শাহীন রহমান: পুরো বর্ষা মৌসুমে হাতেগোনা কয়েকদিন মাত্র বৃষ্টি হওয়ার পর আর মেঘের দেখা নেই। বৃষ্টির অভাবে একদিকে আমন মৌসুমে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন কৃষক; অন্যদিকে ক্ষেতে থাকা সবজির ফসলও কমে গেছে। আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, এ মুহূর্তে আগস্ট মাসেও বড় ধরনের বৃষ্টির আভাস নেই।
আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ভূখন্ডের জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। আবহমানকাল থেকেই এ সময়কে বর্ষাকাল বলা হয়। কিন্তু সম্প্রতি বছরগুলোয় বৃষ্টিপাতের দেখা মিলছে না। এ অবস্থায় তারা বলছেন, বদলের গেছে বর্ষাকাল।
প্রকৃতির ধরন অনুযায়ী এ সময়ে খাল-বিলে পানিতেই টইটুম্বুর থাকার কথা। অথচ পানির অভাবে খাল-বিল শুকিয়ে গেছে। দেশের অন্যতম অর্থকরী ফসল পাট পচানোর সময় এটা। পাট কেটে দীর্ঘসময় ধরে পানিতে রেখে পচাতে হয়। তারপর আঁশ বের করে শুকিয়ে বাজারে বিক্রি করেন কৃষক। অথচ পাট পচানোর পর্যাপ্ত পানি না থাকায় বিপাকে পড়েছেন সারা দেশের কৃষক। এখন তাদের মাথায় হাত। পাট পচাতে না পারলে আর্থিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হবেন তারা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানিকগঞ্জ বা সিরাজগঞ্জের মতো অনেক নিচু এলাকায় এ সময়ে পানি চলে আসে। কৃষক সেই অনুযায়ী পাট বা ধান রোপণ করেন। কিন্তু এবার বৃষ্টি না হওয়ায় সেভাবে পানি আসেনি। ফলে কৃষকও সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না, তারা কি বেশি পানির ফসল লাগাবেন নাকি কম পানির গাছ। যথেষ্ট বৃষ্টি না হলে ফরিদপুর-রাজবাড়ীর পাটের চাষাবাদের ওপরও প্রভাব পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অনেক কৃষক।
আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত কয়েক বছর ধরেই বর্ষা মৌসুমের বৃষ্টিপাতের একটা বড় ধরনের পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। অনেক সময় বর্ষার আগেই বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়, আবার বর্ষা বাদ দিয়ে পরে শরৎকালে বৃষ্টি হতে থাকে। কিন্তু গত দুই দশক ধরেই দেশে অঞ্চলে বর্ষাকালে বেশকিছু পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে।
অনেক সময় বর্ষাকালের আগে বা পরে বেশি বৃষ্টি হচ্ছে অথচ পুরো আষাঢ়-শ্রাবণ মাস হয়তো শুষ্ক থাকছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ তরিফুল নেওয়াজ কবির বলেন, গত বছরের তুলনায় এবার বর্ষাকালে বৃষ্টিপাত প্রায় ৫৭.০৬ শতাংশ কম হয়েছে। কয়েকদিনের বৃষ্টিপাত বিষয়টি বাদ দিলে দেশের আকাশ অনেকটা মেঘশূন্য অবস্থায় রয়েছে। আগামীতেও বড় ধরনের বৃষ্টিপাতের আভাস নেই।
জুলাই মাস প্রকৃতি থেকে বিদায় নিয়েছে। এ সময়টা দেশে শ্রাবণ মাস হিসেবে পরিচিত। সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাতের মৌসুম। আগেই আবহাওয়া ও পরিবেশ বিজ্ঞানীরা জানিয়ে দিয়েছেন, উষ্ণতম জুলাই ছিল এবারই। জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল গুতেরেস বলেন, উষ্ণতার দিক দিয়ে জুলাই মাস অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে।
আন্তর্জাতিক রিপোর্ট অনুসারে, এবারের জুলাইয়ের প্রথম ২৩ দিনের গড় তাপমাত্রা ছিল ১৬.৯৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর আগের রেকর্ড ছিল ২০১৯ সালের জুলাই মাসের। সেবার গড় তাপমাত্রা ছিল ১৬.৬৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ৬ জুলাই তো ছিল বিশ্বের উষ্ণতম দিন। দ্য ক্লাইমেট সার্ভিসের দাবি, শিল্পায়নের আগে বিশ্বের যে গড় তাপমাত্রা ছিল, তার থেকে দেড় ডিগ্রিরও বেশি তাপমাত্রা বেড়েছে জুলাইয়ে। এটা রীতিমতো চিন্তার কথা।
ওয়ার্ল্ড মেট অর্গানাইজেশনের সেক্রেটারি জেনারেস তালাস বলেন, এ চরম আবহাওয়ার ফলে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ চরম কষ্টের মধ্যে পড়েছেন। জলবায়ু পরিবর্তন ও ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জটা ভালো করেই বোঝা যাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জুলাইয়ের এ উষ্ণতার প্রভাব পড়ছে দেশে বর্ষা ঋতুর। ফলে বর্ষার ভরা মৌসুমেও কাক্সিক্ষত বৃষ্টির দেখা নেই। শ্যালো মেশিন চালিয়ে জমিতে সেচ দিয়ে আমন ধানের চারা লাগাচ্ছেন কৃষক। এতে বাড়ছে উৎপাদন খরচ। সেইসঙ্গে আমন চাষাবাদ নিয়ে নানামুখী শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এ চিত্র সারা দেশের।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঝুঁকির মধ্যে পড়ে গেছে দেশ। কৃষক বলছেন, এবার খরার কবলে পড়ে আমন চাষাবাদ ব্যাহত হতে চলেছে। বৃষ্টি না হওয়ায় কৃষকদের বাড়তি সেচ দিয়ে আমন চাষাবাদ করতে হচ্ছে।
তারা জানান, পানির অভাবে অনেক কৃষক ধান রোপণ করতে পারছেন না। বৃষ্টির অভাবে কিছু জমিতে সদ্য রোপণ করা আউশ ধানের ক্ষেত নিয়েও বিপাকে পড়েছেন কৃষক। আমন চাষিদের সেচপাম্পের পানিই এখন একমাত্র ভরসা। এতে এ জেলার কৃষকের আমন ধান চাষের খরচ অনেকগুণ বেড়ে গেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বজুড়ে গরম আবহাওয়া বিরাজ করছে। ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, কানাডা, এশিয়ায় আবহাওয়ার অবস্থা ভয়ংকর বলে জানানো হয়েছে। কানাডা ও গ্রিসে ভয়াবহ দাবানল জ্বলছে। দাবানল এবার অন্য দেশেও ছড়াচ্ছে। ভারত, পাকিস্তান, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপানে প্রবল বৃষ্টি ও তার ফলে ভয়ংকর বন্যা হয়েছে।
এজন্য বিশেষজ্ঞরা জলবায়ু পরিবর্তন, এল নিনো বা লা নিনার প্রভাবকে দায়ী করছেন। পেরু অঞ্চলের সমুদ্রের পানির উষ্ণতা বেড়ে গেলে এল নিনো আর কমে গেলে লা নিনা তৈরি হয়। এর প্রভাব প্রশান্ত বা ভারত মহাসাগরীয় সব দেশের ওপরেই পড়ে। বৃষ্টি কম বা বেশি হওয়া, প্রাণীর জীববৈচিত্রের ওপরে তার প্রভাব পড়ে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক ড. সমরেন্দ্র কর্মকার এ বছর এল নিনোর প্রভাবে বৃষ্টিপাতের প্রবণতা কমে গেছে। আবার অনেক এলাকায় অতি বৃষ্টি বা বন্যা হয়ে যাচ্ছে। যেমন আমাদের এখানে বৃষ্টি কম হলেও গুজরাটে বা পাকিস্তানে অনেক বৃষ্টি হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন মৌসুমি বায়ুর কারণে এ বর্ষা এখানে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে। এ বায়ু অনেক সময় উত্তর বা দক্ষিণে অবস্থান নিয়ে থাকে। এটা যদি দক্ষিণ দিকে বেশি সময় থাকে, তাহলে বাংলাদেশ অঞ্চলে বৃষ্টিপাত কম হয়। আবার উত্তর অঞ্চলে থাকলে হিমালয়ের পাদদেশ এলাকায় বৃষ্টিপাত বেশি হয়, যার ফলে অনেক সময় নদীগুলো উপচে উজানে বন্যা দেখা দেয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্ষাকালের এ পরিবর্তন ২০০৩ সাল থেকেই দেখা যাচ্ছে। তারা বলছেন, অ্যাক্সেসে মনসুন সিস্টেম থাকে, সেটা দক্ষিণ দিকে এক থেকে দুই ডিগ্রি সরে গেছে। এর ফলে আমাদের এলাকায় বর্ষাকালে বৃষ্টির হার কমে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগে আগস্ট সেপ্টেম্বরের পর বৃষ্টি হতো না, কিন্তু এখন জুন মাসে বৃষ্টি না হয়ে এখন সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে বৃষ্টি হচ্ছে।
ফলে শীতকালীন যে ফসলটা অক্টোবরে লাগানো হতো, মাটি কাদা বা আর্দ্রতা বেশি থাকার কারণে সেটা লাগানো যায় না। নভেম্বরের আগে গম লাগানো, সরিষা বা শীতকালীন যে সবজি লাগানো হতো, সেটার চাষাবাদ পিছিয়ে যাচ্ছে। ফলে এটার যতটা শীত পাওয়ার দরকার সেটা পাচ্ছে না। কারণ লাগাতে দেরি হওয়ায় ফসল আসার আগেই গরম পড়ে যাচ্ছে। ফলে শীতকালীন ফসল শীত না পাওয়ায় ফলন প্রচুর কমে যাচ্ছে।
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য