নিখিল মানখিন: আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকেন্দ্রিক সৃষ্ট সংকট সমাধানে দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে সমঝোতার কোনো লক্ষণ নেই। নিজেদের অবস্থানে অনড় রয়েছে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন হতে দেবে না বলে ঘোষণা দিয়ে এক দফা আন্দোলনে রয়েছে বিএনপি। আর বিদ্যমান সংবিধানের মধ্যে থেকেই নির্বাচন করতে অনড় রয়েছে আওয়ামী লীগ। ফলে সামনের দিনগুলোয় দেশে সংঘাতময় পরিস্থিতির আশঙ্কা করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে প্রধান দুটি দলের মধ্যে রাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়ছে। বিএনপি এক দফা আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছে। এক দফা দাবিতে তারা আগস্টজুড়েই কিছু কিছু কর্মসূচি পালন করে চলেছে। সেপ্টেম্বরে তারা সরকারকে বড় ধরনের ধাক্কা দিতে চায়।
বিএনপির একাধিক নেতার সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, সেপ্টেম্বরে তারা কিছু নিত্যনতুন কর্মসূচির মাধ্যমে সরকারকে টালমাটাল করে দেবে। কর্মসূচিগুলোর কথা বিএনপি নেতারা ভাবছেন এবং অত্যন্ত গোপনীয়তার মাধ্যমে তারা আন্দোলনের কর্মসূচি চ‚ড়ান্ত করছেন।
বিএনপি নেতারা নিশ্চিত করেছেন, সেপ্টেম্বরজুড়ে তারা সরকারকে দম ফেলার সুযোগ দেবে না এবং এরকম একটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমেই তারা সরকারকে পতন করবে। বিএনপির বিভিন্ন নেতারা বলছেন, সেপ্টেম্বরে যদি তারা একটি অস্থির পরিস্থিতি তৈরি করে সরকারকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায়ে বাধ্য করতে পারে, তাহলে তারা আন্দোলনে বিজয়ী হবে। অর্থাৎ এক মাসের একটি টর্নেডো দিয়ে বিএনপি সরকারকে হটাতে চায়।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তফসিল ঘোষণা হতে পারে আগামী নভেম্বর মাসে। তাই অক্টোবরের মধ্যেই আন্দোলনে পূর্ণ শক্তি চায় বিএনপি। সেভাবে কৌশল ঠিক করছে দলটি। বিএনপির শীর্ষনেতৃত্ব থেকে নেতাকর্মীদের এমন বার্তা দেয়া হচ্ছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া এবার যেন আওয়ামী লীগ একতরফা নির্বাচনের দিকে যেতে না পারে, সে পরিস্থিতি তৈরি করা হবে বিএনপির নেতাকর্মীরা জানিয়েছেন।
তবে আগস্টে আবার গণমিছিল-পদযাত্রা কর্মসূচি নিয়ে এক দফার যুগপৎ আন্দোলনে ফিরে আসে বিএনপি। সেই আন্দোলনকে সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরের মধ্যে চ‚ড়ান্ত ধাপে নিয়ে যেতে চাইছে বিএনপি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, যদিও সেপ্টেম্বরে সরকার পতনের এক দফা দাবিতে কী ধরনের কর্মসূচি আসতে পারে, সে বিষয়ে শীর্ষনেতারা খোলাসা করে কিছু বলছেন না।
তবে দলটির একটি সূত্র জানায়, আগস্ট মাসে সমাবেশ, বিক্ষোভ ও পদযাত্রার মতো কর্মসূচিতে সীমাবদ্ধ থাকলেও সেপ্টেম্বরের শুরু থেকেই ফের রাজধানীর প্রবেশমুখে অবস্থান, ঢাকা ঘেরাও, সচিবালয় ঘেরাও এবং লাগাতার অবস্থান কর্মসূচির মতো কঠোর কর্মসূচিতে যাবে বিএনপি। তবে এসব কর্মসূচিতে অতীতের মতো আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং সরকার সমর্থকদের বাধার সম্মুখীন হলেও রাজপথে মোকাবিলা করার নির্দেশনা দেয়া হবে বলে জানা গেছে।
মাঠ দখলে রাখবে আওয়ামী লীগ: আওয়ামী লীগ নির্বাচনমুখী রাজনীতিতেই অটল থাকতে চায়, যত বিদেশি চাপ বা হস্তক্ষেপ হোক না কেন, আওয়ামী লীগ সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রেখে নির্বাচনের পথে এগোনোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গত ৬ আগস্ট আওয়ামী লীগের সভাপতি কেন্দ্রীয় কমিটির বর্ধিত সভায় নির্বাচনের ব্যাপারে সুস্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন। এখান থেকে পিছু হটার কোনো উপায় নেই বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগের নেতারা।
সংবিধান অনুযায়ী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যাওয়ার বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছে আওয়ামী লীগ। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সেপ্টেম্বরের শুরুতেই ঢাকায় নিজেদের সাংগঠনিক শক্তি দেখাবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এজন্য ১ সেপ্টেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ছাত্রলীগের সমাবেশ এবং পরদিন আগারগাঁওয়ে পুরোনো বাণিজ্য মেলা মাঠে সুধী সমাবেশ করবে আওয়ামী লীগ। এ দুটি সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বক্তব্য দেবেন। সমাবেশ দুটিতে সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে বড় জমায়েত দেখানোর পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ছাত্রলীগের সমাবেশে সারা দেশ থেকে তরুণ ও যুবকদের আনতে এক মাস ধরে প্রস্তুতি চলছে। অন্যদিকে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগের উদ্যোগে আগারগাঁওয়ের সুধী সমাবেশে ঢাকা বিভাগের সব জেলা থেকে নেতাকর্মীরা অংশ নেবেন। মূলত ঢাকা উড়ালসড়ক (এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে) উদ্বোধনের পর এ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে।
আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের সূত্র জানায়, এবারের দুটি সমাবেশে বড় জমায়েত নিশ্চিত করতে সংগঠনের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে তৃণমূল পর্যন্ত কড়া বার্তা দেয়া হয়েছে। ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সাংগঠনিক ইউনিটকে নির্ধারিত সংখ্যায় লোকসমাগম করতে বলা হয়েছে। কম জনবল নিয়ে এলে সাংগঠনিকভাবে জবাবদিহি করতে হবে। বেশি লোক আনতে পারলে পুরস্কার দেয়ার কথা উল্লেখ করে চিঠি দেয়া হয়েছে। একইভাবে সুধী সমাবেশে বড় লোকসমাগম ঘটাতে জেলা নেতা ও দলীয় জনপ্রতিনিধিদের লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দেয়া হয়েছে।
আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র জানায়, গত ২৮ জুলাই বিএনপি পল্টনে যে মহাসমাবেশ করে, তাতে বিপুল লোকের জমায়েত হয়। এরপর থেকেই বড় জমায়েতের চাপ অনুভব করে আওয়ামী লীগ। প্রথমে ২ আগস্ট রংপুরে বড় সমাবেশ করে আওয়ামী লীগ। সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে ঢাকাসহ সারা দেশে অন্তত ১০টি বড় সমাবেশ করার পরিকল্পনা আছে ক্ষমতাসীন দলের।
আ.লীগ ও বিএনপি নেতাদেরবাগযুদ্ধ: বাগযুদ্ধের মাধ্যমেও একে-অপরকে আঘাত করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের নেতারা। দলীয় বক্তব্য দিতে গিয়ে ব্যক্তিগত বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতেও দ্বিধা করছেন না তারা। গত ২৬ আগস্ট মিরপুর গোলারটেক মাঠে ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের আয়োজনে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, বিএনপির দফা আর আন্দোলন সবই ভুয়া। দেশ বাঁচাতে হলে আগামী নির্বাচনে শেখ হাসিনার কোনো বিকল্প নেই। এদেশের জনগণও চায় না শেখ হাসিনা পদত্যাগ করুক, সংসদ বিলুপ্তি কিংবা তত্ত্বাবধায়ক সরকার।
শেখ হাসিনা হারলে বাংলাদেশ হেরে যাবে, গরিব মানুষ হেরে যাবে, স্বাধীনতা হেরে যাবে। তাই তাকে বিজয়ী করতে হবে। তিনি হেরে গেলে বাংলাদেশর উন্নয়ন হেরে যাবে। তাই সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। আমরা খালি হাতে লড়ব। তবে আগুন হাতে এলে আমরা তা শক্ত হাতে প্রতিহত করব।
বিএনপিকে ভোট দিলে এরা বাংলাদেশকে পাকিস্তান-আফগানিস্তান বানাবে উল্লেখ করে সেতুমন্ত্রী বলেন, ফাইনাল খেলা হবে ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে। খালি হাতে লড়ব। তবে যেই হাতে আগুন আসবে, সেই হাত পুড়িয়ে দেব। যেই হাতে লাঠি আসবে, সেই হাত ভেঙে দেব।
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম বলেন, ‘তারেক রহমান বিদেশের মাটিতে বসে বাংলাদেশ নিয়ে ষড়যন্ত্র করছে। শুনলাম বিএনপি নাকি ঘোষণা দিয়েছে, আগামী সেপ্টেম্বরে তারা শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করবে। এমন ঘোষণা তারা (বিএনপি) আগেও দিয়েছে। কিন্তু তাদের সেই আল্টিমেটাম বাস্তবায়িত হয়নি। এবারো হবে না। আমরা জনগণকে সঙ্গে নিয়ে তাদের সব ষড়যন্ত্র প্রতিহত করব।’
সম্প্রতি বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাদের চূড়ান্ত অবস্থান হলো, আমরা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনে যাব না। এ এক দফা দাবি আদায়ে আমরা দেশের মানুষকে সম্পৃক্ত করার কর্মসূচি নিয়েই এগিয়ে যাব। তবে মাঠের পরিস্থিতি কী হয়, তা পর্যালোচনা করেও প্রয়োজনীয় কর্মসূচি নেয়া হবে।’
সারা দেশের নেতাকর্মীরা সার্বক্ষণিকভাবে সজাগ আছে জানিয়ে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল সাংবাদিকদের বলেন, ‘যেকোনো বিরূপ পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুত। সরকার যত অত্যাচারই করুক সফল হবই।’
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য