-->
বিশ্ব আদিবাসী দিবস আজ

সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবি আদিবাসী নেতাদের

নিখিল মানখিন
সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবি আদিবাসী নেতাদের

নিখিল মানখিন: সাংবিধানিক স্বীকৃতি নিয়ে বিপরীতমুখী অবস্থানে সরকার ও আদিবাসী নেতারা। সংবিধানের ১৫তম সংশোধনীতে আদিবাসী জনগণকে ইতোমধ্যে ‘উপজাতি, নৃগোষ্ঠী, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা বা সম্প্রদায়’ হিসেবে অভিহিত করেছে সরকার। সরকারি ঘোষণা প্রত্যাখ্যান করে সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবিতে লড়াই-সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন আদিবাসী নেতারা।

 

তারা অভিযোগ করেন, নানাভাবে ৯ আগস্ট বিশ্ব আদিবাসী দিবস পালনে নিরুৎসাহিত করে যাচ্ছে সরকার। প্রশাসনে এবং সরকারি পর্যায়ে এ ধারণা প্রবলভাবে প্রচার করা হয়েছে, বাংলাদেশে আদিবাসী নেই। দিবসটি যাতে পালন করতে না পারে, সেজন্য সরকার ২০১২ সালে আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকার জেলা প্রশাসক বরাবর লিখিত নির্দেশনা পাঠিয়েছিল। এ বছর নিষেধাজ্ঞা না দিলেও আদিবাসীদের দাবি নিয়ে সরকারের নতুন কোনো বক্তব্য নেই। এ অবস্থার মধ্য দিয়ে আজ বুধবার পালিত হচ্ছে বিশ্ব আদিবাসী দিবস।

 

আদিবাসী নেতারা জানান, বাংলাদেশে ৪৫টি জাতিসত্তার প্রায় ৩০ লাখ আদিবাসী রয়েছে। আদিবাসী হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছে পাহাড়ি ও সমতল অঞ্চলের বিভিন্ন আদিবাসী সংগঠন। দাবি আদায়ের লক্ষ্যে একের পর এক কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছে তারা। সংবিধান সংশোধনের লক্ষ্যে গঠিত বিশেষ কমিটির কাছে তারা নিজেদের দাবিদাওয়া পেশ করেন। স্বীকৃতি পাওয়ার আশায় তারা বুক বেধে ছিলেন।

 

কিন্তু আদিবাসীদের দাবি এড়িয়ে যায় সরকার। ২০১২ সালে আদিবাসী স্বীকৃতি নাকচ করে দিয়ে তৎকালীন আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদের বক্তব্যের প্রতিবাদ করে আদিবাসীরা। তারই ধাবাবাহিকতায় ২০১২ সালে একই বক্তব্য দেন তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি। ‘আদিবাসী’ বিষয়ে বর্তমান সরকারের অবস্থান তুলে ধরতে ২০১২ সালে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঘটা করে বিদেশি কূটনীতিক ও উন্নয়ন-সহযোগী গোষ্ঠী এবং দেশের প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সম্পাদক ও সিনিয়র সাংবাদিকদের পৃথক পৃথকভাবে ব্রিফিং করেন।

 

ব্রিফিংয়ে তিনি দেশের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিগুলোকে ‘আদিবাসী’ হিসেবে অভিহিত করতে বারণ করেন এবং পক্ষান্তরে তাদের ‘জাতিগত সংখ্যালঘু’ বা ‘উপজাতি’ (ট্রাইবাল) আখ্যায়িত করতে পরামর্শ দেন। ২০১২ সালে এ দুই মন্ত্রীর বক্তব্য যেন কাগজে-কলমে রূপ পায়। সংবিধানের ১৫তম সংশোধনীতে ৩০ লাখ আদিবাসীকে ‘উপজাতি, নৃগোষ্ঠী, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা বা সম্প্রদায়’ হিসেবে অভিহিত করে বর্তমান সরকার। তবে তা প্রত্যাখ্যান করেছে আদিবাসীরা।

 

এ বিষয়ে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) ভোরের আকাশকে জানান, সংবিধানে আদিবাসীদের উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃগোষ্ঠী ও সম্প্রদায় হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, আদিবাসী জনগণ তা প্রত্যাখ্যান করেছে। আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে হবে।

 

তিনি অভিযোগ করেন, আদিবাসীদের বিলুপ্ত করার চেষ্টা করছে শাসকগোষ্ঠী। রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বে সবসময়ই আদিবাসীদের প্রতি বৈরী মনোভাব কাজ করে। সংবিধান সংশোধন করে আদিবাসী জাতিগুলোর স্বীকৃতি প্রদান করতেই হবে। জাতিসংঘের সদস্যরাষ্ট্র হওয়া সত্তেও সরকার কখনো রাষ্ট্রীয়ভাবে আদিবাসী দিবস উদযাপন করেনি।

 

সরকার উগ্র জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির কারণে আদিবাসী জনগণের আত্মপরিচয়ের অধিকার অস্বীকার করেছে, যা দেশ-বিদেশে রাষ্ট্রের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করেছে। তিনি আরো বলেন, দেশের আদিবাসী জনগণের মানবাধিকার পরিস্থিতি ভালো নয়। তাদের ওপর সাম্প্রদায়িক হামলা, তাদের ভূমি জবরদখল ও উচ্ছেদ, ধর্ষণ, হত্যা, অপহরণসহ সহিংসতা বৃদ্ধি পেয়েছে।

 

তিনি বলেন, নির্বাচনী ইশতেহারে সমতলের আদিবাসীদের জন্য পৃথক ভূমি কমিশন গঠনের অঙ্গীকার করেও সরকার এ পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি, আদিবাসীর মতামতও নেয়া হয়নি। উন্নয়ন, পরিকল্পনা, পরিকল্পনা প্রণয়ন, গ্রহণ ও বাস্তবায়নে আদিবাসীর সিদ্ধান্ত নির্ধারণী কোনো ভূমিকা রাখার সুযোগ দেয় না সরকার। বরং উন্নয়নের নামে আদিবাসী জীবনধারা বিপর্যস্ত করে তোলা হয়। সন্তু লারমা আরো অভিযোগ করেন, নানা কৌশলে দেশের আদিবাসীকে পেছনে রেখে দেয়া হচ্ছে। ‘আদিবাসী’ পরিচয় নিয়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে বিতর্ক সৃষ্টি করা হচ্ছে।

 

সংবিধানে কোথাও বলা নেই, আদিবাসীদের ‘ আদিবাসী’ বলা যাবে না। তারপরও প্রশাসনে এবং সরকারী পর্যায়ে এ ধারণা প্রবলভাবে প্রচার করা হয়েছে, বাংলাদেশে আদিবাসী নেই। কেউ ইচ্ছে করলেই কোনো জাতিসত্তার পরিচয় বদলে দিতে পারে না। দেশে আদিবাসী ভূমি দখলের উৎসব চলছে। তিনি আরো বলেন, দেশে আদিবাসী ঘোষণাপত্রের আলোকে আদিবাসীর উন্নয়নে পদক্ষেপ গৃহীত হয়নি। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনে স্বীকৃত আদিবাসীদের প্রথাগত ভূমি অধিকার সরকার সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করে চলেছে।

 

শান্তিচুক্তির বিষয়ে সন্তু লারমা বলেন, সরকারের আন্তরিকতা ও সদিচ্ছার অভাবে চুক্তির মূল ধারাগুলো এখনো অবাস্তবায়িত রয়ে গেছে। সরকার চুক্তি বাস্তবায়নে একের পর এক প্রতিশ্রুতি দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু পার্বত্য জনগণ সরকারের প্রতিশ্রুতি শুনতে শুনতে এখন ক্লান্ত ও বিক্ষুব্ধ। তারা আর প্রতিশ্রুতি শুনতে চায় না, তারা চুক্তির প্রকৃত বাস্তবায়ন দেখতে চায়।

 

আদিবাসী দিবস সামনে রেখে ১০টি দাবি উত্থাপন করে সন্তু লারমা বলেন, আদিবাসী জাতিগুলোর অধিকার প্রতিষ্ঠায় এবং জীবনমান উন্নয়নে রাষ্ট্র ও সংশ্লিষ্ট সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি পূর্ণ বাস্তবায়ন করতে হবে এবং এ লক্ষ্যে সময়সূচিভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা বা রোডম্যাপ ঘোষণা করতে হবে। আদিবাসীর ঐতিহ্যগত ও প্রথাগত ভূমি অধিকারের স্বীকৃতি দিতে হবে। আদিবাসী অঞ্চলে সরকারি ও বেসরকারি কোনো উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণের পূর্বে আদিবাসীর স্বাধীন মতামত গ্রহণ এবং প্রকল্পে তাদের ফলপ্রসূ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।

 

পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন-২০১১ সংশোধন করতে হবে। মৌলভীবাজার জেলার ঝিমাই ও নাহার খাসিয়াপুঞ্জির আদিবাসীর ভূমি অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। জাতিসংঘ ঘোষিত ৯ আগস্ট আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসটি রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন করতে হবে।

 

ফোরামের সাধারণ সম্পাদক, কলামিস্ট সঞ্জীব দ্রং বলেন, মানবাধিকার লঙ্ঘন, ভূমি দখল, নিপীড়ন ও নির্যাতনের কারণে আদিবাসীর অস্তিত্বই হুমকির মুখে। আদিবাসী জনগণের সঙ্গে বাঙালি জনগণের সংহতি স্থাপন ও সম্পর্ক উন্নয়ন করতে হবে। সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় আদিবাসী জনগণের অংশগ্রহণ বৃদ্ধির লক্ষ্যে সংলাপ ও আলাপ-আলোচনার পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। দেশের জাতীয় উন্নয়নে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে চলমান ভূমিকা অব্যাহত রাখতে চায় আদিবাসীরা।

 

এদিকে বিশ্ব আদিবাসী দিবস উপলক্ষে আজ বুধবার সকাল ১০টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হবে সমাবেশ, র‌্যালি ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। ফোরামের সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমার (সন্তু লারমা) সভাপতিত্বে সমাবেশে প্রধান অতিথি থাকবেন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, এমপি এবং অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করবেন ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version