-->
শিরোনাম
বিশ্ব পর্যটন দিবস আজ

বিশ্ব র‌্যাংকিংয়ে তলানিতে পর্যটন শিল্প

শিপংকর শীল
বিশ্ব র‌্যাংকিংয়ে তলানিতে পর্যটন শিল্প

শিপংকর শীল: পর্যটন শিল্পের অপার সম্ভাবনার দেশ বাংলাদেশ। কিন্তু বিদেশি পর্যটক আগমনের তথ্যের ভিত্তিতে বিশ্বের কোন দেশ পর্যটনে কেমন করছে, তার র‌্যাংকিংয়ে দেশটি তলানিতে পড়ে আছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, পর্যটনশিল্পে বিশ্বের ১৮৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪১তম, আর এশিয়ার ৪৬টি দেশের মধ্যে ৪২তম। মুন্ডি র‌্যাঙ্কিংয়ে দক্ষিণ এশিয়ার আট দেশের মধ্যে ছয়টি স্থান পেয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। তবে আগের তুলনায় দেশে পর্যটন শিল্পের প্রসার ঘটছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

 

সারা বিশ্বে পর্যটন শিল্প একটি অন্যতম প্রধান অর্থনৈতিক কর্মকান্ড হিসেবে সুপরিচিত। পর্যটন শিল্প বর্তমান বিশ্বের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের প্রধান হাতিয়ার হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। পর্যটন শিল্পে বিশ্বের বুকে এক অপার সম্ভাবনার নাম বাংলাদেশ। এ দেশের প্রাকৃতিক রূপবৈচিত্র্য পৃথিবীর অন্য দেশ থেকে অনন্য ও একক বৈশিষ্ট্যমন্ডিত।

 

পর্যটন মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন হওয়ায় বাংলাদেশে পর্যটন শিল্পে নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে বলে জানিয়েছেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী। তিনি সম্প্রতি সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশের পর্যটনের পরিকল্পিত উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা অনুযায়ী পর্যটন মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন হয়েছে। এর ফলে দেশের পর্যটন শিল্পে নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দক্ষ নেতৃত্ব ও নির্দেশনায় দেশের অ্যাভিয়েশন শিল্প বিকশিত হয়ে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত হচ্ছে। গত সাড়ে ১৪ বছরে দেশে বিমান পরিবহন অবকাঠামো যুগোপযোগী উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ, যাত্রীসেবা বৃদ্ধি, কারিগরি ও জনদক্ষতা উন্নয়নের মাধ্যমে দেশের অ্যাভিয়েশন খাত উন্নত হয়েছে।

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূইয়া বলেন, বাংলাদেশে পর্যটন শিল্পের অপার সম্ভাবনা বিরাজমান। কিন্তু এ বিশাল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও সঠিক পরিকল্পনার অভাবে আমরা পর্যটন শিল্পে পিছিয়ে আছি। এ শিল্পের উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন সমন্বিত পরিকল্পনা। পর্যটন শিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত সবপক্ষকে নিয়ে একসঙ্গে কাজ করে যেতে হবে। দেশীয় পর্যটন বিকাশের পাশাপাশি বিদেশি পর্যটক আকর্ষণে প্রচার-প্রচারণার ওপর গুরুত্বারোপ করতে হবে। পাশাপাশি এ শিল্পের উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। সঠিক কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা গেলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে পর্যটন শিল্প অন্যতম ভূমিকা পালন করতে পারবে।

 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে রয়েছে বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার, সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন, রয়েছে টাঙ্গুয়ার হাওরসহ দেশের অসংখ্য হাওর-নদী-নালা-খাল-বিল ও নানা প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ পর্যটনকেন্দ্র। এরপরও বিশ্বে পর্যটনশিল্পে বাংলাদেশের অবস্থান তলানিতে। বিদেশি পর্যটক আকর্ষণ দূরে থাক, দেশের পর্যটকদের ধরে রাখতে পারছে না পর্যটন সংস্থাগুলো। বিদেশি পর্যটক আগমনের তথ্যের ভিত্তিতে বিশ্বের কোনো দেশ পর্যটনে কেমন করছে এর র‌্যাঙ্কিং করে মুন্ডি ইনডেক্স।

 

মুন্ডি ইনডেক্সের তথ্যে ১৯৯৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত দুই যুগে ৫২ লাখের কিছু বেশি বিদেশি পর্যটক বাংলাদেশে আসেন। এর মধ্যে ২০০৮ সালে দেশে সবচেয়ে বেশি ৪ লাখ ৬৭ হাজার বিদেশি পর্যটক এসেছেন। আর বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড (বিটিবি)-এর তথ্য বলছে, ২০১৯ সালে বাংলাদেশে সর্বোচ্চ সংখ্যক বিদেশি পর্যটক এসেছিল ৬ লাখ ২১ হাজার ১৩১ জন।

 

কিন্তু ২০২০ সালে ১ লাখ ৮১ হাজার ৫১৮ জন এবং ২০২১ সালে ১ লাখ ৩৫ হাজার ১৮৬ জন বিদেশি পর্যটক আসেন। করোনা শেষে প্রতিবেশী দেশগুলোতে বিদেশি পর্যটকদের ঢল নামলেও বাংলাদেশের চিত্র ভিন্ন। পর্যটন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনাসহ বেশ কিছু কারণে দেশের পর্যটন স্থানগুলোতে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পর্যটকের সংখ্যা কমে গেছে।

 

বিটিবির তথ্যে, বাংলাদেশে ঘুরতে আসা বিভিন্ন দেশের পর্যটকদের মধ্যে আছেন ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, যুক্তরাজ্য, জাপান, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, নেপাল ও সৌদি আরবের মানুষ। এই পর্যটকরা বেশি ঘুরতে যান সুন্দরবন, কক্সবাজার ও সেন্টমার্টিনে।

 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মূলত বিনোদনের ব্যবস্থা না থাকা, ভ্রমণ ব্যয় বেশি, পর্যটকবান্ধব পরিবেশ গড়ে না ওঠায় এবং পর্যটন ব্র্যান্ডিং না থাকা, ভিসা জটিলতাসহ বেশ কিছু কারণে বাংলাদেশে না এসে দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোতে চলে যাচ্ছেন বিদেশি পর্যটক। অতিরিক্ত ভ্রমণ ব্যয়, বিনোদনের অভাবে বাংলাদেশিরাও ছুটি কাটাতে ছুটে যাচ্ছেন পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে। অথচ মালয়েশিয়া, সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলো বিদেশি পর্যটক আকর্ষণে নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখনো পিছিয়ে।

 

বিদেশি পর্যটকদের অভিযোগ, সন্ধ্যার পর দেশের পর্যটন স্থানগুলোতে বিনোদনের কোনো ব্যবস্থা নেই। আবার বিদেশি পর্যটকদের জন্য বার, ক্যাসিনো, স্পার মতো সেবা দেয়ার কথা সংশ্লিষ্টরা বারবার বললেও এগুলোর অনুমোদন পাওয়া বেশ কঠিন বলে জানা গেছে। এদিকে বাংলাদেশে বিদেশি পর্যটক যেমন আকর্ষণ করা যাচ্ছে না একইভাবে দেশের পর্যটকদেরও ধরে রাখতে পারছে না পর্যটন সংস্থাগুলো।

 

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জরিপ বলছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২৯ লাখ ২১ হাজার ৫২০ বাংলাদেশি পর্যটক বিদেশে যান। এদের ৬০ ভাগের বেশি যান ভারতে। দেশীয় পর্যটকদের মধ্যে উল্লেখসংখ্যকই যান ভারতে। ২০২২ সালে ভারতে যে পরিমাণ পর্যটক গেছেন এর মধ্যে ২০ শতাংশ ছিল বাংলাদেশি, যা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। সে বছর পর্যটকদের মধ্যে ১২ লাখ ৫৫ হাজার ৯৬০ জন বাংলাদেশি ছিল। ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে জুনের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে দেশটিতে গেছে মোট পর্যটকের ২৩.৫ শতাংশ। পর্যটন ছাড়াও ভিসাসংক্রান্ত কাজ, চিকিৎসা ও ব্যবসার কাজেও বাংলাদেশ থেকে মানুষ ভারতে যাচ্ছে।

 

দেশীয় পর্যটকরা ভারত ছাড়াও নেপাল, ভুটান, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, মালদ্বীপ ও দুবাই ঘুরতে যাচ্ছেন। মূলত বাংলাদেশের বিভিন্ন পর্যটন স্পটের হোটেল ও রিসোর্টের অতিরিক্ত ব্যয় ও খাবার খরচ বেশি হওয়ায় মানুষ বিদেশমুখী পর্যটনে আগ্রহী হচ্ছে। সাধারণত ঈদ ও কোনো উৎসবকে কেন্দ্র করে ধনী ও উচ্চ-মধ্যবিত্তরা থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, দুবাই, মালদ্বীপে ঘুরতে যান আর চিকিৎসা ও কেনাকাটার জন্য ভারত বাংলাদেশিদের পছন্দের গন্তব্য।

 

পর্যটন শিল্পের শীর্ষস্থানীয় বাণিজ্য সংগঠন ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (টোয়াব) সাবেক সভাপতি মো. রাফিউজ্জামান বলেন, দেশীয় পর্যটকদের অনেকে ভারত, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, দুবাই, নেপাল ভ্রমণে যান। তবে ভারতে যে বিপুলসংখ্যক মানুষ যাচ্ছেন তাদের সবাই পর্যটক নন। এদের কেউ আত্মীয়ের কাছে যাচ্ছেন আবার কেউ যাচ্ছেন চিকিৎসা করাতে। বর্তমানে আমরা দেশীয় পর্যটন খাতের বিকাশের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছি। দেশের পর্যটন খাতও এখন বেশ ভালো অবস্থায় আছে। দেশের রাজস্ব ধরে রাখতে আমরা দেশীয় পর্যটন খাতের বিকাশের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছি।

 

অপার সম্ভাবনা: সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, অপূর্ব সৌন্দর্যের আধার বাংলাদেশ যার প্রাকৃতিক রূপবৈচিত্র্যের কোনো অভাব নেই। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন, পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার, পার্বত্য চট্টগ্রামের অকৃত্রিম সৌন্দর্য, সিলেটের সবুজ অরণ্যসহ আরো অনেক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি আমাদের বাংলাদেশ। কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত পৃথিবীর একমাত্র দীর্ঘতম অবিচ্ছিন্ন সমুদ্রসৈকত, যা আর পৃথিবীর অন্য কোথাও নেই। ১২০ কিমি. দীর্ঘ সৈকতটিতে কাদার অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। তাই তো পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সমুদ্রসৈকতের চেয়ে কক্সবাজারের সমুদ্রসৈকত বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ এবং এর রয়েছে অপার সম্ভাবনা। বর্তমানে কক্সবাজারকে কেন্দ্র করে নেয়া হচ্ছে নানা পরিকল্পনা।

 

সম্প্রতি কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত সাগরের পাড়ে ৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ মেরিন ড্রাইভ নির্মাণ দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে পর্যটন নগরী কক্সবাজারের আকর্ষণ আরো বাড়িয়ে দেবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে পর্যটক আকর্ষণে কক্সবাজারে তিনটি পর্যটন পার্ক তৈরির পরিকল্পনা করেছে বর্তমান সরকার। প্রতি বছর এতে বাড়তি ২০০ কোটি মার্কিন ডলারের অর্থনৈতিক কার্যক্রমের সুযোগ সৃষ্টি হবে। এ তিনটি ট্যুরিজম পার্ক হল সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক, নাফ ট্যুরিজম পার্ক এবং সোনাদিয়া ইকো ট্যুরিজম পার্ক।

 

সুন্দরবন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনভূমি। এর মোট বনভূমির ৬০ শতাংশ অর্থাৎ ৬০১৭ বর্গকিলোমিটার রয়েছে বাংলাদেশে এবং বাকি অংশ রয়েছে ভারতের মধ্যে।

 

পর্যটনের অপার সম্ভাবনার নাম বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চল যা পার্বত্য চট্টগ্রাম নামে অধিক পরিচিত। পার্বত্য চট্টগ্রাম মূলত তিনটি জেলা নিয়ে গঠিত। এটি বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের একটি এলাকা, যা তিনটি জেলা, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান নিয়ে গঠিত। পার্বত্য চট্টগ্রামে পর্যটনের মূল উপকরণ হল পাহাড়ে ঘেরা সবুজ প্রকৃতি যা ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্নরূপে পর্যটকদের কাছে ধরা দেয়। এটি যেন ক্ষণে ক্ষণে প্রকৃতির রূপ বদলানোর খেলা।

 

নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ভরপুর বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চল। এ শহরে রয়েছে উপমহাদেশের সর্বপ্রথম ও সর্ববৃহৎ চা বাগান মালনীছড়া চা বাগান। এ অঞ্চলে আসা পর্যটকদের মন জুড়ায় সৌন্দর্যের রানীখ্যাত জাফলং, নীলনদ খ্যাত স্বচ্ছ জলরাশির লালাখাল, পাথর জলের মিতালিতে বয়ে যাওয়া বিছনাকান্দির নয়নাভিরাম সৌন্দর্য, পাহাড় ভেদ করে নেমে আসা পাংথুমাই ঝরনা, সোয়াম্প ফরেস্ট রাতারগুল, ‘মিনি কক্সবাজার’ হাকালুকি এবং কানাইঘাটের লোভাছড়ার সৌন্দর্য।

 

বাংলাদেশের হাওর অঞ্চল পর্যটনের আরেক সম্ভাবনার নাম। বাংলাদেশের জেলাগুলোর মধ্যে সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা, সিলেট, কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া এ সাতটি জেলার ৭ লাখ ৮৪ হাজার হেক্টর জলাভূমিতে ৪২৩টি হাওর নিয়ে হাওরাঞ্চল গঠিত।

 

হাওর অঞ্চলের সাগরসদৃশ বিস্তীর্ণ জলরাশির এক অপরূপ মহিমায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version