মোতাহার হোসেন: আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠু করার সবরকম প্রস্তুতি নিয়েছে সরকার ও নির্বাচন কমিশন। ইতোমধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ নিয়ে কয়েক দফা বৈঠক করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থার সঙ্গে। সরকার নির্বাচনকে শতভাগ সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ করার লক্ষ্যে সবরকম অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে দেশব্যাপী সাঁড়াশি অভিযানের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
একই সঙ্গে চিহ্নিত সন্ত্রাসী, অবৈধ অস্ত্র ব্যবসায়ী ও অস্ত্র কারবারীদের আইনের আওতায় আনা হবে। পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর মাঠের আন্দোলন-সমাবেশের নামে যাতে জনগণের জানমালের ক্ষতিসাধন করতে না পারে, সেদিকে কড়া নজর থাকবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। অনুরূপ কড়া নজরদারিতে রয়েছে মাদক কারবারি, পাচারকারীরা। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
সূত্র জানায়, নির্বাচন কেন্দ্র করে সহিংসতার আশঙ্কা সব সময় থেকেই যায়। নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে তাই বাড়ছে অবৈধ অস্ত্র নিয়ে উদ্বেগ। পুলিশ, র্যাব, বিজিবিসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী প্রায়ই অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করছে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে। নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে কথা বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিশেষ অভিযানও শুরু করবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। ইতোমধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়মিত অভিযানে উদ্ধার হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের অবৈধ অস্ত্র।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নির্বাচনের সময়, নির্বাচনের আগে ও পরে অবৈধ অস্ত্র ব্যবহারের কারণে খুনোখুনি ও দাঙ্গা-হাঙ্গামা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে সারা দেশে বিশেষ অভিযানের পরিকল্পনাও করছেন নীতিনির্ধারকরা।
পুলিশ সদর দপ্তরের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলেছেন, অবৈধ অস্ত্রের বিরুদ্ধে সারা দেশে নিয়মিত অভিযান চলমান। তবে নির্বাচনকেন্দ্রিক বিশেষ অভিযানের প্রস্তুতি শুরু করা হয়েছে। জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হলেই অবৈধ অস্ত্রের বিরুদ্ধে সারা দেশে সাঁড়াশি অভিযান শুরু করা হবে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের চেয়ে এবার মিয়ানমার থেকে অবৈধ অস্ত্রের জোগান বেশি দেয়া হতে পারে। সে আশঙ্কা ও গোপন তথ্য থেকে কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্পসহ সীমান্তের কিছু এলাকায় নিয়মিত অভিযান চলছে। এছাড়া বিভিন্ন বাহিনীর অভিযানে প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন স্থানে নানা ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধারের খবর দেখা যাচ্ছে গণমাধ্যমগুলোতে। পুলিশ, এপিবিএন ও র্যাবের অভিযান চলমান বলেও জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
পুলিশ সদর দপ্তরের একটি সূত্র জানায়, ২০২২ সালে দেশে উদ্ধার করা অবৈধ অস্ত্রের সংখ্যা ছিল পাঁচ হাজার ৮৭৯টি। এই সময় অস্ত্র মামলা হয়েছে এক হাজার ৫৪০টি। একই সঙ্গে এলিট ফোর্স র্যাব ২০২২ সালে এক হাজার ৩৯৪টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করে। ২০২১ সালে উদ্ধার করে ৯৬৯টি অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র। আগের বছর ২০২০ সালে উদ্ধার করে ৮৪৬টি। র্যাবের এই পরিসংখ্যান থেকেও অবৈধ অস্ত্রের চাহিদা, ব্যবহার ও উদ্ধার বাড়ার চিত্র পাওয়া যায়।
২০২২ সালে উদ্ধার করা অস্ত্রের মধ্যে একে-৪৭ (এসএমজি), একে-২২, রকেট লাঞ্চারের মতো বিধ্বংসী অস্ত্রও রয়েছে। ওই বছর সংস্থাটি ২২১টি বিদেশি রিভলবার, পিস্তল, ৪৫টি দেশি রিভলবার ও পিস্তল উদ্ধার করে। গোলাবারুদ উদ্ধার করে সাত হাজার ১৩৬টি। বিস্ফোরক উদ্ধার করে ৫৫ কেজি এবং গ্রেনেড উদ্ধার করে ১৫টি। অস্ত্র কেনাবেচায় সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয় ৫২১ জনকে। এছাড়া অস্ত্র রাখার অভিযোগে ১১ জন ও বিস্ফোরক সরবরাহ করার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয় ৮৬ জনকে।
বিজিবির ১০ বছরের অস্ত্র উদ্ধারের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত কয়েক বছরে বেড়েছে রাইফেল, রিভলবার, পিস্তল, বন্দুক ও গুলি চোরাচালান। এর মধ্যে গত বছর সর্বোচ্চ ৯টি এবং চলতি বছর এ পর্যন্ত দুটি রাইফেল জব্দ করা হয়েছে। গত বছর পাঁচটি রিভলবার জব্দ করা হয়, যা ছয় বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। অবশ্য এবছর শুধু ফেব্রুয়ারিতে একটি রিভলবার ধরা পড়েছে। ক্ষুদ্রাস্ত্রের মধ্যে পিস্তল চোরাচালান হয় সবচেয়ে বেশি।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া অ্যান্ড পিআর শাখার উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মো. ফারুক হোসেন বলেন, গত ১৯ আগস্ট লালবাগ থানা এলাকায় অভিযান চালিয়ে আগ্নেয়াস্ত্র ও গুলিসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদল ও কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের ছয় নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় তাদের কাছ থেকে তিনটি অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র ও ৩৬ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়। অবৈধ অস্ত্রের বিরুদ্ধে ডিএমপির ৫০ থানাসহ ৮টি গোয়েন্দা ইউনিটের নিয়মিত অভিযান চলমান। জাতীয় নির্বাচন কেন্দ্র করে নির্দেশনা পেলে বিশেষ অভিযান শুরু হবে।
র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, নির্বাচনের আগে অস্ত্র চোরাকারবারিদের দৌরাত্ম্য বেড়ে যেতে পারে। বর্তমানে মাঠে যে নির্বাচনী উত্তাপ আছে তার চেয়ে সামনের দিনগুলো আরো কঠিন হতে পারে, তবে র্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর। এ বিষয়ে গোয়েন্দারা মাঠে কাজ করছেন। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে অভিযান চালিয়ে ৪৩৩টি অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র আটক করে র্যাব। এতে জড়িত অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয় ১৪৯ জনকে। এই অবৈধ অস্ত্রের ২৪২টি উদ্ধার হয়েছে শুধু মে মাসেই।
সম্প্রতি কক্সবাজারের টেকনাফের দুর্গম পাহাড়ে গড়ে তোলা হয়েছিল অস্ত্রের কারখানা ও ডাকাত দলের আস্তানা। সেখান থেকে পরিচালনা করা হতো নানা সন্ত্রাসী কার্যক্রম। শুক্রবার (১৮ আগস্ট) টেকনাফের রঙ্গীখালী পাহাড়ে অভিযান চালিয়ে অস্ত্র তৈরির কারখানা থেকে ফয়সাল বাহিনীর প্রধান ফয়সাল ও তার পাঁচ সহযোগীকে আটক করে র্যাব। এ সময় দুটি একনলা বড় বন্দুক, চারটি এলজি, ৭ রাউন্ড শর্টগানের কার্তুজ, ১০ রাউন্ড রাইফেলের কার্তুজ, একটি ড্রিল মেশিন, অস্ত্র তৈরির সরঞ্জামসহ তিনটি স্মার্টফোন উদ্ধার করা হয়।
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের হারুনুর রশীদ বলেন, সম্প্রতি অস্ত্রসহ বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদে অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। আর কয়েক মাস পরে নির্বাচনের ডামাডোল বাজবে। রাজনৈতিক দলগুলো তাদের বিভিন্ন প্রোগ্রাম করবে। সেই মুহূর্তে একটা গ্রুপ ১১টি অবৈধ অস্ত্র সংগ্রহ করেছে। সবগুলো বিষয় বিবেচনা করে তদন্ত চলছে। নির্বাচন সামনে রেখে অবৈধ অস্ত্রধারী তারা যে দলই করুক তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।
পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি (অপারেশন) মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, অবৈধ অস্ত্রের বিরুদ্ধে পুলিশের নিয়মিত অভিযান চলমান। এছাড়া সবগুলো ইউনিটকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে এবং প্রতিনিয়ত পুলিশ সদর দপ্তর থেকে মনিটরিং করা হচ্ছে। যারাই অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার করবে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য