শাহীন রহমান: জি-২০ সম্মেলনের আগে গত শুক্রবার বিকেলে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে বসেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদি। দুই দেশের এই বৈঠককে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তুলনা করেছেন রক্তের সম্পর্ক হিসেবে। জানা গেছে, দেড় ঘণ্টাব্যাপী এই বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের জাতীয় নির্বাচন নিয়ে আমেরিকার হস্তক্ষেপ ও চাপের কথা তোলেন।
একই সঙ্গে তিনি মোদিকে জানিয়েছেন চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক নিতান্তই বাণিজ্যিক ও আর্থিক। রক্তের সম্পর্ক মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গী ভারতের সঙ্গেই। তবে নির্বাচন নিয়ে দুই নেতার কী কথা হয়েছে প্রশ্ন করা হলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন বলেছেন, নির্বাচন নিয়ে কোনো কথা হয়নি।
বৈঠকে দুই দেশের মধ্যে তিনটি সমঝোতাপত্র স্বাক্ষর হয়েছে। কৃষি ক্ষেত্রে গবেষণায় সহযোগিতার জন্য ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব রিসার্চ এবং বাংলাদেশ এগ্রিকালচারাল রিসার্চ কাউন্সিল একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এ ছাড়া দুই দেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক বিনিময় এবং দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য সংক্রান্ত চুক্তিপত্রে সই হয়েছে।
যদিও আব্দুল মোমেন জানিয়েছেন, তাদের সামনে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে কোনো কথা হয়নি। তবে তিনি এটাও জানিয়েছেন, কিছুক্ষণ প্রধানমন্ত্রী মোদি ও শেখ হাসিনা একান্তে আলোচনাও করেছেন। এই একান্ত বৈঠকে কি বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে কথা হয়েছে? মোমেন বলেছেন, তিনি এ বিষয়ে কিছু জানেন না।
দুই দেশের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের মধ্যে বৈঠকের পর বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা বলেন, এটা বুঝতে হবে যে ঢাকা ও দিল্লির মধ্যে কখনো কোনো ভুল বোঝাবুঝি ছিল না, এখনো নেই। দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে আলোচনায় সেই জিনিসটাই আরো একবার পরিষ্কার হয়ে গেছে।
বৈঠকের পরে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন সাংবাদিকদের বলেন, আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার বিষয়টিকেই তারা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছেন। ভারতও এই বিষয়টিতে একমত। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই বক্তব্যে স্পষ্ট যে, বিগত দেড় দশকে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার দেশে যে শান্তি ও স্থিতিশীলতা এনে দিয়েছে, তাকে হুমকি-ধমকি দিয়ে অপসারণের চেষ্টা করা হলে সেটা এ অঞ্চলে অস্থিরতা ডেকে আনবে।
অতীতের অভিজ্ঞতা বলে সে ক্ষেত্রে ধর্মীয় মৌলবাদের প্রসার ঘটবে, নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে। এই মূল্যায়নের সঙ্গে ভারতের একমত না হওয়ার কোনো কারণই নেই। আর তারা সেটা বাংলাদেশকে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়েও দিয়েছে।
বৈঠকে ভারতীয় কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বাংলাদেশে গণতন্ত্রের স্বার্থেই নির্বাচন প্রক্রিয়া যাতে কোনোভাবে প্রশ্নবিদ্ধ না হয় এবং আন্তর্জাতিক বিশ্ব যাতে তা নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলার সুযোগ না পায় সেটাও নিশ্চিত করাটা খুব জরুরি। দুই নেতার মধ্যে আলাপে এই প্রসঙ্গটাও এসেছে। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশে কিন্তু ভারত একটি ‘বন্ধুত্বপূর্ণ সরকারকেই’ দেখতে চায় আর সেটা নিয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশই নেই।
দিল্লিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্রমতে, পৃথিবীর সব দেশই চায় নিজেদের চারপাশে বন্ধু সরকার ক্ষমতায় থাকুক। আমরাও একই জিনিস চাই, তাতে তো কোনো অন্যায় নেই! আর কারা আমাদের বন্ধু, কারা ততটা নয় সেটা চিনতে পারার ক্ষমতা তো আমাদের আছে, তাই না? দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে আলোচনাতেও ঠিক এই বার্তাটাই ভারতের পক্ষ থেকে দেয়া হয়েছে বলে দিল্লি পরিষ্কার করে দিয়েছে।
শুক্রবার বৈঠকের আগে বাড়ির দরজায় এসে হাসিমুখে হাসিনাকে অভ্যর্থনা জানান মোদি। গোটা বৈঠকটিই হয়েছে ইতিবাচক উষ্ণ আবহে। উপস্থিত ছিলেন ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেনসহ দুই দেশে কর্মকর্তারা।
গত শুক্রবার দুপুরে ৩ দিনের সফরে দিল্লি সফরে গেছেন শেখ হাসিনা। দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের পরে নিজের এক্স (সাবেক টুইটারে) মোদি বাংলায় লিখেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। গত ৯ বছরে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের অগ্রগতি খুবই সন্তোষজনক। আলোচনায় বাণিজ্যিক সংযোগ, সার্বিক সংযুক্তি এবং আরো অনেক বিষয় অন্তর্ভুক্ত ছিল। সে দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে বলা হয়েছে দুই নেতার মধ্যে আলোচনা হয়েছে আন্তরিক এবং খোলামেলা পরিবেশে। পারস্পরিক আস্থা, বিশ্বাস এবং মৈত্রীর প্রতিফলন ঘটেছে দুই রাষ্ট্রপ্রধানের আলোচনায়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকের কিছুক্ষণ পরেই আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে বৈঠকে বসেন মোদি। বাইডেনের সঙ্গে তার আলোচনা হয়েছে আন্তর্জাতিক ভূকৌশলগত পরিস্থিতির পাশাপাশি আঞ্চলিক পরিস্থিতি নিয়েও।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন পরে সাংবাদিকদের বলেন, আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশের জন্য এবং গোটা দক্ষিণ এশিয়ার জন্য মঙ্গলজনক। এ বিষয়ে ভারতও একমত। শেখ হাসিনার গত সাড়ে চৌদ্দ বছরের শাসনকালে আওয়ামী লীগ সরকারের উন্নয়নের কথা বলেছেন। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াতে ইসলামীর জঙ্গি-সন্ত্রাস ও গ্রেনেড হামলার বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেছেন।
তবে জানা গেছে, দুই নেতার মধ্যে আলোচনায় শেখ হাসিনা দেশের নির্বাচন নিয়ে পশ্চিমের তৈরি করা প্রবল চাপের কথা উল্লেখ করেছেন মোদির কাছে। জানিয়েছেন, এর ফলে আঞ্চলিক অসাম্য এবং সন্ত্রাসবাদ উৎসাহ পাবে। চীনের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টিও স্পষ্ট করেছেন।
জানা গেছে বাংলাদেশের ‘গণতান্ত্রিক পরম্পরা ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার’ প্রতি ভারত বহু বছর ধরে যে জোরালো সমর্থন দিয়ে আসছে তা আগামী দিনেও পুরোপুরি অব্যাহত থাকবে বলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আশ্বস্ত করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। বাংলাদেশের শান্তি ও স্থিতিশীলতা বিঘ্নিত হলে সমগ্র দক্ষিণ এশিয়াতেই তার বিরূপ প্রভাব পড়বে বলে শেখ হাসিনা যে বক্তব্য তুলে ধরেন, এর সঙ্গেও নরেন্দ্র মোদি সম্পূর্ণ সহমত পোষণ করেছেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এবারের ভারত সফরের ‘টাইমিং’টাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন কূটনীতিকরা। কারণ ডিসেম্বরের শেষে বা জানুয়ারির গোড়াতেই সাধারণ নির্বাচন। গত তিনটি মেয়াদেই আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারকে অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়ে এসেছে ভারত। ফলে এবারের নির্বাচনের আগে ভারত ঠিক কী ধরনের অবস্থান নেয় সেদিকেও পর্যবেক্ষদের সতর্ক নজর থাকছে।
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য