-->
শিরোনাম

মালয়েশিয়া থেকে পাচার হওয়া নারীর আকুতি

ইমরান খান
মালয়েশিয়া থেকে পাচার হওয়া নারীর আকুতি

ইমরান খান: ‘আমাকে এখানে নির্যাতন করা হচ্ছে। খারাপ কাজে বাধ্য করা হচ্ছে। তারা আমাকে ধর্ষণ করেছে। আমাকে দেশে ফেরানোর ব্যবস্থা করো। আমাকে বাঁচাও।’ মালয়েশিয়া থেকে মুঠোফোনে পরিবারের কাছে এভাবেই সেখানে হওয়া নির্যাতনের বর্ণনা দিয়েছেন মালয়েশিয়ায় পাচারের শিকার এক নারী। নিজেকে বাঁচানোর আকুতি জানিয়েছেন পরিবারের কাছে।

 

যে রুমে তাকে আটকে রাখা হয়েছে, সেখান থেকে গোপনে একটি ভিডিও ধারণ করে পরিবারের কাছে পাঠিয়েছেন সেই তরুণী। ভিডিওটিতে দেখা গেছে, রুমজুড়ে আরো কিছু মেয়েকে আটকে রাখা হয়েছে সেখানে। এছাড়া ভিডিওতে রুমে থাকা কনডমের বাক্স পরিবারকে দেখিয়ে পরিবারকে নিজের করুণ অবস্থা জানান দেয়ার চেষ্টাও করেছেন মালয়েশিয়ায় পাচার হওয়া সেই নারী।

 

জানা গেছে, গত ২৭ আগস্ট ৫০ হাজার টাকা বেতনে চাকরি দেয়ার কথা বলে মালয়শিয়ায় নিয়ে যাওয়া হয় রাজধানীর পল্লবীর ওই নারীকে। এক টাকাও খরচ লাগবে না এমন প্রলোভনে নিজের অজান্তেই পাচারকারীদের ফাঁদে পড়ে যান তিনি। মেয়ে অতিরিক্ত অর্থ উপার্জন করবে এমন লোভে মেয়েকে মালয়েশিয়ায় পাঠাতে রাজি হয় তার পরিবারও। সেখানে নেয়ার পর বিভিন্ন অনৈতিক কাজে বাধ্য করা হচ্ছে।

 

এমনকি একাধিকবার তাকে ধর্ষণ করা হয়েছে বলে পরিবারকে জানিয়েছে ওই নারী। তাকে মালয়েশিয়ায় পাচারের সঙ্গে জড়িত রুবেল, মমেলা ও দালাল বিউটি ও তানিয়া নামের চারজন। এর মধ্যে তানিয়া মালয়েশিয়ার একটি শপিংমলে কাজ করে। এছাড়া তার স্বামী রুবেলসহ এ চক্রের অন্য সদস্যরা ঢাকার মিরপুরে থাকে। মালয়েশিয়া থেকে মেয়ের এমন বার্তা পেয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছে তার পরিবার। মেয়েকে ফেরত আনতে তারা যোগাযোগ করেন পাচার চক্রের সদস্যদের সঙ্গে। তারা জানায় মেয়েকে ফেরত পেতে হলে ৬ লাখ টাকা মুক্তিপণ দিতে হবে। আর টাকা না দিলে পাচারের শিকার নারীকে সেখানে বিক্রি করে দেয়ার হুমকিও দিয়েছে তারা।

 

পাচার হওয়া ওই নারীর মায়ের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, কয়দিন আগে তারা আমার মেয়েকে বিনা পয়সায় মালয়েশিয়ায় নেয়ার লোভ দেখায়। সেখানে প্রতি মাসে বাংলাদেশি টাকায় ৫০ হাজার টাকা বেতনে শপিংমলে চাকরি হবে বলে জানায়। বিদেশ যেতে তো অনেক টাকা লাগে এ প্রশ্নের জবাবে তারা জানায়, মালয়েশিয়া যেতে কোনো টাকা লাগবে না। সব খরচ কোম্পানি বহন করবে। তাদের কথায় বিশ্বাস করে আমি আমার মেয়েকে বিদেশে পাঠাতে রাজি হই।

 

এরপর বিভিন্ন সময় বিবাদী রুবেল, বিউটি ও মমেলা আমার বাসায় আসে। তারা আমার মেয়ের সঙ্গে আলোচনা করে। আর মালয়েশিয়া অবস্থানরত তানিয়া মোবাইলে আমার মেয়ের সঙ্গে বিভিন্ন সময় কথা বলে। তানিয়া সেখান থেকে মালয়েশিয়ার শপিংমলে চাকরি দেয়ার কথা পাকাপাকি করে। এরপর আমার মেয়েকে মালয়েশিয়া পাঠানো হয়।

 

তিনি বলেন, গত ২৭ আগস্ট আমার মেয়ে মালয়েশিয়া পৌঁছায়। তাকে শপিংমলে চাকরি না দিয়ে একটি বাসায় আটকে রেখে অসামাজিক কাজে বাধ্য করছে রুবেলের স্ত্রী তানিয়া। আমার মেয়ে মোবাইলে ভিডিও কলে সব ঘটনা দেখিয়েছে। সে অনেক কান্নাকাটি করছে। দেশে আসতে চায়।

 

বিষয়টি সম্পর্কে রুবেল, মমেলা ও বিউটিদের জিজ্ঞাসা করলে তারা জানায়, নগদ ৬ লাখ টাকা দিলে মেয়েকে মুক্তি দেবে। আর টাকা না দিলে আমার মেয়েকে মালয়েশিয়ায় বিক্রি করে দেবে।

 

বিউটি নামের স্থানীয় যে দালালের সহায়তায় মেয়েটি বিদেশ গিয়েছে তার সন্ধানে নামি আমরা। মিরপুরের নিজ বাসায়ই পাওয়া যায় তাকে। তিনি বলেন, পাচার হওয়া মেয়ে ও তার বান্ধবীর আমার বাসায় যাতায়াত ছিল। আমাকে তানিয়া অফার দিলে বিষয়টি তাদের জানাই। কিন্তু পরে তাদের মধ্যে একজন প্রথমে রাজি হলেও পরে আর যায়নি। কিন্তু সেখানে নেয়ার পর পরিস্থিতি এমন হবে সেটা আমি বুঝে উঠতে পারিনি।

 

একই কৌশলে মালয়েশিয়ায় পাচার হওয়া ওই তরুণীর এক বান্ধবীকেও মালয়েশিয়ার পাচার করতে চেয়েছিল চক্রটি। এ বিষয়ে ওই তরুণী বলেন, বিউটি ও মমেলা আমাদের বাসার পাশেই থাকে। আমি ও পাচার হওয়া সেই মেয়ে একসাথে চলাফেরা করতাম। একদিন তারা আমাদের বাসায় ডেকে মালয়েশিয়া চাকরির অফার দেয়।

 

কিন্তু আমার পরিবার রাজি হয়নি। এর মধ্যেই মমেলা ও বিউটি খালা একটি স্ট্যাম্পে আমাদের স্বাক্ষর নিয়েছিল। সেখানে লেখা ছিল কোনো কারণে মালয়েশিয়া যাওয়া ক্যানসেল করলে ৩০ হাজার টাকা জরিমানা দিতে হবে।

 

ওই তরুণী বলেন, আমি যখন তাদের জানাই যে আমি যাব না তখন রুবেল আমাকে ফোন দিয়ে গালাগালি করে। এলাকার পোলাপান দিয়ে ডিস্টার্ব করানো শুরু করে। একদিন সে আমাকে বাসায় ডেকে নিয়ে খারাপ অফার দিয়ে বলে, এত টাকা তো তুই দিতে পারবি না। আমার কথা শুনলে আর টাকা দিতে হবে না। আমি সেটাতে রাজি হইনি।

 

তখন সে আমাকে হুমকি দেয় যে, বিষয়টি কাউকে বললে আমাকে মেরে ফেলবে। আমি এরই মধ্যে কিছু টাকা তাদের দিয়ে ফেলেছি। এ ঘটনায় মিরপুর পল্লবী থানায় লিখিত অভিযোগ করেছে মালয়েশিয়া পাচার হওয়া ওই নারীর পরিবার। বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করার আশ্বাস দিয়েছে থানা পুলিশ পল্লবী থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) মোহাম্মদ মেসবাহ উদ্দীন।

 

তিনি বলেন, আমরা লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। প্রাথমিক তদন্ত শেষ হয়েছে। আমরা দ্রুত সময়ের মধ্যে অপরাধীদের আইনের আওতায় এনে শাস্তির ব্যবস্থা করব। স্থানীয় দালালদের বিরুদ্ধেও অভিযান চালানো হবে বলে জানিয়েছে পুলিশ। তবে বিদেশ যাত্রায় মানুষকে আরো সর্তক হওয়ার আহব্বান তাদের।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version