ডেঙ্গু রোগী বেড়ে যাওয়ায় সৃষ্ট ডিএনএস স্যালাইন সংকট কাটছে না। বেসরকারি হাসপাতালে সংকটের তীব্রতা বেশি। সংকট সমাধানে ৭ লাখ স্যালাইন আমদানির অনুমতি দিয়েছে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, ডেঙ্গুর কারণে হঠাৎ ১০ থেকে ১২ গুণ চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় বিভিন্ন স্থানে স্যালাইনের সংকট দেখা দিয়েছে। সাধারণ স্যালাইন শুধু ডেঙ্গুই না, সিজার, সার্জারি, ডায়ালাইসিসসহ বিভিন্ন চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়। ডেঙ্গু রোগী বেড়ে যাওয়ায় স্যালাইনের সংকটে অন্যান্য রোগের চিকিৎসাও ব্যাহত হচ্ছে। চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় কৃত্রিম সংকট তৈরি করার অভিযোগও উঠছে।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা জানান, ডিএনএস (ডেক্সট্রোজ নরমাল স্যালাইন) ইনফিউশন একটি আইভি তরল ওষুধ যেটি সেসব রোগীকে চিকিৎসা করার জন্য ব্যবহৃত হয়, যাদের মধ্যে গুরুতর রক্তপাত এবং তরল হ্রাস হয়, যাদের রক্তে ক্যালসিয়ামের মাত্রা কম থাকে অথবা ইনসুলিন হাইপোগ্লাইসেমিয়া রোগের জন্য সক্রিয় চিকিৎসা বা কার্বোহাইড্রেট উৎসের একটি শিরাস্থ ইনফিউশন চলছে বলে জানান বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা।
দেশের চলতি বছরের নাজুক ডেঙ্গু পরিস্থিতি সর্বকালের ইতিহাস ভেঙে ফেলেছে। ডেঙ্গু জ¦রে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়ে গেছে। দৈনিক মৃতের সংখ্যা দশের নিচে নামছে না। চলতি মাসের ৯ দিনে ডেঙ্গুতে ১২৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। অর্থাৎ দৈনিক গড়ে মারা যাচ্ছেন ১৩ জন। চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭১৬ জনে। প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে দৈনিক ভর্তি আছেন ১০ হাজারের বেশি ডেঙ্গু রোগী।
চিকিৎসা দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসক ও নার্সরা। এমন পরিস্থিতিতে দেশে সংকট দেখা দিয়েছে ডিএনএস স্যালাইনের। ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী বা ডেঙ্গুর লক্ষণ দেখা দিলেই ডাক্তারের নির্দেশনা অনুযায়ী রোগীর শারীরিক অবস্থার উন্নতির জন্য দেয়া হচ্ছে ডিএনএস স্যালাইন। এবার সেই স্যালাইনের সংকট দেখা দিয়েছে ওষুধের দোকানগুলোতে। কেউ কেউ বলছেন, স্যালাইন স্টকআউট, আবার কেউ বলছেন সিস্টেম করে অন্য জায়গা থেকে ম্যানেজ করতে হবে। এসব বাহানায় চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে ডিএনএস স্যালাইন।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত আগস্ট মাসের প্রথম দিক থেকেই ডিএনএস স্যালাইনের সংকট শুরু হয়। ওই মাসে খোদ স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকও বিষয়টি স্বীকার করেন। কিন্তু নেয়া হয়নি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা। বর্তমানে পরিস্থিতি প্রকট আকার ধারণ করেছে।
গত ১১ আগস্ট মানিকগঞ্জ কর্নেল মালেক মেডিকেল কলেজ ডে উপলক্ষে হাসপাতালের অন্তর্বিভাগ ভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধন অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সাংবাদিকদের বলেন, ডেঙ্গুর কারণে স্যালাইনের চাহিদা বেড়েছে। হঠাৎ ১০ থেকে ১২ গুণ চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় বিভিন্ন স্থানে স্যালাইনের সংকট দেখা দিয়েছে। এ চাহিদা পূরণে দেশের সব স্যালাইন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানকে উৎপাদন বাড়ানোর জন্য বলা হয়েছে। প্রয়োজনে দেশের বাইরে থেকে স্যালাইন আমদানির জন্য মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে বলে জানান স্বাস্থ্যমন্ত্রী।
গত শনিবার জাহিদ মালেক বলেন, ভারত থেকে ৭ লাখ ব্যাগ স্যালাইন আমদানির জন্য অনুমোদন দেয়া হয়েছে। আগামী দু-একদিনের মধ্যে সাড়ে ৩ লাখ স্যালাইন পৌঁছাবে। আমদানি হলে স্যালাইন সংকট কেটে যাবে। প্রয়োজন হলে আরো আমদানি করা হবে। ডেঙ্গু রোগীও বাড়ছে, মানিকগঞ্জে এর আগে এত ডেঙ্গু রোগী ছিল না। প্রতিটি জেলাতে এখন ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যাচ্ছে।ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মুখপাত্র ও উপ-পরিচালক (আইন কর্মকর্তা) মো. নুরুল আলম বলেন, ডেঙ্গু বেড়ে যাওয়ায় স্যালাইনের ব্যাপক চাহিদা বেড়েছে। এজন্য দ্রুত ইডিসিএলের (রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন এসেনশিয়াল ড্রাগস কোম্পানি) মাধ্যমে ৭ লাখ স্যালাইন ভারত থেকে আমদানি করার অনুমতি দেয়া হয়েছে। দেশীয় ওষুধ কোম্পানিগুলো তিন শিফটে স্যালাইন উৎপাদন করছে। পাশাপাশি স্যালাইন আমদানির এই অনুমতি দেয়া হলো। দু-একদিনের মধ্যে আমদানির স্যালাইন চলে এলে স্যালাইনের সংকট কেটে যাবে বলে তিনি জানিয়েছেন।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, ডিএনএস স্যালাইনের সংকট কাটেনি। গত মাসের প্রথম দিক থেকে শুরু হওয়া সংকটের তীব্রতা বেড়েই চলেছে। স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল হাসপাতালের আশপাশের বেশিরভাগ ফার্মেসিতে ১০০০ মিলিগ্রামের ডিএনএস স্যালাইন বিক্রি বন্ধ। কয়েকটি দোকানে বিক্রি হচ্ছে, তাও চড়া দামে। গায়ের মূল্য অনুযায়ী ১০০০ মিলিগ্রামের একটি ডিএনএস স্যালাইন ১০০ টাকা (প্লাস্টিকের বোতল) এবং ৫০০ মিলিগ্রামের একটি ডিএনএস স্যালাইন ১২৫ টাকা (কাঁচের বোতল)। সেখানে দোকানিরা ১০০০ মিলিগ্রামের স্যালাইন বিক্রি করছে ৩০০ বা তারও বেশি টাকায়। অন্যদিকে ৫০০ মিলিগ্রামেরটি বিক্রি হচ্ছে ১৫০ থেকে ২০০ টাকায়।
ঢাকা ন্যাশনাল হাসপাতালের পাশে এম কে ফার্মেসি, মেসার্স ইমন ফার্মেসি, বীনা ফার্মেসি, কনা ফার্মেসি, ছন্দা ফার্মেসি, মোল্লা মেডিসিন কর্নার, সেন্ট মেরিস ফার্মেসি, লায়লা মেডিকেল সাপ্লাইসহ অন্তত ১০টি ওষুধের দোকান রয়েছে। কোনো দোকানেই ডিএনএস স্যালাইন নেই। তবে বেশি টাকা দিলে ম্যানেজ করে দিতে পারবে, এ কথা বলে ক্রেতার কাছ থেকে বেশি দাম নিয়ে পরবর্তীতে বিক্রি করা হয়। সম্প্রতি ছন্দা ফার্মেসি ও মোল্লা মেডিসিন কর্নারে দাম তিনগুণ বেশি রাখার অভিযোগে বাগ্বিতণ্ডায় লিপ্ত হন কয়েকজন ভুক্তভোগী। একপর্যায়ে দোকানি দোকানে তালা মেরে পালিয়ে যায়। ভোক্তা অধিকারে ফোন দিয়েও এর কোনো সুরাহা হয়নি।
রাজধানীর হাজারীবাগ সেকশনস্থ বিক্রমপুর ফার্মেসির বিক্রয় প্রতিনিধি নাজমুল হাসান বলেন, স্যালাইনের সংকট রয়েছে। বাজারে স্যালাইনের চাহিদা বেশি। তাদের দোকানে এ মুহূর্তে স্যালাইন নেই। সরবরাহকারীরা ঠিকমতো স্যালাইন সরবরাহ করছে না। তিনি জানান, তাদের আশপাশে ৯০ টাকার স্যালাইন ২০০ টাকায়ও বিক্রি হচ্ছে।
হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালের চেয়ারম্যান ডা. এম এইচ লেলিন চৌধুরী বলেন, এখন চাহিদার তুলনায় স্যালাইনের সংকট অনেক বেশি। আমরা কোম্পানিকে ১০০ ব্যাগ স্যালাইনের চাহিদা দিলে ১০ বা ২০ ব্যাগ স্যালাইন পাই। আগে আমরা একজন লোক পাঠিয়ে মিটফোর্ড মার্কেট থেকে প্রয়োজন অনুযায়ী স্যালাইন নিতে পারতাম। এখন স্যালাইনের খোঁজে তিন চারজনকে মিটফোর্ড মার্কেটের বিভিন্ন দোকানে পাঠাতে হচ্ছে। স্যালাইনের সর্বোচ্চ দাম ৯০ থেকে ৯৫ টাকা ছিল, এখন সেই স্যালাইন আমরা ২০০ টাকা প্যাকেট কিনছি। আমাদের ফার্মেসিতে স্যালাইন না থাকায় রোগীদের আমরা লিস্ট ধরিয়ে দিচ্ছি, তারা বিভিন্ন দোকান খুঁজে খুঁজে স্যালাইন কিনছে। সংকটের কারণে দাম বাড়ায় একদিকে রোগীদের চিকিৎসা খরচ যেমন বেড়ে যাচ্ছে, পাশাপাশি ভোগান্তিও বাড়ছে অনেক বলে জানান ড. এম এইচ লেলিন চৌধুরী।
বেশি দামে স্যালাইন ক্রয় করার পর ক্ষোভ জানিয়ে রাজধানীর মগবাজার এলাকার ইনসাফ বারাকাহ কিডনি ও জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন এক রোগীর বাবা ইসমাইল হোসেন জানান, ডাক্তার প্রথম দিনেই ডিএনএস স্যালাইনসহ অন্যান্য ওষুধের নাম প্রেসক্রিপশনে লিখে দেন। এলাকায় দশটি দোকান ঘুরে একটিতে পেয়েছি ডিএনএস স্যালাইন। ১০০ টাকার স্যালাইন দুইটা ৩০০ টাকায় কিনেছি। তিনি অভিযোগ করেন, আমার মনে হয়েছে সবার কাছেই কমবেশি স্যালাইন মজুত আছে। কিন্তু তারা বলে স্যালাইন নাকি শেষ। অন্য জায়গা থেকে ম্যানেজ করা লাগবে। যাতায়াত খরচ বেশি যাচ্ছে বলে ১০০ টাকার স্যালাইন ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করছে। সবার চাহিদা, এ জন্য দোকানিরা যার কাছ থেকে যেমন পারছে নিচ্ছে। কেউ কিছু বলছেও না। স্যালাইনের কথা বললেই বলে শেষ, তবে ম্যানেজ করে দেয়া যাবে। আমরা যারা রোগী নিয়ে হাসপাতালে আসছি তাদের তো বেশি টাকা দেয়া ছাড়া উপায় নেই। তাছাড়া ওষুধ কেনার পর রিসিটও দেয়া হয় না। রিসিট দেয়ার কথা বললে অন্য জায়গা থেকে কিনতে বলে। এমন ক্ষোভ প্রকাশ করেন ইসমাইল হোসেন।
কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির অভিযোগ : এভাবে রাজধানীসহ সারা দেশে ডিএনএস স্যালাইনের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করার অভিযোগ উঠেছে। স্যালাইন সংকটের কারণে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা ডেঙ্গু, সার্জারি, ডায়ালাইসিসসহ বিভিন্ন রোগীকে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। ১০০ টাকার স্যালাইন বিক্রি হচ্ছে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকায়। কোথাও কোথাও হাসপাতালেও স্যালাইন পাচ্ছেন না রোগীরা। এ অবস্থায় শুধু খতিয়ে দেখার আশ্বাসই দিচ্ছে প্রশাসন। একজন ডেঙ্গু রোগীর দিনে স্যালাইন লাগে এক থেকে দুই লিটার। আর এই সালাইন সময়মতো জোগাড় করতে না পারলে রয়েছে প্রাণ সংশয়।
চট্টগ্রামে ডেঙ্গু রোগীদের জন্য অতি প্রয়োজনীয় ডিএনএস স্যালাইনের কৃত্রিম সংকট তৈরির চেষ্টার দায়ে ৪ ফার্মেসিকে ৮০ হাজার টাকা জরিমানা ও ২ লাখ টাকার অনিবন্ধিত ওষুধ জব্দ করা হয়। বুধবার নগরীর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতাল এলাকায় যৌথ অভিযান পরিচালনা করে এই জরিমানা করে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন ও ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট প্রতীক দত্ত ও ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক এস এম সুলতানুল আরেফীন অভিযানের নেতৃত্ব দেন।
নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট প্রতীক দত্ত বলেন, ‘শুরুতে জেলা প্রশাসনের কয়েকজন কর্মচারী রোগী সেজে ওইসব ফার্মেসিতে ডিএনএস স্যালাইন কিনতে যায়। কিন্তু সেখানে স্যালাইন পাওয়া যায়নি। পরবর্তীতে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে গিয়ে ওসব ফার্মেসিতে স্যালাইন পাওয়া যায়। অর্থাৎ স্যালাইনের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বাড়ানোর চেষ্টা করছিল তারা।
ভোরের আকাশ/মি
মন্তব্য