-->
শিরোনাম
টাঙ্গাইলে নৌকার গোপন মাঠ জরিপ

৮ এমপির আমলনামা জননেত্রীর হাতে

আ. রশিদ তালুকদার, টাঙ্গাইল
৮ এমপির আমলনামা জননেত্রীর হাতে

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে টাঙ্গাইলের আটটি সংসদীয় আসনে নৌকার জনপ্রিয় প্রার্থী বাছাইয়ে গোপনে মাঠ জরিপ চালাচ্ছে আওয়ামী লীগ। একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা এবং আওয়ামী লীগের বিভাগীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক টিমের নেতাদের সমন্বয়ে গঠিত কেন্দ্রীয় টিম অত্যন্ত গোপনে চূড়ান্ত ওই জরিপ পরিচালনা করছে।

 

ইতোপূর্বে পরিচালিত জরিপের আমলনামায় টাঙ্গাইলের ৮টি সংসদীয় আসনের মধ্যে চারটি আসনে দলীয় এমপির বিতর্কিত কর্মকান্ড, জনবিচ্ছিন্নতা, বিদ্রোহী প্রার্থীদের মদদদান এবং দলীয় দ্বন্দ্ব -কোন্দলে জড়িত থাকার বিষয়টি উঠে এসেছে। এতে ওই চারটি সংসদীয় আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী পরিবর্তন হতে পারে।

 

ফলে আগামী সংসদ নির্বাচনে টাঙ্গাইলের চার এমপির কপাল পুড়তে পারে। চূড়ান্ত মাঠ জরিপে টাঙ্গাইলের আটটি আসনেই নৌকার জনপ্রিয় প্রার্থী যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। জরিপে গত পাঁচ বছরে এমপিদের কর্মকান্ড ও আগামী ৩-৪ মাসে মাঠে রাজনৈতিক তৎপরতা এবং বিএনপিসহ তাদের মিত্রদের তৎপরতাকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলায় কৌশল ও দক্ষতাকে মূল্যায়ন করা হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কোনো ধরনের ঝুঁকি নিতে চায় না ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। টানা চতুর্থবারের মতো বিজয়ের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে নৌকার জনপ্রিয় প্রার্থী বাছাইয়ে সারা দেশে গোপন মাঠ জরিপের কাজ শুরু করেছে। এ গোপন মাঠ জরিপের কাজ মনিটরিং করছেন স্বয়ং আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

 

নির্বাচনে বিএনপি ও তাদের মিত্রদের অংশগ্রহণ ধরে নিয়ে আওয়ামী লীগ প্রতিটি আসনেই এবার শক্তিশালী প্রার্থীকে মনোনয়ন দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জনপ্রিয় প্রার্থী বাছাইয়ে চূড়ান্ত মাঠ জরিপে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা এবং আওয়ামী লীগের বিভাগীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক টিমের নেতারা অংশ নিচ্ছেন। টাঙ্গাইল জেলায় মাঠ পর্যায়ের গোয়েন্দা ও রাজনৈতিক টিমের সদস্যরা অত্যন্ত গোপনীয়তা বজায় রেখে জরিপ কাজ চালাচ্ছেন।

 

তারা জরিপের বিষয়ে মুখ খুলতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন। তবে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে যতটুকু জানা যায়, তার আলোকে জেলার আটটি আসনের এমপি সম্পর্কে অস্পষ্ট ধারণার সারসংক্ষেপ হচ্ছে টাঙ্গাইল-১ (মধুপুর-ধনবাড়ী) আসনের বর্তমান এমপি ডক্টর মো. আব্দুর রাজ্জাক সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী। এলাকার অবকাঠামোগত ব্যাপক উন্নয়ন করলেও মধুপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সঙ্গে দ্বন্দ্বের কারণে সহিংস ঘটনাও ঘটেছে।

 

দলীয় মনোনয়ন নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. ছরোয়ার আলম খান আবুর সঙ্গে দূরত্ব যোজন-যোজন। মধুপুর বড় উপজেলা হলেও ধনবাড়ীতে বেশি উন্নয়ন কাজ, প্রটোকল অনুযায়ী দলীয় নেতাকর্মীদের মূল্যায়ন না করে আত্মীয়করণ ইত্যাদি কারণে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও দ্বিধাবিভক্ত।

 

টাঙ্গাইল-২ (গোপালপুর-ভূঞাপুর) আসনের এমপি তানভীর হাসান ছোট মনির মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য। এ আসনের দলীয় মনোনয়ন নিয়ে গোপালপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ইউনুস ইসলাম তালুকদার ও ভূঞাপুর উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি পৌর মেয়র মাসুদুল হক মাসুদের সঙ্গে প্রকাশ্য দ্বন্দ্ব বিদ্যমান।

 

গোপালপুর ও ভূঞাপুর উপজেলায় সুষম উন্নয়ন না করা, ভূঞাপুরে অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠাস্থলে নামে-বেনামে জমি কিনে অধিগ্রহণে বিলম্বকরণ, নতুনদের অগ্রাধিকার দিয়ে ত্যাগী নেতাকর্মীদের মূল্যায়ন না করা, বালুঘাটের আধিপত্য নিয়ে বিরোধ ইত্যাদি কারণে দলীয় নেতাকর্মীরা কার্যত বিভক্ত। তারা দলের কেন্দ্রীয় কর্মসূচিও আলাদাভাবে পালন করে থাকে। এমপির বড় ভাই গোলাম কিবরিয়া বড়মনি নারী ঘটিত একটি মামলায় জেলহাজতে রয়েছেন। এ নিয়েও এমপি তানভীর হাসান ছোট মনিরের ইমেজ সংকট সৃষ্টি হয়েছে এলাকায় ব্যাপক সমালোচনার শিকার হয়েছেন।

 

টাঙ্গাইল-৩ (ঘাটাইল) আসনের এমপি আলহাজ আতাউর রহমান খান টাঙ্গাইলের খান পরিবারের অধিকর্তা সাবেক এমপি আমানুর রহমান খান রানার বাবা। তিনি এ আসনের এমপি হলেও উন্নয়নের কাজে সহায়তা কাজ তার ছেলে সাবেক এমপি জনপ্রিয় নেতা আলহাজ আমানুর রহমান খান রানা করেন।

 

উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শহিদুল ইসলাম লেবু ও সাবেক এমপি আলহাজ আমানুর রহমান খান ওরফে রানা গ্রুপের মধ্যে প্রকাশ্য দ্বন্দ্বের রয়েছে। উভয় গ্রুপের মধ্যে একাধিকবার সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে। আমানুর ইউপি নির্বাচনে প্রতিটি ইউনিয়নে দলীয় প্রার্থীর বিপক্ষে স্বতন্ত্র প্রার্থী দেয়া ও বাবা-ছেলে তাদের পক্ষে নির্বাচন করা ইত্যাদি কারণে জেলার রাজনীতিতে ব্যাপকভাবে সমালোচিত।

 

টাঙ্গাইল-৪ (কালিহাতী) আসনের এমপি মোহাম্মদ হাছান ইমাম খান সোহেল হাজারি বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য। কালিহাতী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোজহারুল ইসলাম তালুকদার ও সাধারণ সম্পাদক মো. আনোয়ার হোসেন মোল্লার সঙ্গে তার সম্পর্ক কখনো ভালো, কখনো বিরোধপূর্ণ। তিনি কালিহাতী উপজেলায় নিজস্ব রাজনৈতিক বলয় তৈরি করে বিতর্কিত হয়েছেন।

 

উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে তিনি নিজের পছন্দের লোকদের ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে পদায়ন করেছেন। ফলে উপজেলা আওয়ামী লীগের সঙ্গে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জেরে সম্মেলনের এক বছর পেরিয়ে গেলেও উপজেলা আওয়ামী লীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা হয়নি।

 

তার বিরুদ্ধে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগ বাণিজ্য, বালুঘাটের কমিশন বাণিজ্য, ঠিকাদারি কাজে ভাগবাটোয়ারা, উন্নয়ন কাজের পারসেন্টেজ নিয়ে বাবা-মায়ের নামে স্কুল প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি অভিযোগ রয়েছে। তার শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ নিয়ে আওয়ামী লীগের জনৈক নেতা হাইকোর্টে রিট পিটিশন দায়ের করায় নির্বাচনী এলাকায় ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে। এর প্রভাবে এলাকায় তার ইমেজ সংকট দেখা দিয়েছে।

 

টাঙ্গাইল-৫ (সদর) আসনের এমপি মো. ছানোয়ার হোসেন অনেকটা ক্লিন ইমেজ নিয়ে রাজনীতি শুরু করলেও সম্প্রতি প্রকাশ্যে কথিত খান পরিবারের পক্ষ অবলম্বন করায় স্থানীয় রাজনীতিতে বিতর্কিত হয়ে পড়েছেন। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি একুশে পদকপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা ফজলুর রহমান খান ফারুক সম্পর্কে বেফাঁস মন্তব্য করে ব্যাপক সমালোচিত হয়েছেন আওয়ামী লীগের জেলা নেতাদের বিরাগভাজন হয়েছেন। খান পরিবারের কর্মী-সমর্থকদের নানা সুযোগ-সুবিধা দিয়েছেন। উন্নয়ন কাজে ও ইউনিয়ন পর্যায়ে আওয়ামী লীগের পদ-পদবিতে খান পরিবার ঘেঁষাদের সুযোগ ও পদায়নে প্রভাব বিস্তার করেছেন। ইউপি নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে কোন কোন ইউনিয়নে স্বতন্ত্র বা বিদ্রোহী প্রার্থীকে বিজয়ী করতে জোরালো ভ‚মিকা রেখে বিতর্কিত হয়েছেন।

 

টাঙ্গাইল-৬ (নাগরপুর-দেলদুয়ার) আসনের এমপি আহসানুল ইসলাম টিটু সরকারি হিসাব কমিটির সদস্য। এ আসনে একাধিক দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সঙ্গে তার বিরোধ রয়েছে। নাগরপুর-দেলদুয়ার উপজেলার সুষম উন্নয়নে তিনি ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। নাগরপুর উপজেলার তুলনায় দেলদুয়ারে প্রায় অর্ধেক বা তারও কম উন্নয়ন কাজ হয়েছে।

 

নাগরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জাকিরুল ইসলাম উইলিয়াম ও সাধারণ সম্পাদক কুদরত আলীর সঙ্গে নানা বিষয় নিয়ে দলীয় কোন্দল রয়েছে। সেই কোন্দল দলের তৃণমূলে ছড়িয়ে পড়ছে। দেলদুয়ার উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ফজলুল হকের সাথে সুসম্পর্ক থাকলেও সাধারণ সম্পাদক এম শিবলী সাদিকের সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পর্ক সাপে-নেউলে। ইউনিয়ন পর্যায়ের রাজনীতিতে তিনি প্রভাব বিস্তার না করলেও উন্নয়ন কাজে নেতাকর্মীদের সম্পৃক্ত না করায় সমালোচনার শিকার হয়েছেন।

 

টাঙ্গাইল-৭ (মির্জাপুর) আসনের এমপি খান আহমেদ শুভ ভূমি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য। তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি একুশে পদকপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা ফজলুর রহমান খান ফারুকের একমাত্র ছেলে। গত বছরের ১৬ নভেম্বর এ আসনে চারবারের সংসদ সদস্য, সড়ক পরিবহন এবং সেতু মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. একাব্বর হোসেন মারা যান। এ বছরের ১৬ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত উপনির্বাচনে তিনি দলীয় মনোনয়নে এমপি নির্বাচিত হন।

 

এ আসনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একাধিক শক্তিশালী মনোনয়নপ্রত্যাশী থাকায় বর্তমান এমপি খান আহমেদ শুভ একপ্রকার চাপের মুখে রয়েছেন। তিনি উপজেলা আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী এবং ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠনের নেতাকর্মীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করছেন।

 

টাঙ্গাইল-৮ (সখীপুর-বাসাইল) আসনের এমপি জোয়াহেরুল ইসলাম প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য। তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। সখীপুর উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি শওকত শিকদার ও সাধারণ সম্পাদক সাবেক এমপি অনুপম শাজাহান জয়ের সঙ্গে তার বিরোধ স্পষ্ট। বাসাইল উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মতিউর রহমান গাউস তার প্রতি নাখোশ। চায়না কোম্পানিতে মাটি সরবরাহ ও ফসলি জমি কেটে লেকভিউ নামে প্রকল্প বাস্তবায়ন করার নামে কমিশন বাণিজ্য নিয়ে বাসাইল উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অলিদ ইসলামের সঙ্গে তার দ্বন্দ্বে চরম পর্যায়ে।

 

সখীপুর ও বাসাইল উপজেলায় উন্নয়নের কাজে বৈষম্য, ইউপি নির্বাচনে মনোনয়ন বাণিজ্য ও আত্মীয়করণ, নিজস্ব বলয়ের লোক দিয়ে উন্নয়ন কাজ বাস্তবায়ন, তৃণমূলের ত্যাগী নেতাদের মূল্যায়ন না করা ইত্যাদি কারণে এ আসনে তিনি বিতর্কিত।

 

সূত্রগুলো মতে, ইতোপূর্বের জরিপে টাঙ্গাইলে আওয়ামী লীগের এমপিদের নামে অভিযোগের মধ্যে ইউপি নির্বাচনে নৌকার মনোনয়ন পাওয়া নেতাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া, ‘এমপিবলয়’ সৃষ্টি, বিদ্রোহীদের পক্ষে অবস্থান নিয়ে দলের অভ্যন্তরে কোন্দল সৃষ্টির বিস্তারিত অভিযোগ জমা পড়ে আওয়ামী লীগ সভাপতির দপ্তরে।

 

আওয়ামী লীগের বিভাগীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক টিমের নেতারাও এসব বিষয়ে দলীয় এমপিদের নিয়ে মৌখিক ও প্রতিবেদন আকারে লিখিতভাবে নানামুখী অভিযোগ জমা দিয়েছেন। তৃণমূলের ওইসব অভিযোগপত্র এখন আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার টেবিলে।

 

এর মধ্যে টাঙ্গাইলের চারটি আসনের এমপির বিরুদ্ধে অভিযোগ গুরুতর। অভিযোগগুলোর সত্যতা নিরূপণে গোপনে মাঠ থেকে তথ্য সংগ্রহের কাজ শুরু হয়েছে। এতে আগামী নির্বাচন সামনে রেখে ফেঁসে যেতে পারেন টাঙ্গাইলের একাধিক সংসদ সদস্য।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version