শাহীন রহমান: ভৌগোলিক অবস্থানে কারণে বাংলাদেশ এমনিতেই বড় ধরনের ভূমিকম্প ঝুঁকিতে রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন ভূমিকম্পের জন্য যে দুটি চ্যুতিরেখা বেশি ঝুঁকি সৃষ্টি করছে তার মধ্যে মধূপুর ও ডাউকি ফল্ট অন্যতম। সম্প্রতি সময়ে এই দুটি ফল্ট থেকে ক্রমাগত ছোট থেকে মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পের উৎপত্তি হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা এসব ভূমিকম্পকে বড় ধরনের ভূমিকম্প সৃষ্টির অশনি সংকেত হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
রোববার দুপুরে ১২টা ৪৯ মিনিটে রিখটার স্কেলে ৪.২ মাত্রার ভূমিকম্পে কেপে ওঠে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা। ভূমিকম্পটির উৎপত্তি স্থল টাঙ্গাইল সদরে বলে জানিয়েছেন আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভূমিকম্প গবেষণাগারের কর্মকর্তা রোবায়েত কবীর। আগারগাঁও আবহাওয়া অফিস থেকে এর দূরত্ব মাত্র ৫৯ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে।
আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে এ নিয়ে এ মাসে তিনবার দেশে ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। এর আগে গত ১১ সেপ্টেম্বর সিলেট এলাকায় ভূমিকম্প অনুভূত হয়। এর উৎপত্তিস্থল ছিল ভারত মিয়ানমার সীমান্ত। এ ছাড়া ৯ সেপ্টেম্বর আরেকটি ভূমিকম্প অনুভূত হয়। এর উৎপত্তিস্থল ছিল ভারতের আসামের কাছাড় এলাকা। গত আগস্ট মাসে দুই দফায় বাংলাদেশে ভূমিকম্প অনুভূত হয়। এর মধ্যে একটি অনুভূত হয় ২৯ আগস্ট। এর উৎপত্তিস্থল ছিল সিলেট। এর আগে ১৪ আগস্ট আরেকবার ভূমিকম্প অনুভূত হয়। এর কেন্দ্রস্থল ছিল বাংলাদেশ ভারত সীমান্তবর্তী সিলেটের কানাইঘাট এলাকায়। এছাড়া সম্প্রতি সময় ঢাকার কাছে কেরানীগঞ্জ থেকে ভূমিকম্পের উৎপত্তি হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন ঢাকা এত কাছ থেকে এভাবে ঘন ঘন ভূমিকম্পের উৎপত্তি হওয়ায় উদ্বেগ বাড়িয়ে দিচ্ছে। তারা বলেন টেকটনিক প্লেট ছাগড়াও দেশের অভ্যন্তরে চারটি ভ‚চ্যুতি রয়েছে। যেগুলো ক্রমান্বয়ে শক্তি বৃদ্ধি করে চলেছে। সম্প্রতি সময় উৎপত্তি হওয়ায় এসব ভূমিকম্প ঢাকার পাশের অবস্থিত মধুপুর ফল্ট ও সিলেটে অবস্থিত ডাইকি ফল্টের আশপাশ থেকেই উৎপত্তি হয়েছে। তারা বলেন এর অর্থ হলো এসব চ্যুতি রেখাগুলো ক্রমেই শক্তি বাড়িয়েছে। যে কোন সময় এসব চ্যূতি বা ফটল রেখা থেকে বড় ধরনের ভূমিকমম্পের উৎপত্তি হতে পারে।
দেশের প্রখ্যাত ভূমিকম্প বিদ ও উন্মুক্ত বিশ্ব বিদ্যালয়ে ভাইস চ্যান্সেলর সৈয়দ হুমায়ন আকতার বলেন, দেশে যে চারটি ফল্ট বা চ্যুতি রেখা অধিকমাত্রায় সক্রিয় রয়েছে তার মধ্যে মধূপুর চ্যুতি রেখাটি অন্যতম। ঢাকা শহরের জন্যও এটি ঝুকিপূর্ণ হিসেবে মনে করা হচ্ছে। কারণ ঢাকার অতি নিকট দিয়েই এটি বয়ে গেছে। এর অবস্থান মধুপুর গড়ের পশ্চিম প্রান্তে। যেখানে যমুনা ফ্লাড প্লেইনের সংযোগ স্থল সেখান থেকে চ্যুতিরেখাটি দক্ষিণ বরাবার ১শ’ কিলোমিটার বিস্তৃত।
চ্যুতিরেখাটি জামালপুর থেকে শুরু হয়ে ঢাকা শহরের পশ্চিম দিক দিয়ে মানিকগঞ্জে ওপর দিয়ে কেরানীগঞ্জ গিয়ে শেষ হয়েছে। রবিবারের ভূমিকম্পের উৎপত্তিও হয়েছে এ ফাটল রেখার এলাকা থেকে। ভবিষ্যতে ঢাকা শহরের জন্য বড় ধরণের হুমকি হয়ে দেখা দিতে পারে এ চ্যুতি রেখাটি। আঞ্চলিক টেকটোনিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে ভারত-বার্মা প্লেট বাউন্ডারি দেশের ভেতরে যমুনা মেঘনা বরাবর অবস্থান করছে। যমুনা মেঘনার পূর্বপ্রান্তের সমতলভুমি প্লেট বাউন্ডারীর ওপর অবস্থান করায় ঢাকার ঝুকি বাড়ছে। আর ফল্ট লাইনকে তিরি ঢাকা জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বলে উল্লেখ করেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন একই চ্যুতিরেখা থেকে ২০০১ সালের ১৯ ডিসেম্বর ৪.৪ মাত্রার একটি ভূমিকম্প উৎপত্তি হয়েছিল। উৎপত্তি স্থলের দূরত্ব ছিল কার্জন হল থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে বুড়িগঙ্গার পাড়ে। এছাড়া ২০০৮ সালে টাঙ্গাইল থেকে ৪.৪ মাত্রা, একই বছরের কয়েক মাসের ব্যবধানে ময়মনসিংহ থেকে ৫.২ মাত্রার ভূমিকম্পের উৎপত্তি হয়। যেগুলোর উৎস ছিল মধুপুর ফল্ট। ১৮৭৫ সালে এ ফল্ট থেকে একটি বড় মাত্রার ভূমিকম্পের উৎপত্তির রেকর্ড রয়েছে। তখন ৭ মাত্রার এ ভূমিকম্পটি উৎপত্তি হয়েছিল মানিকগঞ্জ এলাকা থেকে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রবিবারে ভূমিকম্পটির মাত্রা তুলনামুলকভাবে কমই ছিল। তবে যেহেতু ঢাকার অতি নিকট থেকেই এ উৎপত্তি হয়েছে তাই ভূমিকম্পের মাত্রা ৫ বা তার অধিক হলে পুরনো ঢাকার জন্য তা বিপত ডেকে আনতে পারতো। তবে ভূমিকম্পটির মাত্রা কম হলেও বিশেষজ্ঞ বলছেন, বারবার একই ফল্ট থেকে ভূমিকম্পের উৎপত্তি হওয়ায় মধুপুর ফল্ট বেশ সক্রিয় বলেই মনে হচ্ছে। তারা বলছেন, মাঝারি ধরনের ভূমিকম্পের ফলে ফল্টের অভ্যন্তর থেকে কিছুটা শক্তি বেরিয়ে গেলেও সার্বিকভাবে বড় ধরনের ভূমিকম্পের জন্য এটি বর্তমানে অধিক শক্তিশালী।
অধ্যাপক ড. সৈয়দ হুমায়ন আকতারে বলেন, দেশের অভ্যন্তরে যে প্রধান চারটি ফল্ট আছে সেগুলোই ভূমিকম্পের মূল উৎস। এখান থেকে অতীতে যে ভূমিকম্পগুলো হয়েছে তার মাত্রা ৭’র বেশি। কোথাও তা ৮ বা ৯ মাত্রার উপরেও ছিল। ৩শ’ কি.মি. দৈঘের ডাউকি ফল্টে ১৮৯৭ সনে ৮.৪ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল। মধুপুর ফল্টে ১৮৮৫ সালে ৭ মাত্রার উপরে ভূমিকম্প হয়েছিল।
সীতাকুন্ড-মায়ানমার ফল্টের ব্যাপকতা দেখে অনুমান করা যায় সেখানে ১৭৬২ সনে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল। আর এসব ভূমিকম্পগুলো ১শ’ থেকে আড়াই বছর আগে এই অঞ্চলে সংগঠিত হয়েছিল। ডাউকি এবং মধুপুর ফল্ট থেকে সংগঠিত ভূমিকম্পের সময়সীমা ১শ’ বছর পার হয়ে গেছে। আসাম-সিলেট ফল্টে ৪শ’ বছরের ওপরে পার হয়ে গেছে। এখন আরেকটা বড় ভূমিকম্পের জন্য যে পরিমাণ শক্তি সঞ্চিত হওয়া দরকার তা সঞ্চিত হয়ে আছে। এখন যে কোন সময় এ অঞ্চলগুলোতে বড় ধরনের একটি ভূমিকম্প হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী দেশের ভেতরে বিদ্যমান ফল্টগুলোয় ক্রমাগত তাদের শক্তি বৃদ্ধি করে চলেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভূতত্ত বিভাগ এবং কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যামন্ট দোহার্তি আর্থ অবজারভেটরি দেশে ২০০৩ সাল থেকে ভূমিকম্পের ওপর যৌথ গবেষণা করছে। গবেষণায় দেশে ১৮টি জিপিএস (গ্লোবাল পজিশনিং সিষ্টেম) বসিয়ে প্লেটের গতি রেকর্ড এবং তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে বাংলাদেশের ভূখন্ড বছরে ৪ থেকে ৫ সেন্টিমিটার বেগে উত্তর-পূর্ব দিকে অগ্রসর হচ্ছে। ইন্ডিয়ান প্লেটের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান। আর ইন্ডিয়ান প্লেট অগ্রসর হচ্ছে ৬ সেন্টিমিটার বেগে।
কিন্তু উত্তরে প্লেটের সংযোগ স্থানের কাছাকাছি এসে গতি আটকে যাচ্ছে। ফলে সংযোগের কাছাকাছি প্লেটের গতি লক্ড হয়ে প্রচুর পরিমাণে শক্তি সঞ্চিত হচ্ছে। যে কোন সময় এটি আনলক্ড হয়ে গেলে বিরাট ধরনের ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাবনা আছে। আবার দেশের অভ্যন্তরে ডিফারেন্সিয়াল মুভমেন্ট বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে ঢাকা ও সিলেট দুটি অঞ্চলের মধ্যবর্তী স্থান ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে। এখানে অবস্থিত চ্যুতি রেখায় নতুন করে শক্তি সঞ্চিত হচ্ছে, শিলারাশির ভিতরে চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। যে কোন সময় ভূমিকম্প হতে পারে বলে বিষেজ্ঞদের অভিমত।
তারা বলছেন বিগত ৩০ বছরে ভূমিকম্প সংঘটনের মাত্রা বেড়েছে অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। সাম্প্রতিক সময়ে এ হার ক্রমেই বাড়ছে। হিসেবে দেখা গেছে ১৯শ’ সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত এ অঞ্চলে ১শ’টি ভূমিকম্প রেকর্ড করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৯৬০ সালের পর ৬৫টির বেশি ভূমিকম্পের ঘটনা ঘটেছে। ২০০৪ পর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত এ হার আরও দ্রুত গতিতে বাড়ছে। তবে বিশেজ্ঞরা বলছেন ভূমিকম্প সংগঠনের হার বাড়লেও রিখটার স্কেলের মাত্রা তুলনামুলকভাবে কমই ছিল।
বিশেষজ্ঞদের মতে পৃথিবীতে মানুষ যত ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সঙ্গে পরিচিত তার মধ্যে ভূমিকম্পই হলো সবচাইতে ভয়াবহ দুর্যোগ। কোনো প্রকার আগাম বার্তা ছাড়াই এটি আঘাত হানে। এর আঘাত নিষ্ঠুর নির্দয়, নৃশংস ও বীভৎস্য প্রকারের হয়ে থাকে। তাদের মতে ভূমিকম্প হলো কোটি কোটি বছর ধরে বিদ্যমান ও চলমান একটি ভূতাত্তিক প্রক্রিয়া। যা দুটি প্লেটের সংঘর্ষে সংগঠিত হয়। এর প্রলংকারী আঘাতে পৃথিবীর অনেক গুরুত্বপূর্ণ জনপদ ও সভ্যতা বিলীন হয়ে গেছে। একমাত্র চীনেই এর আঘাতে প্রাণহানি হয়েছে ২৬ লাখ ১০ হাজারের ওপরে। যা অন্যদেশের তুলনায় অনেকগুণ বেশি। এ
উপমহাদেশে এ পর্যন্ত ভূমিকম্পের আঘাতে ২ লাখ ৩০ হাজারের বেশি মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। এর বাইরে ভূমিকম্প সৃষ্ট সুনামিতে পৃথিবীর পূর্ব গোলার্ধে প্রাণহানি হয়েছে ৪ লাখ ২০হাজারের বেশি। এর মধ্যে গত ২৬ ডিসেম্বর ২০০৪ সালে সুনামিতে প্রাণহানি হয়েছে ২ লাখ ২৫ হাজারের মতো।
তাদের মতে বিশ্বে দুটি ভূমিকম্প বলয়ে বিভক্ত। এ দুটি বলয়ের মধ্যে রয়েছে আলপাইন হিমালয় আন্দামান-সুমাত্রা ভূমিকম্প বলয়। এ বলয়ের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান। বিশ্বে যত ভূমিকম্প সৃষ্টি হয় তার শতকরা ৭ ভাগ হয় এ বলয়ের মধ্যে। অপরটি রয়েছে প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশসমূহের ভূমিকম্প বলয়। এ বলয়ে প্রায় ৯০ ভাগ ভূমিকম্প হয়ে থাকে। জাপান এ ভূমিকম্প বলয়ের মধ্যে অবস্থিত। ফলে জাপানে প্রায় প্রতিদিনই মৃদু ভূমিকম্প অনুভূত হয়ে থাকে।
বাংলাদেশ যে বলয়ে অবস্থিত তুলনামুলকভাবে এ বলয়ে ভূমিকম্পে পরিমাণ অনেক কম। এ বলয়ে যে সব দেশ রয়েছে সব দেশই একই ধরসের ভূমিকম্প ঝুঁকিতে রয়েছে। এরপরও বাংলাদেশ অধিক ঝুঁকিপূর্ণ ধরা হচ্ছে। এর কারণ দেশটিতে জনসংখ্যার হার অধিক। ভাটির দেশ হওয়া শিলার গঠন দুর্বল। এছাড়া ঢাকা শহরে রয়েছে দুর্বল অবকাঠামো। জনগণের মধ্যে সচেতনতাও তেমন নেই। আবার ভূমিকম্প ঝুঁকি মোকাবিলায় সরকারের মধ্যে বড় ধরনে প্রস্তুতির অভাব রয়েছে। তাঁদের মতে এ চারটি কারণে মুলত বাংলাদেশ বেশি ঝুঁকিপূর্ণ ভাবা হচ্ছে।
তাদের মতে, ভূমিকম্প একটি প্রাকৃতিক বিপর্যয়। এ ধরসের প্রাকৃতিক দুর্যোগের আগাম আভাস দেয়া এখানো সম্ভব হয়নি। এ বিষয়ে এখানো ব্যাপক গবেষণা চলছে। তবে ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতি অনেক মোকাবিলা করা সম্ভব যদি জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা যায়।
এ বিষয়ে সরকার, এনজিও ও গণমাধ্যম কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। তাদের মতে তিন ধরনের প্রস্তুতির মাধ্যমে ভূমিকম্প অনেকটা মোকাবিলা করা সম্ভব। এর মধ্যে ভূমিকম্প মোকাবিলায় আগাম প্রস্তুতি থাকবে হবে। ভূমিকম্পকালীন করণীয় ঠিক করা এবং পরবর্তী প্রস্তুতি ও করণীয় ঠিক করা।
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য