মুস্তাফিজুর রহমান নাহিদ: বাঙালিদের বলা হয় মাছে-ভাতে বাঙালি। খাল-বিল-নদীর দেশ বাংলাদেশ। একসময় বাঙালির পাতে তিন বেলাই মাছ দেখা যেত। মাছ দিয়ে করা হতো অ্যাপায়ন। বিয়ে বাড়িতে কয়েক প্রকার মাছ না দিলে যেন মান থাকত না। এখন সেই দিন আর নেই। কালের বিবর্তনে নদী শুকিয়ে খাল হয়েছে। কমে গেছে খাল-বিল-জলাশয়। ফলে কমে গেছে মাছের সংখ্যা। এক সময় প্রতিনিয়ত যেসব মাছ দেখা যেত তার অনেক মাছই এখন বিলুপ্ত। যে কারণে মাছে-ভাতে বাঙালি চিরায়ত এই কথাটি এখন আর কাউকে খুব একটা বলতে শোনা যায় না।
দেশের হাওর-বাঁওর, খাল-বিল, নদী-নালায় একসময় মিঠাপানির দেশি প্রজাতির মাছ প্রচুর পাওয়া যেত। গত কয়েক দশকে দেশি প্রজাতির অনেক মাছই হারিয়ে যেতে বসেছে। মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, হারিয়ে যাওয়া দেশি প্রজাতির মাছের সংখ্যা আড়াইশর বেশি। হাওর-বঁওর, পুকুর, খাল-বিল, হাটবাজার কোথাও এখন আর মিঠাপানির অনেক সুস্বাদু মাছ আগের মতো পাওয়া যাচ্ছে না। দেশি মাছের বদলে এখন পুকুরে, বাজারে জায়গা দখল করে নিয়েছে চাষের পাঙ্গাস, তেলাপিয়া, ক্রস ও কার্পজাতীয় মাছ।
দেশি প্রজাতির মিঠাপানির মাছ ক্রমেই হারিয়ে যাওয়ার জন্য অনেকগুলো কারণ রয়েছে। এর মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব, ডোবা-নালা, খাল-বিল ভরাট করায় মাছের আবাসস্থল কমে যাওয়া, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, কারেন্ট জালের অবৈধ ব্যবহার, ফসলি জমিতে অপরিকল্পিত কীটনাশক ব্যবহার, নদীদূষণ, নদ-নদীর নাব্য হ্রাস, উজানে বাঁধ নির্মাণ, নদী সংশ্লিষ্ট খাল-বিলের গভীরতা কমে যাওয়া, ডোবা ও জলাশয় ভরাট করা, মা মাছের আবাসস্থলের অভাব, ডিম ছাড়ার আগেই মা মাছ ধরে ফেলা, ডোবা-নালা-পুকুর ছেঁকে মাছ ধরা, বিদেশি রাক্ষুসে মাছের চাষ ও মাছের প্রজননে ব্যাঘাত ঘটানো।
এছাড়া কৃষি ও চাষাবাদ ব্যবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে দেশীয় প্রজাতির মাছ। একই সঙ্গে পোনা আহরণ, নেটজাল ও মশারি জাল ব্যবহার করে খালে-বিলে-নদীতে মাছ ধরার কারণেও দেশীয় প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হচ্ছে।
তবে আশার কথা হচ্ছে মিঠা পানির মাছ, সামুদ্রিক মাছ সব ক্ষেত্রে আমাদের অভাবনীয় সাফল্য এসেছে। বিগত ১৬ বছরের ব্যবধানে মাছের উৎপাদন দ্বিগুণেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশের মোট জিডিপির ৩ দশমিক ৫৭ শতাংশ এবং কৃষিজ জিডিপির ২৬ দশমিক ৫০ শতাংশ মৎস্যখাতের অবদান। বিশ্বে অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে মৎস্য আহরণে বাংলাদেশ তৃতীয়, বদ্ধ জলাশয়ে চাষকৃত মাছ উৎপাদনে পঞ্চম, ইলিশ উৎপাদনে প্রথম ও তেলাপিয়া উৎপাদনে চতুর্থ স্থানে রয়েছে।
আশার কথা হচ্ছে, বিলুপ্ত হওয়া প্রায় ৩০ প্রজাতির দেশীয় মাছ এখন বিশেষ পদ্ধতিতে চাষাবাদ করা হচ্ছে। তাছাড়া নদী-হাওর-বিলে দেশীয় মাছের পোনা অবমুক্তকরণ এবং মৎস্য অধিদপ্তর কর্তৃক অভয়াশ্রম প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিলুপ্তপ্রায় মাছের উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। তবে উদ্বেগের বিষয়, বর্তমানে চাষ করা বিভিন্ন প্রজাতির মাছে বিরক্তিকর গন্ধের উপস্থিতি ভোক্তাদের ভাবিয়ে তুলেছে। অভিযোগ রয়েছে, সামুদ্রিক পচা মাছ, ট্যানারির বজ্যঁসহ ক্ষতিকর ধাতু মেশানো হয় মাছের খাবারে। বিষাক্ত এই খাবারে বেড়ে ওঠা মাছ খেলে মানবদেহে নানা জটিল রোগ সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কৃষি ও চাষাবাদ ব্যবস্থায় পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে উজাড় হয়ে যাচ্ছে দেশি প্রজাতির কৈ, মাগুর, শিং, পাবদা, টেংরা, পুঁটি, ডারকা, মলা, ঢেলা, চেলা, শাল চোপরা, শৌল, বোয়াল, আইড়, ভ্যাদা, বুড়াল, বাইম, খলিসা, ফলি, চিংড়ি, মালান্দা, খরকাটি, গজার, শবেদা, চেং, টাকি, চিতল, গতা, পোয়া, বালিয়া, উপর চকুয়া, কাকিলাসহ প্রায় আড়াইশ প্রজাতির মিঠা পানির মাছ।
গ্রামে একসময় পৌষ-মাঘ মাসে পুকুর, খাল, ডোবা, ঘেরের পানি কমতে থাকলে দেশি মাছ ধরার ধুম পড়ত। অথচ এখন অনেক গ্রামেই দেশি প্রজাতির মাছ নেই বললেই চলে। শীতকালের বাইরে বর্ষাকালে ধানের জমিতে কইয়া জাল, বড়শি ও চাই পেতে মাছ ধরার রীতিও হারিয়ে গেছে অনেক এলাকা থেকে। যারা একসময় পুকুর, খাল-বিল, ডোবা, নালায় মাছ ধরে পরিবারের চাহিদা পূরণ করতেন, তাদের অনেকেই এখন বাজার থেকে মাছ কিনে খেতে বাধ্য হচ্ছেন। খালে-বিলে মাছ না থাকায় যেসব জেলে মাছ বিক্রি করে সংসার চালাতেন, তারা এখন বাধ্য হয়ে পেশা পরিবর্তন করছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিভিন্ন ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ মেশানো মাছের খাবারের সঙ্গে মাছ দ্রুত বৃদ্ধির সম্পর্ক রয়েছে। মাছ মানুষের পুষ্টির চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তাই মাছ চাষের সঙ্গে সম্পর্কিত সব বিষয় যথাযথ পর্যবেক্ষণের আওতায় আনা জরুরি হয়ে পড়েছে। বিশেষত মাছের কৃত্রিম খাবার নিয়মিত পরীক্ষা করে দেখতে হবে, সেগুলোতে কোনো ক্ষতিকর পদার্থ আছে কিনা। সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সব দেশি মাছের বিলুপ্তি ঠেকাতে ও এর উৎপাদন বাড়াতে কার্যকর ভ‚মিকা পালন করবে এমনটাই তাদের প্রত্যাশা।
এদিকে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অর্থাৎ সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জের বিশাল হাওরকে মিঠাপানির মৎস্য সম্পদের আড়ত বলা হয়। তবে এ অঞ্চল থেকে দিন দিন কমে যাচ্ছে দেশীয় প্রজাতির সুস্বাদু সব মাছ। কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, নদ-নদীর নাব্য হ্রাস, খাল-বিল ও জলাশয় শুকিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে অসাধু জেলেরা অবাধে কীটনাশক প্রয়োগ করছে। এ ছাড়া কোণাবেড় ও কারেন্ট জাল দিয়ে নিষিদ্ধ উপায়ে মাছ শিকারের কারণে কমছে মিঠাপানির মাছ।
মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, কয়েক দশক আগেও এ অঞ্চলে আড়াইশ প্রজাতির মিঠাপানির মাছ ছিল। মনুষ্যসৃষ্ট বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধকতায় এসব মাছের অনেক প্রজাতি এখন আর চোখে পড়ে না। বর্ষা মৌসুমে নদী, খাল, বিল থেকে কারেন্ট জাল দিয়ে ব্যাপক হারে ডিমওয়ালা মাছ ধরার কারণে দেশি মিঠা পানির মাছের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাচ্ছে।
দেশি প্রজাতির মাছের হারিয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্য অনুষদের অধ্যাপক মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, বিভিন্ন কারণেই দেশি প্রজাতির মাছ হারিয়ে গেছে। এর মধ্যে প্রকৃতিক বিপর্যয়ের সঙ্গে মানুষের সচেতনতার অভাবও রয়েছে। হারিয়ে যাওয়া দেশি মাছ রক্ষায় এখন ব্যাপক গবেষণা হচ্ছে। ইতোমধ্যে পাবদা, টেংরা, বোয়াল, আইড়, পাঙ্গাস ও কৈ মাছের চাষ হচ্ছে।
হারিয়ে যাওয়া দেশি মাছ ফেরাতে বিভিন্ন স্থানে কিছু উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। পটুয়াখালীতে দেশীয় মাছের উৎপাদন বাড়াতে মৎস্য বিভাগ এরই মধ্যে নিয়েছে অভিনব উদ্যোগ। দেশীয় বিভিন্ন জাতের মাছের রেণু থেকে পোনা উৎপাদন করে সরবরাহ করা হচ্ছে মৎস্যজীবীদের মধ্যে।
গবেষকদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব, কারেন্ট জালের অবৈধ ব্যবহার, ফসলি জমিতে অপরিকল্পিত কীটনাশক ব্যবহারসহ নানা কারণে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের দেশীয় মাছ। তাই মাছের উৎপাদন বাড়াতে অভিনব উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
পটুয়াখালী জেলা মৎস্য বিভাগের অধীন সদর উপজেলার মাঝগ্রাম এলাকায় ১০ একর জমিতে গড়ে তোলা হয়েছে হ্যাচারিসহ ছোট-বড় ১০টি পুকুর। সেসব পুকুরে দেশি বিভিন্ন মা মাছের ডিম থেকে প্রথমে রেণু, পরে পোনা উৎপাদন করা হয়। এ ছাড়াও বছরে এখান থেকে উন্নত প্রশিক্ষণ দিয়ে হাজারো মানুষের মধ্যে মাছ উৎপাদন ছড়িয়ে দেয়া হয়। দেশীয় জাতের পোনা বিক্রি হচ্ছে ৩০০ টাকা কেজি দরে।
এখানের মাছ গুণগত মান অনেক ভালো। পাশাপাশি এই খামার থেকে বিভিন্ন ধরনের দেশি মাছ নিয়ে চাষ করে বেশি লাভবান হচ্ছে বলে জানান মৎস্যজীবীরা। দেশি মাছ না পেয়ে আবার অনেকে জানান ক্ষোভের কথা।
পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (পবিপ্রবি) মৎস্য অনুষদ বিভাগের প্রফেসর ড. মো. সাজেদুল হকের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব, কারেন্ট জালের অবৈধ ব্যবহার, ফসলি জমিতে অপরিকল্পিত কীটনাশক ব্যবহারসহ নানা কারণে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের দেশীয় মাছ।
পটুয়াখালী জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. কামরুল ইসলাম বলেন, ‘এই সরকারি খামারের মাধ্যমে রুই, কাতলের পাশাপাশি আমরা দেশীয় বিভিন্ন প্রজাতির মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি।’ এদিকে কমে গেছে হাওরের মাছ।
হাওরপাড়ের বাসিন্দারা জানান, সাধারণত বর্ষা মৌসুমে জেলার কাওয়া দিঘি হাওরাঞ্চল এলাকা পানিতে তলিয়ে যায়। ছোট-বড় সব নালা, খালও পানিতে ভরপুর থাকে। তবে এবার প্রাকৃতিক কারণে ভরা বর্ষা ঋতুতেও পরিমাণ মতো বৃষ্টি হয়নি। ফলে হাওরে পর্যাপ্ত পানি আসেনি। যার প্রভাব পড়েছে বিলের মাছের ওপর। ক্রেতারা হন্যে হয়ে খুঁজেও চাহিদামতো দেশি প্রজাতির মাছ পাচ্ছেন না। হাইব্রিড মাছেই সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে তাদের। হাওরের ওপর নির্ভরশীল মানুষের জীবন-জীবিকায়ও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
স্থানীয় মৎস্যজীবীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একটা সময় জেলার জলাশয়গুলো মৎস্যজীবীরা ইজারা নিয়ে নানা জাতের দেশি মাছ চাষ করতেন। এখন বিত্তবানরা এসব ইজারা নিয়ে অধিক মুনাফার জন্য পুকুর ও জলাশয়ে হাইব্রিড মাছ চাষ করছেন। ফলে দেশি মাছের প্রজনন নষ্ট হচ্ছে। সেখানে হাইব্রিড মাছ একই সঙ্গে বিভিন্ন নিষিদ্ধ পদ্ধতিতে জলজ প্রাণী শিকারের কারণে মাছসহ অন্যান্য প্রাণীও বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। ফলে অনেক মৎস্যজীবী বাধ্য হয়ে এই পেশা পরিবর্তন করছেন।
হাওর রক্ষা সংগ্রাম কমিটি মৌলভীবাজার সদর উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক রাজন আহমদ বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে হাওরের প্রাকৃতিক ভারসাম্য এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। এ বছর তীব্র তাপপ্রবাহ ও বৃষ্টিপাত দেরিতে হওয়ায় হাওরে এখন পর্যন্ত পর্যাপ্ত পানি হয়নি। পাশাপাশি প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট কিছু কারণে মুক্ত জলাশয়ে দেশি প্রজাতির মাছ কমে গেছে। এবার প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টি কমের কারণে হাওরে পানি কম। বর্ষার শুরুতে বেড়জাল ও কারেন্ট জাল দিয়ে মা মাছ নিধনের ফলেও বিলুপ্ত হচ্ছে দেশি মাছ।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন বাপার জাতীয় পরিষদ সদস্য আসম সালেহ সোহেল বলেন, এখন হাওর আর হাওর নেই। হাওর এখন কৃষিজমি হয়ে গেছে। মনুষ্যসৃষ্ট সমস্যা ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কাঙ্ক্ষিত পানির অভাবে দেশীয় মাছ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। এখন খাল-বিল নদী-নালা ভরাট হওয়ার কারণেও মাছের প্রজনন হারিয়ে যাচ্ছে। শুধু মাছ নয়, মাছের পাশাপাশি জলজ প্রাণীগুলোও বিলুপ্ত হচ্ছে। এর জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রত্যক্ষ নজরদারি বাড়াতে হবে।
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য