ও আওয়ামী লীগ নেতা আ. মালেক।
দলীয় মনোনয়ন লাভের প্রত্যাশায় নানা কর্মকান্ডের পাশাপাশি এলাকায় দোয়া চেয়ে প্যানা, পোস্টার, বিলবোর্ড, ফেস্টুন দিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করে যাচ্ছেন এসব সম্ভাব্য প্রার্থী। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন কে পাবেন এমন বিষয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্য আলহাজ মোসলেম উদ্দিন বলেন, আমি এমপি হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ পালন করে সরকারের উন্নয়ন কর্মকান্ডে অবদান রেখেছি।
উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি অ্যাডভোকেট ইমদাদুল হক সেলিম বলেন, আওয়ামী লীগকে তৃণমূল পর্যায়ে সুসংগঠিত করেছি। উপজেলা আওয়ামী লীগ প্রস্তুত নির্বাচন নিয়ে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যাকে নৌকার মনোনয়ন দেবেন আমরা তাকেই বিজয়ী করতে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করব। অ্যাডভোকেট জাকির বলেন, বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উন্নয়নের ধারাকে অব্যাহত রাখতে নৌকাকে বিজয়ী করতে হবে।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি থেকেও মনোনয়নপ্রত্যাশী একাধিক নেতা রয়েছেন। ফুলবাড়িয়া উপজেলা বিএনপির একটি অংশ মাঠে কাজ করছে। দুঃসময়ে বিএনপি ছেড়ে কিং পার্টি খ্যাত প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দল-পিডিপির মতো দলে যোগ দিয়ে বিএনপির ক্ষতি করা গ্রুপ এখন আবার নতুন করে বিএনপিতে সক্রিয় হয়ে উঠেছে বলে বিএনপির নেতাকর্মীদের অভিযোগ রয়েছে। নানা কারণেই এখনো পুরোপুরি মাঠ গোছাতে পারেনি বিএনপি।
সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপির দলীয় রাজনীতিতে এখানে অনেকটাই ভাটা পড়েছে। দলের এ নাজুক পরিস্থিতি থেকে দলের নেতাকর্মীদের নিয়ে এগোতে পারছে না ৯ মাস আগে গঠন হওয়া উপজেলা বিএনপির আহব্বায়ক কমিটি।গত বছরের ১৫ আগস্ট ময়মনসিংহ (দক্ষিণ) জেলা বিএনপির আহব্বায়ক ডা. মাহবুবুর রহমান লিটন নবগঠিত উপজেলা আহব্বায়ক কমিটিকে এক নির্দেশনায় লিখিতভাবে ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে উপজেলার সব ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড কমিটি সম্মেলনের মাধ্যমে গঠনের নির্দেশ দিলেও বিএনপির উপজেলা আহব্বায়ক কমিটি গঠনে ব্যর্থ হয় বলে তৃণমূল নেতাকর্মীদের অভিযোগ।
ফখরুদ্দিন-মইনুদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান গ্রেপ্তার হলে এর প্রতিবাদ ও নেতাদের মুক্তির দাবিতে তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রনেতা, বর্তমানে কেন্দ্রীয় যুবদলের প্রচার সম্পাদক আব্দুল করিম সরকার নেতৃত্ব দিয়ে ঢাবি ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল করেন। তিনি দলীয় মনোনয়নে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রত্যাশায় কাজ করে যাচ্ছেন।
জানা যায়, উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আজিজুর রহমান ফুলবাড়িয়া উপজেলা বিএনপির দুঃসময়ে নেতাকর্মীদের পাশে থেকে উপজেলা পরিষদ পরিচালনা করেছেন। পরিষদের চেয়ারম্যান থাকাকালীন তিনি উপজেলার ১৩টি ইউনিয়নে চষে বেড়িয়েছেন, নেতাকর্মীদের খোঁজ-খবর নিয়েছেন। আইনজীবী পেশায় নিয়োজিত থেকে দলমত নির্বিশেষে সাধারণ এবং দলীয় নেতাকর্মীদের দিয়েছেন আইনি সহযোগিতা।
উপজেলা চেয়ারম্যান থাকাকালীন সময়ে জেল খেটেছেন তিনি। উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহব্বায়ক মো. শাহজাহান সিরাজ সাজু বলেন, পিডিপি ফারুক আহব্বায়ক হওয়ার পর তার একঘেয়েমি মনোভাব এবং ঢাকায় অবস্থান করার কারণে দলীয় কর্মকান্ড দেখে আহব্বায়ক কমিটির ৬ জন যুগ্ম আহব্বায়ক তার কাছ থেকে সরে গেছেন।
অন্যদিকে উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহব্বায়ক, সাবেক উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আজিজুর রহমান, উপজেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক বর্তমান কমিটির যুগ্ম আহব্বায়ক আশিকুল হকসহ কমিটির ৬ জন যুগ্ম আহব্বায়ককে তার দলে ভেড়াতে পারেননি আহব্বায়ক পিডিপি ফারুক। আহব্বায়কের প্রতি ক্ষুব্ধ যুগ্ম আহব্বায়ক অ্যাডভোকেট আজিজুর রহমান ও উপজেলা বিএনপির সদস্য, যুবদল কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির প্রচার সম্পাদক ও ছাত্রদল কেন্দ্রীয় সংসদের সাবেক যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম সরকার বিএনপির কেন্দ্রীয় কর্মসূচি বিএনপির উপজেলা আহব্বায়ক ছাড়াই পৃথকভাবে জাতীয় ও দলীয় কর্মসূচিগুলো পালন করে যাচ্ছেন। আব্দুল করিম সরকারের নেতৃত্বে ফুলবাড়িয়া উপজেলার ইউনিয়ন ওয়ার্ডের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন শক্তিশালী হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে।
বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী যারা: যুবদল কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির প্রচার সম্পাদক, উপজেলা বিএনপির সদস্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মাস্টারদা সূর্যসেন হলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সাবেক ছাত্রনেতা আবদুল করিম সরকার, উপজেলা বিএনপির আহব্বায়ক আকতারুল আলম (পিডিপি ফারুক), উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহব্বায়ক, উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা বিএনপির সদস্য অ্যাডভোকেট আজিজুর রহমান, উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহব্বায়ক ও উপজেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক সাবেক ছাত্রনেতা মো. আশিকুল হক আশিক, উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহব্বায়ক অ্যাডভোকেট রেজাউল করিম চৌধুরী, উপজেলা বিএনপির সদস্য প্রবাসী ডক্টর মো. খলিলুর রহমান আকন্দ।
এরশাদবিরোধী আন্দোলন এবং বর্তমান সরকারের নানা অপকর্মের বিরুদ্ধে আন্দোলনে জেলজুলুম, মামলা-হামলাসহ রাজপথে ছিলেন আশিকুল হক। ৬ষ্ঠ, ৭ম, ৮ম, ৯ম এবং একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন। তিনি মনোনয়ন পেলে বিজয় সহজ বলে তিনি দাবি করেন।
আশিক বলেন, আমাকে ধানের শীষ প্রতীকে মনোনয়ন দিলে বেগম খালেদা জিয়া তথা তারেক রহমানকে আসনটি উপহার দেব। উপজেলা বিএনপির সদস্য প্রবাসী বীর মুক্তিযোদ্ধা ডক্টর মো. খলিলুর রহমান আকন্দ ন দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশায় এলাকায় পোস্টার-প্যানা দিয়ে উপজেলাবাসীকে বেগম খালেদা জিয়ার বার্তা পৌঁছে দিচ্ছেন। তিনি নেতাকর্মীদের মাঝে ব্যাপক জনপ্রিয়। প্রবাসী এই নেতা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার পাশাপাশি নিজ এলাকার তৃণমূলে নেতাকর্মীদের দুঃসময়ে নানাভাবে পাশে থাকছেন।
দ্বাদশ নির্বাচনে দল যদি নির্বাচনে আসে তবে তিনি ধানের শীষের জোরালো দাবিদার হিসেবে কাজ করছেন। মাঠের কর্মী ও বিএনপির ত্যাগী নেতাদেরও রয়েছে নানা প্রত্যাশা। ’৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের সময় স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম ছাত্রনেতা অ্যাডভোকেট মাহবুবুর রশীদ তামান্না বলেন, উপজেলা বিএনপির নেতাকর্মীদের নামে ২০১৪ সাল থেকে যতগুলো গায়েবি মিথ্যা মামলা হয়েছে, ৬০ ভাগ মামলা আমি পরিচালনা করছি।
দলের সব কর্মসূচিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ থাকা সত্তে¡ও আমাকে দলের কোনো সদস্য পদও দেয়া হয়নি। নেতার আজ্ঞাবহ হলে কমিটিতে স্থান আর বিএনপির কর্মী হলে কিছুই পাবে না। সকল শ্রেণি-পেশার মানুষকে দলে সম্পৃক্ততা না করলে দল সমৃদ্ধ হবে না।
এদিকে, আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধ নির্বাচন হলে জাতীয় পার্টি এ আসনটি তাদের নিজেদের জন্য প্রত্যাশা করে। সে লক্ষ্যে তারা কাজও করে যাচ্ছে। এখানে রওশন এরশাদ ও জিএম কাদের দুই গ্রুপের নেতাকর্মীদের মধ্যে বিভক্তি রয়েছে। রওশন এরশাদের গ্রুপের মনোনয়নপ্রত্যাশী হলেন এরশাদের সাবেক উপদেষ্টা ও উপজেলা জাপার আহব্বায়ক ডা. কে আর ইসলাম। জাতীয় পার্টির অপর মনোনয়নপ্রত্যাশী হিসেবে মাঠে নিয়মিত কাজ করছেন কেন্দ্রীয় জাপার সাংগঠনিক সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহফিজুর রহমান বাবুল। তিনি উপজেলায় অসহায় হতদরিদ্র মানুষের কল্যাণে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে যাচ্ছেন।
মাহফিজুর রহমান বাবুল বলেন, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের যদি আমাকে লাঙ্গল প্রতীক মনোনয়ন দেন, তাহলে আমি বিপুল ভোটে বিজয়ী হবো। মহাজোটের সুযোগে জাসদ (ইনু) এ আসনে ঝোঁপ বুঝে কোপ মারতে চান। এখানে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদ তৃণমূল পর্যায়ে অনেকটাই শক্তিশালী। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) একক মনোনয়নপ্রত্যাশী ময়মনসিংহ মহানগর জাসদের সভাপতি ও সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর সৈয়দ শফিকুল ইসলাম মিন্টু।
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য