রুদ্র মিজান: হারুনকান্ডে একের পর এক পাল্টাপাল্টি অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। এতে মানুষের মুখে মুখে প্রকাশ পাচ্ছে ত্রিভুজ প্রেমের গল্প। তেমনি সরকারি এ কয়েক কর্মকর্তার কারণে বিব্রতকর অবস্থায় ঐতিহ্যবাহী এ সংস্থার সদস্যরা। শুধু হারুন অর রশীদ নয়, এ কান্ডে জড়িত সবার শাস্তি চাচ্ছেন তাদের সহকর্মীরাও। আইনশৃঙ্খল রক্ষাকারী বাহিনীর মর্যাদা রক্ষায় এর সুষ্ঠু তদন্তের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন তারা।
এর মধ্যে গণমাধ্যমে বক্তব্য দিয়েছেন পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার হারুন অর রশিদ ও সানজিদা আফরিন নিপা। দুজন প্রায় একই সুরে কথা বলেছেন। অভিযোগের তীর ছুড়েছেন রাষ্ট্রপতির এপিএস আজিজুল হক মামুনের দিকে। নেপথ্য আলোচনায় পুলিশ ও প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা যেন মুখোমুখি। এ অবস্থায় অভিযোগ উঠেছে, ছাত্রলীগের দুই কেন্দ্রীয় নেতাকে থানায় নিয়ে বেদম মারধরের বিষয়টি ধামাচাপা দিতে চাচ্ছে একটি পক্ষ। তারা পুলিশ কর্মকর্তাদের রক্ষায় সক্রিয় হয়েছেন।
মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, এডিসি হারুন দীর্ঘদিন থেকেই নানা অপরাধ করে আসছেন, কিন্তু কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। ছাত্রলীগ নেতাদের পিটিয়ে ফৌজদারি অপরাধ করলেও সে হিসেবে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি বলে মনে করেন তারা। এদিকে এ বিষয়ে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন জমা দেয়ার সময় আরো পাঁচ কার্যদিবস বাড়ানো হয়েছে। বুধবার তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন দাখিল করার কথা ছিল। নির্ধারিত সময়ে সম্ভব না হওয়ায় কমিটি পাঁচ কার্যদিবস সময় বাড়ানোর আবেদন করে।
এ ঘটনার তদন্তকালীন মঙ্গলবার দুপুরে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশিদ বলেন, শনিবার সন্ধ্যায় বারডেম হাসপাতালে রাষ্ট্রপতির সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) আজিজুল হকই প্রথমে এডিসি হারুন অর রশীদের ওপর হামলা করেছিলেন। এটাও তদন্ত হওয়া উচিত। তার এ বক্তব্য সমর্থন করেন পুলিশের অনেক সদস্য।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের এক উপকমিশনার বলেন, নৈতিক স্খলনের অভিযোগ উঠেছে এডিসি সানজিদা ও এডিসি হারুনের বিরুদ্ধে। এটি প্রমাণ হলে তারা শাস্তি পাবেন। অতীতে এসব ঘটনায় অনেকের চাকরি চলে গেছে। হারুন ও সানজিদা পুলিশে কর্মরত তাই এ নিয়ে তার স্বামী আজিজুল হক মামুন সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে অভিযোগ করতে পারতেন বলে মনে করেন তিনি। কিন্তু মামুন তা করেননি।
একইভাবে সানজিদার এক ব্যাচমেট জানান, একজন পুলিশের গায়ে হাত তোলে মামুনও অন্যায় করেছেন। কিন্তু ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় বিজ্ঞান বিষয়ক সম্পাদক ও ঢাবির শহীদুল্লাহ হলের সাধারণ সম্পাদক শরীফ আহমেদ মুনিম জানান, সেদিন রাতে এডিসি হারুনকে কেউ মারধর করেনি। আজিজুল হক মামুন ও হারুনের মধ্যে বাগ্বিতন্ডা ও হাতাহাতির ঘটনা ঘটেছে।
ছাত্রলীগের সাবেক নেতা মামুন, এলাকার বড় ভাই। সে হিসেবেই সেদিন সেখানে ছিলেন ছাত্রলীগের দুই নেতা। তারা কাউকে হামলা করার উদ্দেশ্যে যাননি বলে জানান। উল্টো হারুন ও তার অধীনস্থরা তাদের ধরে থানায় নিয়ে হত্যার উদ্দেশ্যে অমানবিক নির্যাতন করেছেন বলে অভিযোগ করেন ছাত্রলীগের এ নেতা।
এ ঘটনার পর অতিরিক্ত উপকমিশনার হারুন অর রশীদ সম্পর্কে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে সর্বত্র প্রকাশ পাচ্ছে মানুষের নেতিবাচক ধারণা। অতীতে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, সাংবাদিক ও আইনজীবীদের বেদম প্রহার করেছেন এ কর্মকর্তা। বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের নির্যাতনেও তিনি বেশ আলোচিত। শেষ পর্যন্ত ছাত্রলীগের প্রথম সারির নেতাদের বেদম প্রহার করেছেন।
এ বিষয়ে মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন বলেন, শাহবাগে যে ঘটনাটি ঘটেছে সেখানে সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ দুজন নেতা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এবং পরে অল্প সময়ের মধ্যে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। যখন ক্ষমতাসীনদের কেউ নির্যাতনের শিকার হয় সেক্ষেত্রে খুব দ্রুত পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়। অথবা যেসব ঘটনায় মানুষের ব্যাপক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া হয়, সেসব ঘটনায় পদক্ষেপ নিতে দেখি। কিন্তু এর বাইরেও শত শত ঘটনা ঘটে, সেটি নিয়ে কিন্তু তাৎক্ষণিক কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় না।
তিনি বলেন, সাময়িক বরখাস্তের মতো যে পদক্ষেপটি এসেছে সেটিও পর্যাপ্ত নয়। কারণ নির্যাতনের ঘটনাটি ফৌজদারি অপরাধ, যে বিষয়টিতে কোনো পদক্ষেপ আসেনি।
সূত্রমতে, তারপরও তাকে এ ঘটনায় রক্ষা করতে চেষ্টা করছেন কেউ কেউ। বরখাস্ত করার পর সদর দপ্তরে না রেখে রংপুর রেঞ্জে সংযুক্ত করাকে তারা যুক্তিযুক্ত মনে করেননি। তবে পুলিশের কর্মকর্তারা মনে করেন ঐতিহ্যবাহী পুলিশের মর্যাদা রক্ষার স্বার্থে এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে তিনজনেরই শাস্তি হওয়া উচিত। অন্যদিকে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় দুই নেতাকে মারধর করার দায়ে এডিসি হারুনের চূড়ান্ত শাস্তি চাচ্ছেন ছাত্রলীগের তৃণমূলের নেতাকর্মীরা।
এদিকে হারুন ইস্যুতে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা শাখার প্রধান হারুনের বক্তব্য পুলিশের কিছু সদস্য সমর্থন করলেও ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক বলেছেন ভিন্নকথা। ডিএমপি কমিশনার বলেন, হারুন এমন তথ্য কোথায় পেয়েছেন জানি না। প্রাথমিক তদন্তে আমাদের কাছে মনে হয়েছে, এডিসি হারুন ও ইন্সপেক্টর মোস্তফা; দুজন ব্যক্তি বাড়াবাড়ি করেছে।
আইনের ব্যত্যয় ঘটেছে। তাদের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি। তারপর আমি একটি তদন্ত কমিটি করেছি। এ তদন্ত কমিটির রিপোর্ট পাওয়ার পর আমাদের অফিসারদের কার কতটুকু দোষ, সেই অনুসারে বিভাগীয় ব্যবস্থাসহ অন্য ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পুলিশ সদর দপ্তর বা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করব।
এদিকে গতকাল তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন দাখিল করার কথা ছিল। নির্ধারিত সময়ে সম্ভব না হওয়ায় কমিটি পাঁচ কার্যদিবস সময় বাড়ানোর আবেদন করে। গত শনিবার রাতে শাহবাগ থানায় ছাত্রলীগ নেতাদের মারধরের ঘটনায় অভিযোগ ওঠার পর ডিএমপির পক্ষ থেকে ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করে এবং তাদের দুই কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছিল।
পূর্ণাঙ্গ তদন্তের স্বার্থে এবং এডিসি হারুন ছাড়া অন্য কারা কারা ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তাদের কার কী ভূমিকা ছিল এবং ঘটনার সূত্রপাত যেখানে বারডেম হাসপাতাল, সেখানে কারা কারা ছিলেন, কার কী ভ‚মিকা ছিল সব তদন্ত করতে আরো সময় প্রয়োজন। সেজন্য তদন্ত কমিটি আরো পাঁচ কার্যদিবসের সময় আবেদন করেছিলেন। ডিএমপি কমিশনার তাদের তদন্তকার শেষ করতে আরো পাঁচ কার্যদিবস সময় দিয়েছেন। হারুনকান্ডে গতকাল পর্যন্ত এডিসি সানজিদার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।
এ বিষয়ে ডিএমপির উপপুলিশ কমিশনার (মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস) মো. ফারুক হোসেন জানান, এডিসি সানজিদাকে রংপুর বদলি করার খবরের সত্যতা নেই। তাকে কোথাও বদলি বা প্রত্যাহারের আদেশ হয়নি।
গত ৯ সেপ্টেম্বর রাতে এডিসি হারুন বারডেম হাসপাতালে সানজিদার সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিলেন বলে তার স্বামী আজিজুল হক মামুন জানতে পারেন। পরে তিনি ছাত্রলীগের দুই নেতাকে সঙ্গে নিয়ে সেখানে যান। সেখানে হারুনের সঙ্গে বাগ্বিতন্ডা হয়। পরে পরে পুলিশ ফোর্স নিয়ে ছাত্রলীগের দুই নেতাকে শাহবাগ থানায় ঢুকিয়ে বেদম মারধর করেন এডিসি হারুন। এ ঘটনার পর এডিসি হারুনকে প্রথমে প্রত্যাহার করে পুলিশ অর্ডার ম্যানেজমেন্টে (পিওএম) সংযুক্ত করা হয়। পরে একই দিনে তাকে কক্সবাজারের আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নে (এপিবিএন) বদলি করা হয়।
পরদিন ১১ সেপ্টেম্বর তাকে সাময়িক বহিষ্কার করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। এর একদিন পর ১২ সেপ্টেম্বর রাতে এডিসি হারুনকে রংপুর রেঞ্জ ডিআইজির কার্যালয়ে সংযুক্ত করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। এদিকে ঘটনার দুদিন পর মঙ্গলবার রাতে সেই দিনের ঘটনার বর্ণনা দেন সানজিদা।
তিনি গণমাধ্যমকে জানান, বেশ কয়েকদিন ধরে আমি বুকে মারাত্মক ব্যথায় ভুগছিলাম। সেদিন পেইনটা একটু বেশি হওয়ায় ডাক্তার দেখানোর সিদ্ধান্ত নিই। যেহেতু ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতাল হারুন স্যারের আওতার মধ্যে পড়ে তাই ডাক্তারের সিরিয়াল পাওয়ার জন্য আমি স্যারের হেল্প চেয়েছিলাম।
তিনি আরো জানান, হারুন স্যার আসার পর ডাক্তার ম্যানেজ হয়। এরপর ডাক্তার কিছু টেস্ট দিলেন। ঘটনার সময় আমি ইটিটি করানোর রুমে ছিলাম। সেখান থেকেই বাইরে হট্টগোলের শব্দ শুনি। পরে হারুন স্যারকেই চিৎকার করে বলতে শুনি ‘ভাই আপনি আমার গায়ে হাত তুললেন কেন? আপনি তো আমার গায়ে হাত তুলতে পারেন না’। কিছুক্ষণ পর দেখতে পাই ওখানে আমার স্বামী আজিজুল হক মামুন। তার সঙ্গে আরো কয়েকজন ছেলে ছিল। তারা হারুন স্যারকে মারতে মারতে ইটিটি রুমে নিয়ে এলেন।
এ সময় আমি আমার স্বামী এবং তার সঙ্গে থাকা লোকজনের সঙ্গে চিৎকার শুরু করছিলাম। তখন আমার হাজব্যান্ড (স্বামী) আমার গায়ে হাত তোলেন এবং স্যারকে বের করার চেষ্টা করছিলেন। এর কিছুক্ষণ পর ফোর্স এলে তারা সেখান থেকে বের হয়ে যায়।
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য