-->

ভুয়া সনদে ৪৭১ কোটি টাকার প্রকল্প

ইমরান খান
ভুয়া সনদে ৪৭১ কোটি টাকার প্রকল্প

ইমরান খান: জালিয়াতির মাধ্যমে শত কোটি টাকার কাজ বাগিয়ে নিয়েছে আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশন নামের এক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। সড়ক বিভাগের কর্মকর্তাদের স্বাক্ষর জালিয়াতি করে বড় প্রকল্পের কাজ বাগিয়ে নেয়া, টেন্ডার ক্যাপাসিটি না থাকার পরও সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের বড় বড় প্রকল্পের কাজ করে যাচ্ছে ঢাকার এ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।

 

জালিয়াতির অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় এবং সড়ক ও জনপথ বিভাগ থেকে একাধিক তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও থমকে আছে সেই কার্যক্রম। এর বাইরে সড়ক ও জনপথ বিভাগের বিভিন্ন জেলার নির্বাহী প্রকৌশলীরা আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশন টেন্ডার পেতে ভুয়া অভিজ্ঞতা সনদ ব্যবহার করছে, এমন তথ্যের বিষয়ে অন্তত এক বছর আগে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অবগত করা হলেও ব্যবস্থা নিচ্ছেন না সংশ্লিষ্টরা। এই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দিতে ও জালিয়াতি গোপন করতে সহযোগিতা করছেন সওজের ঢাকা জোনের এক প্রকৌশলীসহ বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা।

 

হিসাবনুযায়ী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি ৫ম বছরে সর্বোচ্চ প্রায় পৌঁনে ৫ কোটি টাকা মূল্যের কাজ করতে পারে। তবে অদৃশ্য ক্ষমতাবলে পাঁচ বছরে প্রতিষ্ঠানটি সড়ক বিভাগের অন্তত ৪৭১ কোটি টাকার কাজে অংশ নিয়েছে। নিয়মভঙ্গের পাশাপাশি জালিয়াতি করে করা অভিজ্ঞতা সনদ ব্যবহার করে কাজ পেলেও অদৃশ্য কারণে নীরব ভূমিকা পালন করছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়।

 

সিপিটিউর তথ্য অনুযায়ী, আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশন ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৪ কোটি ৯ লাখ টাকা, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৪৩ কোটি ৩২ লাখ টাকা, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৯৯ কোটি ৫৭ লাখ টাকা এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে ৬০ কোটি ২৪ লাখ টাকা মূল্যের একক ও যৌথ কাজ করেছে। ২০২১-২২ অর্থবছরের কাজ চলমান রয়েছে।

 

প্রতিষ্ঠানটি প্রথম কাজ পায় ২০১৭-১৮ অর্থবছরে। ২০১৭ সালের ২৮ ডিসেম্বর পাওয়া কাজটি ছিল ঢাকা-আরিচা ন্যাশনাল হাইওয়ে রোড এন-৫ এর ২২ কিলোমিটার পেইন্টিং রোড মিডিয়ান পেইন্ট এবং থিনার সরবরাহ করা। যার টেন্ডার নং- ১৪২৫০৬। এ কাজের মূল্য ছিল ২২ লাখ ৮৪ হাজার টাকা। আর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ঢাকা সড়ক বিভাগের অধীনে জাতীয় মহাসড়ক (এন-৫) এবং বসিলা ব্রিজ অ্যাপ্রোচ রোড গাবতলী ব্রিজ, সাভার বাজার এলাকা এবং ঢাকা-আরিচা নবীনগরে ফিটিংসহ স্ট্রিট লাইট স্থাপনের প্রথম কাজ পায় আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশন। এ কাজের মূল্য ছিল ৪ কোটি টাকা। যার টেন্ডার নং- ২৬১৬৩১।

 

সওজ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে সড়ক বিভাগে কাজ পায় আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশন। শুরুর বছরে এককভাবে ৯২ লাখ টাকার কাজ করে প্রতিষ্ঠানটি। টেন্ডার ক্যাপাসিটি অনুযায়ী, শুরুর প্রথম পাঁচ বছরে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান টাকার অংকে পূর্বের বছরের দেড় গুণ বড় কাজ পেতে পারে। সেই হিসেবে পরের অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটি সর্বোচ্চ এক কোটি ৩৮ লাখ টাকা মূল্যের কাজ পেতে পারে। সেই জায়গায় প্রতিষ্ঠানটি দ্বিতীয় অর্থবছরেই এককভাবে প্রায় ২১ কোটি টাকা মূল্যের কাজ করেছে।

 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশন এখন পর্যন্ত স্বাক্ষর জাল করে শতাধিক কাজের ভুয়া কম্পলিশন সার্টিফিকেট তৈরি করেছে। আর এসব ভুয়া অভিজ্ঞতা সনদ জমা দিয়ে সওজের বড় বড় প্রকল্প হাতিয়ে নিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। এছাড়া সড়ক ও জনপথ বিভাগে শক্তিশালী সিন্ডিকেট তৈরি করে টেন্ডার ক্যাপাসিটি না থাকা সত্তে¡ও বড় বড় প্রকল্প বাগিয়ে নিচ্ছে এই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।

 

আর এই সিন্ডিকেটে সড়ক ও জনপথ বিভাগ ঢাকা জোনের এক প্রকৌশলীসহ বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা জড়িত আছেন। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি কাজ পেতে সড়ক ও জনপথ বিভাগের বিভিন্ন জেলার নির্বাহী প্রকৌশলীদের স্বাক্ষর জালিয়াতি করেছে। কুড়িগ্রাম ও কক্সবাজার জেলায় সড়ক বিভাগের বড় বড় প্রকল্প হাতিয়ে নিতেও ভুয়া কাজের অভিজ্ঞতা সনদ দেখিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। আর এতে ব্যবহার করা হয়েছে সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলায় করা কাজের ভুয়া অভিজ্ঞতা সনদ।

 

শুধু সনদ জালিয়াতি নয় টেন্ডার ক্যাপাসিটি না থাকার পরও কিছু সওজ কর্মকর্তার যোগসাজশে কোনো ধরনের নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে একের পর এক কাজ বাগিয়ে নিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। বড় প্রকল্প পেতে কাজ না করেই কম্পলিশন সার্টিফিকেট (সমাপনী সনদ) জমা দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে নিম্ন মানের কাজ করার অভিযোগও রয়েছে।

 

সম্প্রতি লক্ষীপুর সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের এক কোটি ৮৩ লাখ টাকার তিনটি কাজ বাগিয়ে নিতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশনের বিরুদ্ধে ভুয়া অভিজ্ঞতা সনদ ব্যবহারের অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনায় প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ভুয়া সনদ ব্যবহারের অভিযোগ এনে সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোতে লিখিত অভিযোগ করে লক্ষীপুরের মেসার্স নাহার এন্টারপ্রাইজ।

 

গত বছরের ২০ নভেম্বর করা প্রতিষ্ঠানটির অভিযোগে বলা হয়, টেন্ডার পেতে আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশন কোটি টাকার কাজের টার্নওভার বা কার্য সম্পাদনের যে সকল অভিজ্ঞতা দেখিয়েছে, তা ভুয়া সনদ। এছাড়াও শত শত অভিযোগ রয়েছে বলে আবেদনে জানানো হয়।

 

আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশনের বিরুদ্ধে প্রতারণা এবং ভুয়া সার্টিফিকেট দাখিলের পুরনো অভিযোগও রয়েছে। ভুয়া সার্টিফিকেট দাখিল করার কারণে ২০২২ সালের ১২ জানুয়ারি এবং ১৩ ফেব্রুয়ারি পৃথক দিনে সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলীগণ আলাদা দুটি চিঠি ইস্যু করেন।

 

সাতক্ষীরা সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মীর নিজাম উদ্দিন আহমেদ আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশনের সার্টিফিকেট জালিয়াতির বিষয়টি কুড়িগ্রাম সওজ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলীকে জানান। এতে তিনি আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশনের করা ৩৯টি ভুয়া কম্পলিশন সার্টিফিকেট যুক্ত করে দেন। এছাড়া পৃথক চিঠিতে আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশনের ১০টি ভুয়া কম্পলিশন সার্টিফিকেট যুক্ত করে কক্সবাজার সওজ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলীকেও বিষয়টি জানান।

 

আর বাগেরহাট সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. ফরিদ উদ্দিন ভ‚ইয়া ৫৬টি ভুয়া কম্পলিশন সার্টিফিকেট যুক্ত করে সড়ক বিভাগে পাঠানো সেই প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন এসব সার্টিফিকেট সড়ক বিভাগ থেকে ইস্যু করা হয়নি। এছাড়া এসব চিঠির অনুলিপি সড়ক ও জনপথ বিভাগের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৗশলী, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীসহ দেশের বিভিন্ন জোন ও সার্কেলে পাঠানো হয়েছে। এসব ভুয়া কম্পলিশন সার্টিফিকেট ও চিঠি বিবার্তার কাছে সংরক্ষিত আছে।

 

দু’টো চিঠিতেই আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশনের বিরুদ্ধে ভুয়া কম্পলিশন সার্টিফিকেট (সমাপনী সনদ) দাখিল করে ফ্রডুলেন্স প্র্যাকটিস (প্রতারণামূলক অনুশীলন)-এর সমান শাস্তিযোগ্য অপরাধ করার বিষয়ে অভিযুক্ত করা হয়। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করে পিপিআর-০৮ এর বিধি অনুসারে এবং দরপত্রের শর্তানুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য কর্মকর্তরা সুপারিশ করেন।

 

জানতে চাইলে ব্রাহ্মণবাড়িয়া (তৎকালীন সাতক্ষীরা) সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মীর নিজাম উদ্দিন আহমেদ বলেন, বিষয়টা তদন্তে আছে। আমার যে চিঠি পেয়েছেন ওইটাই ডকুমেন্ট। এর বাইরে কিছু বলতে পারবো না।

 

এছাড়াও দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশনের করা জলিয়াতির বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে লিখিত আবেদন করেছেন সংশ্লিষ্টারা। এসব আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২২ সালের ১৮ অক্টোবর সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সহকারী সচিব মো. দেলোয়ার হোসেন ১০ কার্য দিবসের মধ্যে এ বিষয়ে তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দেয়ার জন্য সড়ক ও জনপথ বিভাগের প্রধান প্রকৌশলীকে নির্দেশনা দেন। সেই চিঠির বিষয় ছিল- আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশন গত ৩ বছরে ভুয়া ও অসত্য তথ্য দিয়ে কাজ পাওয়ায় আর্থিক দুর্নীতি তদন্ত ও জড়িত দায়ী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান।

 

এর সাত দিন পর সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (প্রকিউরমেন্ট সার্কেল) মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ দেশের ১১টি সওজ জোন, তিনটি উইং, সড়ক সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ও নির্বাহী প্রকৌশলীকে তিন কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দেয়ার নির্দেশনা দেন। তবে সেই চিঠিতে আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশনের পুরো নাম না লিখে লেখা হয়েছে- ‘মনুসর কনস্ট্রাকশন’।

 

এদিকে ২০১৭ সালের পর থেকে আবেদ মনসুরের প্রতিষ্ঠান এ পর্যন্ত কাজ করেছে ৪৪১টি। এসব কাজের টেকনিক্যাল ডাটা ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (টিডিএমএস) ও টেন্ডার অ্যান্ড কনট্রাক্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (টিসিইএস) পর্যালোচনা করে দেখা যায়, আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশনের চলমান কাজের ভ্যালু বাদ দিলে প্রতিষ্ঠানটির কোনো টেন্ডার ক্যাপাসিটি থাকে না।

 

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিট (সিপিটিউ)-এর তথ্য অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানটি গত পাঁচ বছরে প্রায় ৪৭১ কোটি টাকা মূল্যের কাজ করেছে। এর মধ্যে প্রায় ২০০ কোটি টাকা মূল্যের যৌথ কাজ রয়েছে।

 

অভিযোগের বিষয়ে জানতে আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশনের স্বত্বাধিকারী আবেদ মনসুরের মুঠোফোনে একাধিক নম্বর থেকে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। মুঠোফোনে কল, এসএমএস এর পাশাপাশি হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ করেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। জানতে চাইলে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মো. ইসহাক বলেন, ফাইল দেখে বলতে হবে তদন্তে কি হয়েছে। টেন্ডার ক্যাপাসিটি না থাকার পরও প্রতিষ্ঠানটি কিভাবে কাজ পাচ্ছে? জানতে চাইলে তিনি বলেন, কারা টেন্ডার একসেপ্ট করেছে, টেন্ডার না দেখে তো বলতে পারব না। আমার পক্ষে বলা সম্ভব না।

 

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সহকারী সচিব (কানেক্টিভিটি শাখা) মো. দেলোয়ার হোসেন বলেন, আমরা ওনাদেরকে (সওজ) মতামত দেয়ার জন্য বলেছি। সময়ের মধ্যে দিতে পারেনি। পরে আমরা আবার রিমাইন্ডার দিয়েছি। ওরা প্রতিবেদন মাঠ পর্যায় থেকে কালেক্ট করে। শুনেছি এখনো কালেক্ট করতে পারেনি।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version