আগে থেকেই বিদেশিদের দৃষ্টিভঙ্গি জানার চেষ্টা ছিল খুনিদের। ১৫ আগস্ট নির্মম হত্যাকান্ডের অন্তত ১৫ মাস আগেই অভ্যুত্থান নিয়ে আমেরিকানদের দৃষ্টিভঙ্গি জানার চেষ্টা করেছিল বঙ্গবন্ধুর খুনিরা।
এছাড়া অভ্যুত্থানের পর বিদেশি কোনো শক্তি; বিশেষ করে ভারত যাতে হস্তক্ষেপ করতে না পারে, সেই দিকটা আমেরিকা দেখবে কিনা, সেটাও যাচাই করতে চেয়েছিল তারা। শুধু তাই নয়, এর আগেও তারা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্য আমেরিকা থেকে অস্ত্র কেনার ছল করে তথ্য জানতে আমেরিকান দূতাবাসে যায়। তারা সেখানে সেনাবাহিনীর মধ্যে ক্ষোভের কথা ব্যক্ত করে।
আমেরিকান সাংবাদিক লেখক বিজেড খসরুর ইংরেজিতে লেখা ‘বাংলাদেশে মিলিটারি ক্যু সিআইএ লিঙ্ক’ গ্রন্থে এ ব্যাপারে বিস্তারিত বর্ণনা আছে। গ্রন্থটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন সিরাজ উদ্দিন সাথী। বাংলাদেশের ইউনিভার্সেল একাডেমি বইটি প্রকাশ করেছে।
বিজেড খসরু তার বইতে লেখেন, ঢাকার আমেরিকান দূতাবাস এমন অভ্যুত্থানের কথা শুনেছিল ১৫ আগস্টের ঘটনার অন্তত ১৫ মাস আগে। ১৯৭৪ সালের ১৩ মে সন্ধ্যায় লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান (বহিষ্কৃত) আগে থেকে না জানিয়েই আমেরিকান দূতাবাসের জনসংযোগ অফিসার উইলিয়াম গ্রেসামের বাসায় যায়।
ফারুক তাকে জানায় যে, ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তার নির্দেশে সে আমেরিকানদের মনোভাব জানার জন্য এসেছে। সে বলে, তারা নিশ্চিত হতে চায় সরকারকে হটিয়ে ক্ষমতা গ্রহণ করলে আমেরিকানদের দৃষ্টিভঙ্গি কি হবে।
ফারুক তাকে বলে, বিদেশি কোনো শক্তি যাতে হস্তক্ষেপ করতে না পারে, সে দিকটা আমেরিকা দেখবে কিনা। ফারুক বিশেষ করে ভারতের কথা বোঝাতে চায়।
ফারুক গ্রেসামকে জানায়, সারা দেশে সেনা অভিযান চলাকালে শেখ মুজিব আওয়ামী লীগ নেতাদের না ধরার জন্য যে আদেশ দিয়েছেন, তাতে সেনাবাহিনী সরকারের ওপর ভীষণ চটে আছে।
গ্রেসাম ফারুককে জানান, আমেরিকা বর্তমান সরকারকে স্বীকৃতি দেয় এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কোনো বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবে না। তবে ফারুকের এ সাক্ষাতের বিষয়টি দূতাবাস ওয়াশিংটন স্টেট ডিপার্টমেন্টকে অবগত করে। তারা একে অস্বাভাবিক অ্যাপ্রোচ বলে আখ্যায়িত করে।
তারা বলে, গত দুই বছরে এটাই প্রথমবার সেনাবাহিনীর অসন্তোষের এবং ক্যুর খবর নয়। আগেও এমন কথা দূতাবাসের কানে এসেছে। কিন্তু এর কোনোটাই সত্য হয়নি। তারা আরো উল্লেখ করে, ফারুক ও রশীদ এক বছর আগেও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্য আমেরিকা থেকে অস্ত্র কেনার ছল করে তথ্য জানতে আমেরিকান দূতাবাসে গিয়েছিল। তখন তারা সেনাবাহিনীর মধ্যে ক্ষোভের কথা ব্যক্ত করে।
মার্কিন দূতাবাস ফারুকের এ সাক্ষাতের বিষয়টি যতই অস্বাভাবিক অ্যাপ্রোচ বলে আখ্যায়িত করুক না কেন এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কোনো হস্তক্ষেপ করবে না বলে জানালেও পরবর্তী সময়ে তাদের কিছু তৎপরতা কিন্তু সেই অবস্থানকে প্রকাশ করে না। এ ধরনের খবরের নির্ভরযোগত্য যাচাইসহ অভ্যুত্থানের সম্ভাব্য দিক নিয়েও বিস্তর চিন্তা ভাবনা চর্চা করতে দেখা গেছে তাদের।
স্বল্পমেয়াদে সেনাবাহিনীর কার্যকর নিয়ন্ত্রণ নেয়ার সক্ষমতা আছে কিনা, অভ্যুত্থান ঘটিয়ে শেখ মুজিবকে হত্যা কিংবা জেলে নেয়া অথবা জোরপূর্বক বিদেশে পাঠানো হলে এর ফল কি হতে পারে এসব নিয়েও তাদের অনুসন্ধান অব্যাহত ছিল। ঢাকাস্থ আমেরিকান দূতাবাস ২২ মার্চ আট পৃষ্ঠার এক বিশ্লেষণে স্টেট ডিপার্টমেন্টের প্রশ্নমালার জবাব দেয়।
ডেপুটি চিফ অব মিশন আরভিং চেসলো উল্লেখিত মেয়াদের মধ্যে কেন অভ্যুত্থান ঘটতে পারে তার বিশ্লেষণ করে লিখেন, বাকশাল গঠিত হওয়ায় ভারতপন্থি ও সোভিয়েতপন্থি ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টিকে সঙ্গে নিয়ে শেখ মুজিবের ক্ষমতা সুসংহতকরণের আগেই হয়তো তারা অভ্যুত্থান ঘটাতে পারে। তবে তাদের মধ্যে যেমন ধৈর্যহীনতা আছে, তেমনি আছে পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যাওয়ার ভয়।
আমেরিকান কূটনীতিকগণ ধারণা করেছিলেন ১৯৭৫ সালের শুরুর দিকে যখন শেখ মুজিব বাকশাল গঠন নিয়ে ব্যস্ত থাকবেন, তখন এ অভ্যুত্থান ঘটতে পারে। তবে অভ্যুত্থান চেষ্টার সম্ভাবনা নিয়ে চেসলোর সন্দেহ ছিল।
তিনি লিখেন ‘আমাদের প্রশ্ন জাগে অপেক্ষাকৃত অনভিজ্ঞ তরুণ অফিসারদের এমনটা করার আত্ম বিশ্বাস কতটুকু আছে? কতটা সক্ষমতা আছে এবং তাদের সহকর্মীদের ওপর কতটা নির্ভর তারা করতে পারবে? অথচ এর ওপরেই হয়তো নির্ভর করবে তাদের পরিকল্পনার সাফল্য।
বিজেড খসরু লিখেন, এর আগেও আমেরিকান দূতাবাস ক্যু সংক্রান্ত খবরের অনেকগুলো রিপোর্ট পাঠায় ওয়াশিংটনে। তখন উল্লেখ করা হয় ২১ মার্চ থেকে ১৮ এপ্রিলের মধ্যে সেনাবাহিনী ক্যু ঘটাতে পারে। এসব রিপোর্টের প্রেক্ষিতে ১৯৭৫ সালের ২০ মার্চ স্টেট ডিপার্টমেন্ট এমন খবরের নির্ভরযোগ্যতা সর্ম্পকে জানতে চায় দূতাবাসের কাছে।
তারা জানতে চায় স্বল্পমেয়াদে সেনাবাহিনীর কার্যকর নিয়ন্ত্রণ নেয়ার সক্ষমতা আছে কিনা, অভ্যুত্থান ঘটিয়ে শেখ মুজিবকে হত্যা কিংবা জেলে নেয়া অথবা জোরপূর্বক বিদেশে পাঠানো হলে এর ফল কী হতে পারে? অভ্যুত্থান হলে শেখ মুজিব কি তার নেতৃত্ব অভ্যুত্থান পরবর্তী নেতাদের হাতে ছেড়ে দেবেন? এসব প্রশ্ন ছাড়াও স্টেটডিপার্টমেন্ট জানতে চায় অভ্যুত্থান চেষ্টা ব্যর্থ হলেও কিংবা পরিকল্পনা আগে ফাঁস হয়ে গেলে বাংলাদেশ সরকারের গতি-প্রকৃতি কী হবে? স্টেটডিপার্টমেন্ট আমেরিকার জন্য এমন অভ্যুত্থানের প্রভাব কী হবে, সেই বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে রিপোর্ট দিতে বলে।
’৭৫-এর শোকাবহ এ কালোদিবসে সূর্য ওঠার আগে খুব ভোরে সেনাবাহিনীর কিছুসংখ্যক বিপথগামী সদস্য ধানমন্ডির বাসভবনে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে। ঘাতকরা শুধু বঙ্গবন্ধুকেই হত্যা করেনি, তাদের হাতে একে একে প্রাণ হারিয়েছেন বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, বঙ্গন্ধুর সন্তান শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শিশু শেখ রাসেলসহ পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজি জামাল।
অন্যদিকে চেসলো তার এ বিশ্লেষণে আবার অভ্যুত্থান সফল হওয়ার দিকও বর্ণনা করেছেন। তিনি লিখেন, যদি সেনাবাহিনী ঐক্যবদ্ধ থাকে তাহলে স্বল্পমেয়াদে দেশে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার শক্তি থাকবে তাদের। তবে তাদের সফলতার শর্ত হবে শেখ মুজিবকে জিন্মায় নেয়ার পর সেনাবাহিনীর ঐক্য বজায় রাখা।
যদি তাদের মধ্যে বিভাজন দেখা দেয় এবং উপদলীয় কোন্দল প্রাধান্য পায়, তাহলে তারা কার্যকর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হবে। আর যদি তারা একত্রে মিলে একে সফল করে, তাহলে বাঙালি জনগনণ তাদের পক্ষে এসে দাঁড়াবে। তবে রিপোর্টে ২১ মার্চ থেকে ১৮ এপ্রিলের মধ্যে সেনাবাহিনী ক্যু ঘটাতে পারে বলা হলেও ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট এ অভ্যুত্থান ঘটানো হয়।
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য