মুস্তাফিজুর রহমান নাহিদ: শিশুশ্রম প্রতিরোধে সরকারিভাবে নানা উদ্যোগ নিলেও একেবারে তা বন্ধ হয়নি। এখনো ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশু শ্রমিক নিয়োগ বন্ধ হচ্ছে না। মোটরসাইকেল ওয়ার্কশপ, গাড়ির গ্যারেজ, স্টিল ও কাঠের আসবাবপত্রের দোকান, ভাঙারির দোকান, হোটেল-রেস্তোরাঁ, ওয়েল্ডিংয়ের দোকান ও বহুতল ইমারত নির্মাণকাজে এখনো শিশুরা শ্রম দিয়ে চলেছে। বাসাবাড়িতেও কাজ করছে শিশুরা। যেসব শিশুদের লজেন্স খাওয়ার বয়স তারাই করছে লজেন্স ফেরি। মালিকরা এসব কাজে নিয়োগ করছে তাদের।
প্রাপ্ত তথ্য মতে গত ১০ বছরে দেশে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা বেড়েছে ৭৭ হাজার ২০৩ জন। দেশে এখন শিশু শ্রমিকের সংখ্যা ১৭ লাখ ৭৬ হাজার ৯৭ জন। যা ২০১৩ সালে ছিল ১৬ লাখ ৯৮ হাজার ৮৯৪ জন। তবে শ্রমিকের সংখ্যা বাড়লেও ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুদের অংশগ্রহণ কমেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এমন তথ্য।
বিবিএসের সর্বশেষ রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২২ সালে মোট শিশুর তুলনায় কর্মজীবী শিশুর হার ৮.৯০ শতাংশ। ২০১৩ সালের জরিপে এ সংখ্যা ছিল ৮.৭০ শতাংশ। একইভাবে, শিশুশ্রমের হার ২০১৩ সালের ৪.৩০ শতাংশের চেয়ে বেড়ে ২০২২ সালে ৪.৪০ শতাংশ হয়েছে। রিপোর্টে আরো বলা হয়, বর্তমানে ৩৭ লাখ শিশু কোনো ধরণের শ্রমের সঙ্গে যুক্ত নয়। যা একটি ইতিবাচক দিক।
বিবিএস বলছে, দেশে ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সি শিশুর সংখ্যা ৩ কোটি ৯৯ লাখ ৬৪ হাজার ৫ জন। ২০১৩ সালে তা ছিল ৩ কোটি ৯৬ লাখ ৫২ হাজার ৩৮৪ জন। ২০২১ সালের জুনে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) এবং ইউনিসেফের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী শিশু শ্রমিকের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ১৬০ মিলিয়ন। শেষ চার বছরে বাড়ে ৮.৪ মিলিয়ন।
এদিকে শিশুরা যেন কাজে না যায়, এ জন্য সরকারি-বেসরকারিভাবে পরিবারগুলোকে সহায়তা প্রদানের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। শিশুদের সরকারিভাবে উপআনুষ্ঠানিক শিক্ষাকার্যক্রম দেয়া হচ্ছে। সেই সঙ্গে তাদের দক্ষতা উন্নয়নে ছয় মাস মেয়াদি প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে। এ জন্য দেশের বিভিন্ন স্থানে উপআনুষ্ঠানিক বিদ্যালয় রয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, শিশুশ্রম নিরুৎসাহিত করতে সরকারের পক্ষ থেকে উপআনুষ্ঠানিক শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়নে যে কর্মসূচি শুরু হয়েছে, তাতে করে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। কারখানাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে যেন শিশুদের কাজে নেয়া না হয়, এ জন্য প্রতিটি পরিবারকেও সচেতন হতে হবে। সব চেয়ে বড় কথা শিশুদের ওপর আরো মানবিক হতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক এবং অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হকের মতে, সারা বিশ্ব এর কমবেশি শিশুশ্রম রয়েছে। পরিবারের আর্থিক অনটনসহ নানা অনিশ্চিয়তার কারণে দেশে এখন শিশুরা বেশি ঝুঁকে পড়ছে শ্রমের দিকে। মূলত এসব শিশু বাসের হেলপার, গাড়ি মেরামত, কলকারখানার শ্রমিক হিসেবে কাজ করছে। তিনি বলেন প্রতি বছরই বিভিন্ন প্রতিপাদ্য সামনে রেখে শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস পালন করা হয়। তবে এতে খুব একটা লাভ হয় না।
কারণ আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে শিশুরা ঝুঁকিপূর্ণ কাজ থেকে শুরু করে নানা ধরনের কাজে কেন জড়িয়ে পড়ছে সেটি খুঁজে বের করতে হবে। এর কারণ খুঁজে বের করে সমাধান করা না গেলে শুধু দিবস পালন করে এর সমাধান করা যাবে না।
২০২৫ সালের মধ্যে সব ধরনের শিশুশ্রম নিরসনের লক্ষ্য ঠিক করেছিল সরকার। এই লক্ষ্য পূরণ নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। ২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে চিরতরে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম বন্ধের পরিকল্পনা থাকলেও তা করা সম্ভব হয়নি। এর আগে দেশে করোনার আবির্ভাব ঘটলে এ কাজ আর সেভাবে এগোয়নি।
প্রসঙ্গত ১৪ বছরের কম বয়সি কোনো শিশুকে কোনো কাজে নিয়োগ করার ক্ষেত্রে বিদ্যমান সরকারি আইনে নিষেধাজ্ঞা আছে। তবে এটি অমান্য করেই চলছে এ ধরনের নিয়োগ। এখনো দেশের বহু বাসাবাড়িতে ১৪ বছরের কম বয়সি শিশুরা কাজ করছে। কাজ করছে হোটেল রেস্তোরাঁসহ বিভিন্ন কারখানা ও প্রতিষ্ঠানে। এ ধরনের শ্রম বন্ধে সরকার নিতে পারছে না কোনো কার্যকর উদ্যোগ।
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য