-->

বিপদগ্রস্ত মানুষের আস্থার প্রতিষ্ঠান ফায়ার সার্ভিস

রুদ্র মিজান
বিপদগ্রস্ত মানুষের আস্থার প্রতিষ্ঠান ফায়ার সার্ভিস

হঠাৎ বেজে ওঠে ফায়ার-ঘণ্টা। চোখের পলকে গাড়ি স্টার্ট দেয়া হয়। বাজতে থাকে গাড়ির সাইরেন। রেসপন্স টাইম মাত্র ৩০ সেকেন্ড। এর মধ্যেই দ্রুতগতিতে গাড়িতে ওঠেন ফায়ার কর্মীরা। গাড়ি ছুটতে থাকে। গন্তব্য ঘটনাস্থল। উদ্দেশ্য অগ্নিনির্বাপণ। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের কন্ট্রোল রুমে বা ফায়ার স্টেশনে বিপদগ্রস্ত মানুষের কল আসার পরপরই ফোনে বা বেতারযন্ত্রের মাধ্যমে তা ফায়ার কর্মীদের অবগত করা হয়। গাড়ি ও ফায়ার কর্মীরা প্রস্তুত থাকেন সবসময়। আগুন ভয়াবহ হলে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। ফায়ার কর্মী থেকে শুরু করে কর্মকর্তারাও ছুটে যান আগুন নেভাতে। এমনকি ছোটেন মহাপরিচালক নিজেও। সবই করা হয় একদম অল্প সময়ে। এভাবেই দিনের পর দিন জীবনবাজি রেখে নাগরিক সুরক্ষা নিশ্চিতকরণে কাজ করে যাচ্ছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স। অগ্নিনির্বাপণ থেকে শুরু করে ড্রেনে ভেসে যাওয়া, নৌকাডুবিতে নদীতে নিখোঁজ, লিফটে আটকে থাকা ব্যক্তিদের উদ্ধার করছে ফায়ার কর্মীরা। বিপদগ্রস্ত পশুপাখিকেও উদ্ধার করে প্রশংসা অর্জন করেছে ফায়রা সার্ভিস। সরকারের নানামুখী কার্যকর উদ্যোগে এখন ফায়ার সার্ভিস পরিণত হয়েছে বিপদগ্রস্ত মানুষের আস্থার প্রতিষ্ঠানে। নানা সংকটে থাকা এ প্রতিষ্ঠানের সেবা সক্ষমতা এখন বেড়েছে। আধুনিক সরঞ্জাম ক্রয়, জনবল বৃদ্ধি, উন্নত প্রশিক্ষণ ও দেশের প্রতিটি উপজেলায় ন্যূনতম একটি করে ফায়ার স্টেশন নির্মাণের উদ্যোগে গ্রহণ করা হয়েছে। আজীবন রেশন প্রদানসহ নানা সুবিধাপ্রাপ্তিতে কর্মীরা হয়েছেন আরো উদ্যমী।

 

২০০৯ সালে দেশে ফায়ার স্টেশন ছিল ২০৪টি, বর্তমানে চালু স্টেশনের সংখ্যা ৪৯৫টি। শিগগিরই আরো ৪০টি ফায়ার স্টেশন চালু হবে বলে জানা গেছে। এছাড়া ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, চট্টগ্রাম বন্দর ও শিল্পনগরী এলাকা, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র এলাকায় ১১টি আধুনিক ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের কাজ চলছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে দেশের গ্যাপ এরিয়া ও দুর্গম এলাকা চিহ্নিত করে ফায়ার স্টেশন স্থাপনের বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এতে করে আগামীতে সারা দেশে ফায়ার স্টেশনের সংখ্যা হবে ৭৩৫টি। একইসঙ্গে ফায়ার স্টেশনের সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ২২টি সদর ফায়ার স্টেশনকে ‘বি’ শ্রেণি থেকে ‘এ’ শ্রেণিতে উন্নীত করা হয়েছে। মডার্ন ফায়ার স্টেশনের জনবল ৫৬ জন এবং স্থল-কাম নদী ফায়ার স্টেশনের জনবল হবে ৪১ জন। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে অধিদপ্তর। ২০০৯ সালে ফায়ার সার্ভিসের জনবল ছিল ৬ হাজার ১৭৫; সেখানে বর্তমানে জনবল ১৪ হাজার ৪৬৮ জন। এছাড়া প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় প্রতিষ্ঠানটির জনবল ৩০ হাজার করার কার্যক্রম চলছে।

 

পাশাপাশি আধুনিক গাড়ি ও উদ্ধার সরঞ্জাম যুক্ত করে ফায়ার সার্ভিসের সক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। একটা সময় ছিল বহুতল ভবনের আগুন নেভাতে বেগ পেতে হতো ফায়ার কর্মীদের। এখন আর সেই দুঃসময় নেই। বিশে^র সর্বাধিক উচ্চতার লেডারসংবলিত অগ্নিনির্বাপণ ও উদ্ধারকাজের গাড়ি যুক্ত হয়েছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের যান্ত্রিক বহরে। সুউচ্চ ভবনের আগুন নেভানো এবং উদ্ধার কাজ সহজতর করতে টার্ন টেবল লেডার (টিটিএল) নামের এ গাড়িটি দিয়ে ৬৮ মিটার উচ্চতা অর্থাৎ বহুতল ভবনের ২৪ তলা পর্যন্ত অগ্নিনির্বাপণ ও উদ্ধারকাজ করা যাবে। অগ্নিনির্বাপণ কাজকে সহজ ও ফায়ারফাইটারদের জীবনহানি কমাতে কেনা হয়েছে রিমোর্ট কন্ট্রোল ফায়ারফাইটিং গাড়ি ও ড্রোন। ফায়ার কর্মীরা জানান, বিশ^মানের একটি আধুনিক ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, সচিব ও মহাপরিচালক নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন অনেক বেশি গতিশীল সব দুর্যোগে প্রথম সাড়াদানকারী এ প্রতিষ্ঠানের সেবাকাজ। বর্তমান মহাপরিচালক ফায়ার সার্ভিসে যোগদানের পর থেকে উন্নয়নের এ ধারা ক্রমান্বয়ে বেগবান হয়েছে বলে জানান ফায়ার কর্মীরা। তার সময়ে জনসেবায় অনন্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে একমাত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে রাষ্ট্রের বেসামরিক সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘স্বাধীনতা পুরস্কার-২০২৩’ প্রদান করা হয়েছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সকে। সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোয় অগ্নিনির্বাপণকালে আত্মাহুতি দেয়া ১৩ ফায়ারফাইটারকে সরকারিভাবে ‘অগ্নিবীর’ খেতাবে ভূষিত করা হয়েছে। বর্তমান মহাপরিচালকের সময়েই ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ফায়ারফাইটাররা তুরস্কের ভূমিকম্পে উদ্ধারকাজে অংশ নিয়ে দেশের জন্য আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে সুনাম বয়ে এনেছেন।

 

ফায়ার সার্ভিস সূত্রে জানা গেছে, দুর্যোগ মোকাবিলায় সহায়ক শক্তি হিসেবে প্রধানমন্ত্রী প্রতিশ্রুত ৬২ হাজার আরবান ভলান্টিয়ার তৈরির কার্যক্রম চলছে। ইতোমধ্যে ৫৪ হাজার ৫২০ প্রশিক্ষিত স্বেচ্ছাসেবক তৈরি হয়েছে। বস্তির আগুন নির্বাপণের জন্য বস্তিবাসীকে প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে প্রায় ৯০০ স্বেচ্ছাসেবক। এছাড়া ফায়ার সেফটি ম্যানেজার কোর্স, ফায়ার সায়েন্স অ্যান্ড অকুপেশনাল সেফটি কোর্স, পিজিডি কোর্স পরিচালনা করে ২০১৬ সাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত ৩২৭২ জন ফায়ার প্রফেশনাল তৈরি করা হয়েছে। সারা দেশে জনগণকে প্রশিক্ষণ প্রদানের উদ্দেশ্যে ২০২২ সালে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ৩ হাজার ৩৪৮টি প্রশিক্ষণ কোর্স পরিচালনা করে মোট ১ লাখ ৩৩ হাজার ৯২০ জনকে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। নিজস্ব দক্ষ জনবল তৈরি করার জন্য ২০২২ সালে ৬ হাজার ১৬৫ ফায়ার কর্মীকে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। নৌদুর্ঘটনায় ডুবুরি হিসেবে কাজ করার জন্য আগ্রহী স্বেচ্ছাসেবকদের দেয়া হয়েছে ডুবুরি প্রশিক্ষণ। নেয়া হয়েছে ডুবুরি সম্প্রসারণ প্রকল্প।

 

ফায়ার সার্ভিস আধুনিকায়নে কুইক রেসপন্স টিম হিসেবে ফায়ার সার্ভিসের জন্য আরো ৩৫৭টি নতুন অ্যাম্বুলেন্স কেনার প্রকল্প নেয়া হয়েছে। বর্তমানে ১৯২টি অ্যাম্বুলেন্স দিয়ে সেবা কার্যক্রম চালু রয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের সেবা সহজে গ্রহণে ১৬১৬৩ নম্বরের হটলাইন চালু করা হয়েছে। চালু করা হয়েছে ওয়ান স্টপ সার্ভিস ও অনলাইনে লাইসেন্স ইস্যু, নবায়ন, এনওসি গ্রহণের সেবা কার্যক্রম। ফায়ার সার্ভিসের সাফল্যের এ ধারায় সর্বশেষ সংযুক্ত হয়েছে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন আজীবন রেশন সুবিধা। গত ১ জুলাই বা তার পরে অবসরে গমনকারী ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে যুক্ত সব কর্মকর্তা ও কর্মচারী এ আজীবন রেশন সুবিধা পাবেন। গত ১৩ আগস্ট অর্থ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব শামীম বানু শান্তি স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। এতে বলা হয়, সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, এমপি এ বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনা দিলে মন্ত্রণালয় তাতে সম্মতি জ্ঞাপন করে। রেশন হিসেবে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা প্রতি মাসে ২০ কেজি চাল, ২০ কেজি আটা, ২ কেজি চিনি, সাড়ে ৪ লিটার ভোজ্যতেল ও ২ কেজি ডাল পাবেন।

 

এ বিষয়ে অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন বলেন, প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিকতায় স্মার্ট বাংলাদেশ গঠন প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে বিশ^মানে উন্নীত হচ্ছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স। বিশ^মানের উন্নত প্রশিক্ষণ সুবিধা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে মুন্সীগঞ্জে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ফায়ার একাডেমি’ স্থাপনের কাজ শুরু হয়েছে। এ একাডেমি স্থাপনের কাজ সম্পন্ন হলে সেখানে বিশ^মানের অগ্নিনির্বাপণ ও উদ্ধারকাজের প্রশিক্ষণ সুবিধা সৃষ্টি হবে। এভাবে প্রশিক্ষণ প্রদান করে দক্ষ জনবল ও প্রশিক্ষিত জনগণ তৈরির মাধ্যেমে অগ্নিনির্বাপণ ঝুঁকি কমিয়ে আনা হচ্ছে বলে জানান তিনি।

 

 

ভোরের আকাশ/মি

মন্তব্য

Beta version