রুদ্র মিজান: দু’চোখজুড়ে স্বপ্ন নিয়ে দেশ ছেড়ে ভিন দেশে যান। ভাগ্য বদলের প্রত্যাশায় জমি, গবাদিপশু বিক্রি ও ধারদেনা করে বিদেশে যান প্রবাসীরা। মাধ্যম রিক্রুটিং এজেন্সি। প্রবাসে গিয়ে নানা সমস্যার মুখোমুখি হন কর্মমুখী এই সাধারণ মানুষ। বাস্তবতার সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রেই মিল থাকে না রিক্রুটিং এজেন্সির। যে কারণে শন্যূ হাতে দেশে ফিরতে হয় অনেককে।
রিক্রুটিং এজেন্সির প্রতারণা ও স্থানীয় দূতাবাসগুলোর অসহযোগিতায় দেশে ফেরত আসা প্রবাসী শ্রমিকের সংখ্যা বাড়ছে। অনেকে পাঁচ বছরের ভিসায় বিদেশ গেলেও চলে আসতে হচ্ছে ছয় মাস বা এক বছরের মধ্যেই। সম্প্রতি বিপুল সংখ্যক শ্রমিক এভাবে দেশে ফিরেছেন।
বিমানবন্দরের টার্মিনালে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। বুঝতে পারছেন না কী করবেন। তার চোখেমুখে দুশ্চিন্তার ছাপ। বিমানবন্দর থেকে গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার মতো টাকাও নেই তার কাছে। এমন দৃশ্য দেখা যায় প্রায়ই হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, সম্প্রতি বিদেশফেরতের সংখ্যা বেড়েছে। অনেকে সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে দেশে ফিরছেন।
এ প্রসঙ্গে ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান সৌদি আরবের উদাহরণ দিয়ে ভয়াবহতা বোঝানোর চেষ্টা করেন।
অভিবাসন নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করা ব্র্যাকের এই শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা বলেন, ২০২২ সালে বাংলাদেশ থেকে ৬ লাখ ১২ হাজার মানুষ সৌদি আরবে যায়। এর মধ্যে দেড় লাখ মানুষই ফেরত এসেছে। গত পাঁচ বছরে ২০ লাখ মানুষ সৌদি আরব গেছে। সেখান থেকে বছরে প্রায় ৫০ থেকে ৬০ হাজার শ্রমিক সৌদি আরব থেকে ফেরত এসেছে।
তারা জানান, কাজের ভিসায় গেলেও সেখানে দিনের পর দিন তারা কর্মীহীন ছিলেন।
এজন্য আমাদের দেশের রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো শ্রমিকদের সঙ্গে কী ধরনের আচরণ করছে, কেমন কাজ দিচ্ছে, এগুলো দেখার বিষয়। যারা যাচ্ছেন তারা ওই সমস্ত কাজ পারেন কি-না। নির্ধারিত কোম্পানির অধীনে কাজ পাবেন কি-না তা না যাচাই করেই মানুষ যাচ্ছে। যথারীতি কাজ না পেয়ে তারা ফেরতও আসছে।
দূতাবাসগুলোকে আরো দায়িত্বশীল হওয়ার আহব্বান জানিয়ে শরিফুল হাসান বলেন, দূতাবাসগুলোকে শ্রমিকদের দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতে হবে। অনেকের কাগজপত্র সঠিক থাকার পরও তারা ফিরে আসছেন। ওই দেশের পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করে কিছুদিন জেলে রেখে ফেরত পাঠাচ্ছে। পুলিশের হাতে আটক হওয়ার পর শ্রমিকরা দূতাবাসে যোগাযোগ করলেও তেমন প্রতিকার পাচ্ছেন না।
জানা যায়, প্রায় প্রতিদিন ২০০ থেকে ২৫০ জন শুধু মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে ফেরত আসছে। এক্ষেত্রে এই শ্রমিকদের খুবই সামান্য পরিমাণ সহযোগিতা করে থাকে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ ও এপিবিএন। পর্যাপ্ত তহবিল না থাকায় এক্ষেত্রে নিঃস্ব এসব শ্রমিককে সহযোগিতা করতে পারে না কর্তৃপক্ষ।
ফিরে আসা শ্রমিকরা জানান, রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো তাদের কাছ থেকে বিপুল অঙ্কের অর্থ নিয়েছে। কিন্তু এজেন্সিগুলো সঠিক ভিসা দেয়নি। যে কাজের ভিসা নিয়ে তারা বিদেশে গেছেন, সে কাজ বা বেতন কিছুই পাননি। বাধ্য হয়েই অন্য কাজ খুঁজতে গেলে তাদের আটক করে সৌদি পুলিশ। তখন তাদের কোনো কথা না শুনে তাদের জেলে পাঠানো হয়।
সৌদি আরব থেকে দেশে ফেরত আসা কর্মী যশোরের কামাল বলেন, আমরা বৈধপথে সৌদি গিয়েছি। কিন্তু দেখা গেল রিক্রুটিং এজেন্সি সঠিক ভিসা দেয়নি। ফলে ওই দেশের পুলিশ আমাদের গ্রেপ্তার করল এবং প্রায় এক মাস কারাগারে রাখল। এরপর আমাদের এদেশে পাঠিয়ে দেয়া হলো। এর মধ্যে আমাদের লোকজন বাংলাদেশ দূতাবাসে যোগাযোগ করলে তারা কিছু করেনি।
কামালের দাবি, রিক্রুটিং এজেন্সির ঘাপলার কারণেই এমনটা হয়েছে। দূতাবাস এক্ষেত্রে পাশে থাকলে আমাদের এভাবে নিঃস্ব হয়ে ফিরতে হতো না।
বিদেশফেরত চট্টগ্রামের টিপু মুন্সি বলেন, এজেন্সির প্রতারণার কারণে বিদেশ থেকে ফেরত আসতে হয়েছে আমিসহ আরো অনেককে। আমার মতো অসংখ্য শ্রমিক এভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিপদে পড়লে বাংলাদেশ দূতাবাসের সহযোগিতা পাওয়া যায় না বলে অভিযোগ করেন তিনি। প্রবাসী শ্রমিকদের সঙ্গে এমন প্রতারণার দায়ে এজেন্সির বিরুদ্ধে প্রশাসনের আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন টিপু।
ফেনীর বাসিন্দা সৌদি প্রবাসী হাবিবুর রহমান জানান, পরিবারের মুখে হাসি ফোটানোর আশায় রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে সৌদি যান। ছয় বছর পর দেশে ফেরার কথা ছিল তার। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই ফিরেছেন শূন্য হাতে। আকামা, পাসপোর্ট সব আছে। তারপরও পাসপোর্ট, মোবাইল সব কেড়ে নিয়ে গাড়িতে করে তাকে জেলে পাঠিয়ে দেয় সৌদি পুলিশ। সেখান থেকে শূন্য হাতে পাঠানো হয় দেশে।
প্রবাসীদের দাবি, তাদের বৈধ কাগজপত্র রয়েছে। তা সত্তে¡ও নানা অজুহাতে সৌদির কারাগারে পাঠানো হয় তাদের। সেখানে একই রুমে গাদাগাদি করে রাখা হয় কয়েকশ প্রবাসীকে। পরে তাদের জোরপূর্বক এক কাপড়ে দেশে ফেরত পাঠায় সৌদি সরকার।
সম্প্রতি এক কাপড়ে প্রায় আড়াই শতাধিক শ্রমিককে ফেরত পাঠিয়েছে সৌদি আরব। গত ৩০ এপ্রিল সাউদিয়া এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে এসব শ্রমিক ফেরত আসেন। ফিরে আসা এসব শ্রমিক ছয় থেকে দশ মাস আগে বৈধ কাগজপত্র নিয়ে রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে সৌদি আরবে গিয়েছিলেন। তাদের দেশে ফেরত পাঠিয়েছে সৌদি কর্তৃপক্ষ।
রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো মধ্যপ্রাচ্যে শ্রমিক পাঠানোর জন্য পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত নিয়ে থাকে। কিন্তু অনেক সময়ই দেখা যায় বিদেশে গিয়ে এসব শ্রমিক প্রতিশ্রুত কাজ পান না। এমনকি ওয়ার্ক পারমিট বদলের ভিজিট ভিসাতে অনেককে পাঠানো হয় সৌদিতে। ফলে অবধারিতভাবে তাদের ফিরে আসতে হয়।
সৌদি থেকে ফেরত আসা চট্টগ্রামের আনোয়ারার ফিরোজ মিয়া বলেন, একটি এজেন্সির মাধ্যমে বিদেশে গিয়েছিলাম। আকামাসহ সকল প্রকার বৈধ কাগজপত্র ছিল। তারপরেও দেশে ফেরত আসতে হয়েছে। নিজের কাছে তখনও এক টাকাও নেই। শাহজালাল এয়ারপোর্টে আসার অচেনা লোকজনের আর্থিক সহযোগিতায় গ্রামের বাড়িতে আসতে হয়েছে। সৌদি থাকাকালে বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তা ও সৌদি পুলিশের হাতপায়ে ধরেছি। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। দেশেই ফিরতে হয়েছে বলে জানান তিনি।
ফেরত পাঠানো একাধিক প্রবাসী জানান, বৈধ কাগজ নেই, এমন অভিযোগে জেলে প্রায় এক মাস ধরে আটকে রাখা হয়। পরে সেখান থেকে ফেরত পাঠানো হয়। দেশে ফেরত আসা একাধিক প্রবাসী শ্রমিকের দাবি এক রুমে প্রায় এক থেকে দেড়শ লোককে আটকে রাখা হয়। এসব শ্রমিকদের ১০ মাস থেকে ছয়-সাত বছর সৌদিতে থাকলেও তাদের অভিজ্ঞতা সুখকর নয়।
হযরত শাহজালাল আর্ন্তজাতিক বিমানবন্দরের আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জিয়াউল হক বলেন, প্রতিদিন অসংখ্য শ্রমিক দেশে প্রবেশ করছে। অনেক সময় তাদের প্রবাস জীবনের গল্প শুনে আমাদের খুব খারাপ লাগে। ফেরত আসা শ্রমিকদের আমরা বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করার চেষ্টা করি। কখনো এজেন্সির প্রতারণার বিরুদ্ধে আমরা আইনগত ব্যবস্থাও গ্রহণ করে থাকি।
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য