-->

শুরুতেই শেষ সংলাপ

নিখিল মানখিন
শুরুতেই শেষ সংলাপ

নিখিল মানখিন: আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকেন্দ্রিক সৃষ্ট সংকট সমাধানে দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে সংলাপের বিষয়টি আবার সামনে চলে এসেছে। কিন্তু সংলাপ বা সমঝোতার কোনো লক্ষণ নেই।

 

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, নিজেদের অবস্থানে অনড় রয়েছে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ। বিএনপির শর্তযুক্ত সংলাপে যাবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে আওয়ামী লীগ। আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন হতে দেবে না বলে ঘোষণা দিয়ে এক দফা আন্দোলনে অনড় রয়েছে বিএনপি। ফলে আলোচিত সংলাপের বিষয়টি শুরুর আগেই শেষ হয়ে যাচ্ছে।

 

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রধান দুটি দলের মধ্যে রাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়ছে। বিএনপি এক দফা আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছে। এক দফা দাবিতে তারা আগস্টজুড়েই কিছু কিছু কর্মসূচি পালন করে চলেছে। তারা সরকারকে বড় ধরনের ধাক্কা দিতে চায়। বিএনপির একাধিক নেতার সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ এবং নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে তারা কিছু নিত্যনতুন কর্মসূচির মাধ্যমে সরকারকে টালমাটাল করে দেবে।

 

কর্মসূচিগুলোর কথা বিএনপি নেতারা ভাবছেন এবং অত্যন্ত গোপনীয়তার মাধ্যমে তারা আন্দোলনের কর্মসূচি চূড়ান্ত করছেন। এমন পরিস্থিতিতে দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে সংলাপের বিষয়টি আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনাকালে বাংলাদেশ সফরকারী মার্কিন প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দলের সদস্যরা সংলাপের বিষয়টি উত্থাপন করেন। এভাবে বিষয়টি আবাপর আলোচনায় চলে এসেছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রতিক্রিয়ায় সংলাপ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে না।

 

গত রোববার সচিবালয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, বিএনপি চায় প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ, সংসদ ভেঙে দেয়া, নির্বাচন কমিশন বাতিল করা এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করা। সংলাপের চিন্তা করব তখন, যখন তারা (বিএনপি) চারটি শর্ত প্রত্যাহার করে নেবে। শর্তযুক্ত কোনো সংলাপের ব্যাপারে আমাদের কোনো চিন্তাভাবনা নেই। শর্ত তারা প্রত্যাহার করলে দেখা যাবে। অন্যবিষয় (মার্কিন প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দলের সুপারিশ) নিয়ে আমাদের কোনো আপত্তি নেই, ওগুলো নিয়ে আমরা সবাই একমত।

 

ওবায়দুল কাদের বলেন, প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করলে বিএনপি কার সঙ্গে সংলাপ করবে? তারা এর আগে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সংলাপ খারিজ করে দিয়েছে। নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে দুই দফা তারা যাননি। এই প্রস্তাবগুলো নিয়ে তারা বিএনপির সঙ্গে কথা বলুক।

 

ওবায়দুল কাদের আরো বলেন, আমাদের সংবিধানে সব আছে। সংবিধানে যেভাবে নির্বাচন বিধিবিধান আছে সেভাবে নির্বাচন হবে। কারো পরামর্শ বা নির্দেশমতো হবে না। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হবে।

 

সোমবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, শর্ত দিয়ে কখনো সংলাপ হতে পারে না। বিএনপির জনগণের ওপর কোনো আস্থা নেই। এজন্য তারা জনগণের দিকে না তাকিয়ে কাকের মতো দূর দেশ থেকে কে কী বলল, সেদিকে তাকিয়ে থাকে।

 

শেখ হাসিনার পদত্যাগ, সংসদ বাতিল ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার করতে হবে- বিএনপির এই সমস্ত শর্ত দিয়ে কখনো সংলাপ হতে পারে না। ক্ষমতার মালিক জনগণ। আমরা জনগণের শক্তিতে বলীয়ান, জনগণই এ দেশের মালিক, জনগণই নির্ধারণ করবে কারা দেশ পরিচালনা করবে, কারা দেশ পরিচালনা করবে না।

 

এদিকে সোমবার রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপি কার্যালয়ের সামনে জাতীয়তাবাদী যুবদল আয়োজিত যুব সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, কথা একটাই, আমরা অনেক কিছু হারিয়েছি। অনেক মা সন্তান হারিয়েছেন। আর পেছনে ফেরার সুযোগ নেই।

 

বিএনপি নেতারা নিশ্চিত করেছেন, তারা সরকারকে দম ফেলার সুযোগ দেবে না এবং এই রকম একটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমেই তারা সরকারকে পতন করবে। বিএনপির বিভিন্ন নেতারা বলছেন, যদি তারা একটি অস্থির পরিস্থিতি তৈরি করে সরকারকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায়ে বাধ্য করতে পারে, তাহলে তারা আন্দোলনে বিজয়ী হবে। অর্থাৎ স্বল্প সময়ের একটি টর্নেডো দিয়ে বিএনপি সরকারকে হঠাতে চায়।

 

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তফসিল ঘোষণা হতে পারে আগামী নভেম্বর মাসে। তাই অক্টোবরের শেষ দিকেই আন্দোলনে পূর্ণ শক্তি চায় বিএনপি। সেভাবে কৌশল ঠিক করছে দলটি। বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে নেতাকর্মীদের এমন বার্তা দেয়া হচ্ছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া এবার যেন আওয়ামী লীগ এক তরফা নির্বাচনের দিকে যেতে না পারে সেই পরিস্থিতি তৈরি করা হবে বিএনপির নেতাকর্মীরা জানিয়েছেন। তবে আগস্টে আবার গণমিছিল-পদযাত্রা কর্মসূচি নিয়ে এক দফার যুগপৎ আন্দোলনে ফিরে আসে বিএনপি। সেই আন্দোলনকে অক্টোবরের শেষ দিকে চ‚ড়ান্ত ধাপে নিয়ে যেতে চাইছে বিএনপি।

 

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, যদিও সরকার পতনের এক দফা দাবিতে কী ধরনের কর্মসূচি আসতে পারে সে বিষয়ে শীর্ষনেতারা খোলাসা করে কিছু বলছেন না। তবে দলটির একটি সূত্র জানায়, আগস্ট মাসে সমাবেশ, বিক্ষোভ ও পদযাত্রার মতো কর্মসূচিতে সীমাবদ্ধ থাকলেও চূড়ান্ত আন্দোলনে ফের রাজধানীর প্রবেশমুখে অবস্থান, ঢাকা ঘেরাও, সচিবালয় ঘেরাও এবং লাগাতার অবস্থান কর্মসূচির মতো কঠোর কর্মসূচিতে যাবে বিএনপি। তবে, এসব কর্মসূচিতে অতীতের মতো আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং সরকার সমর্থকদের বাধার সম্মুখীন হলেও রাজপথে মোকাবিলা করার নির্দেশনা দেয়া হবে বলে জানা গেছে।

 

আওয়ামী লীগ নির্বাচনমুখী রাজনীতিতেই অটল থাকতে চায়, যত বিদেশি চাপ বা হস্তক্ষেপ হোক না কেন- আওয়ামী লীগ সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রেখে নির্বাচনের পথে এগুনোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আওয়ামী লীগের সভাপতি কেন্দ্রীয় কমিটির বর্ধিত সভায় নির্বাচনের ব্যাপারে সুস্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন। এখান থেকে পিছু হটার কোনো উপায় নেই বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগের নেতারা। সংবিধান অনুযায়ী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যাওয়ার বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছে আওয়ামী লীগ। বিএনপির কর্মসূচি পর্যবেক্ষণ করে ঢাকায় নিজেদের সাংগঠনিক শক্তি দেখাবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।

 

আগামীকাল ১৮ অক্টোবর বিএনপির কর্মসূচির দিনে আওয়ামী লীগ ও কর্মসূচি পালন করবে বলে ঘোষণা দেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, ১৮ তারিখ আমরাও এই বঙ্গবন্ধু এভিনিউ, গুলিস্তান এলাকা, দক্ষিণ গেটে জমায়েত করব।’ নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘আপনাদের বলি, ১৮ তারিখে আরো বেশি করে আসতে হবে।

 

বিএনপিকে মোকাবিলায় আওয়ামী লীগ প্রস্তুত আছে জানিয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘আমরাও প্রস্তুত আছি। অবরোধ করলে বিএনপি অবরোধ হয়ে যাবে। এখন চুরি করে ঢুকছ। পরে পালাবার সময় পাবা না বলে সতর্ক করেন কাদের।

 

এদিকে, সংলাপ নিয়ে ক্ষমতাসীনদের সাম্প্রতিক বক্তব্যকে খানিকটা নমনীয়তা বলেও মনে করছেন বিএনপি নেতাদের অনেকে। তবে এ নমনীয়তা যথেষ্ট নয় মতো দিয়ে তারা বলছেন, বিদেশি শক্তি ও আন্দোলনের চাপে সরকার এখন নমনীয় হয়েছে এবং বাধ্য হয়েই সংলাপের কথা বলছে। সেদিক থেকে বিএনপি একটু সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে।

 

এ অবস্থায় আগ বাড়িয়ে সংলাপের জন্য আপাতত কোনো ছাড় দেয়ার চিন্তা করছে না বিএনপি। আওয়ামী লীগের অধীনে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেয়াকে আত্মহত্যার শামিল বলে মনে করছেন বিএনপি নেতারা। তাই ক্ষমতা ছাড়ার আগে তাদের সঙ্গে সংলাপ করাকে অর্থহীন বলেও মনে করছেন তাদের অনেকে।

 

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু গত রোববার সাংবাদিকদের বলেন, সরকার বাধ্য হয়ে সংলাপের কথা বলছে। কিন্তু সেই সংলাপ শর্তযুক্ত না শর্তহীন হবে, তা নির্ধারণ করার ক্ষমতা সরকার এখনো রাখে না।

 

তবে তিনি বলেছেন, ‘রাজনীতি’ চলমান এবং আগামীতে আমাদের কোথায় গিয়ে দাঁড়াতে হবে, সেটাও এখনো নির্ধারিত নয়।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version