তামাক কোম্পানির অব্যাহত হস্তক্ষেপ তামাকমুক্ত বাংলাদেশ অর্জনে প্রধান বাধা হিসেবে কাজ করছে। ‘তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপ সূচক, ২০২৩’ এ বাংলাদেশের স্কোর ৭২, যা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বেশি খারাপ। প্রতিবেদন অনুযায়ী চলমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন ঘিরে সবচেয়ে বেশি হস্তক্ষেপ হয়েছে। তিন বছরেও খসড়া সংশোধনী পাস করতে পারেনি সরকার।
আজ (২৬ নভেম্বর) গবেষণা ও অ্যাডভোকেসি প্রতিষ্ঠান প্রজ্ঞা (প্রগতির জন্য জ্ঞান) এবং অ্যান্টি টোব্যাকো মিডিয়া এলায়েন্স (আত্মা) আয়োজিত ‘তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপ সূচক: এফসিটিসি আর্টিক্যাল ৫.৩ বাস্তবায়ন প্রতিবেদন, বাংলাদেশ ২০২৩’ বিষয়ক ওয়েবিনারে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রীর পরিবেশ ও জলবায়ু বিষয়ক বিশেষ দূত সাবের হোসেন চৌধুরী এমপি বলেন, “আইন শক্তিশালীকরণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা রয়েছে। তারপরও আইন সংশোধনে এত সময় লাগছে কেন। আমরা বলি স্বাস্থ্যখাতে আমাদের অর্জন অনেক। তাহলে তামাকের কারণে এত মানুষ মারা যায়, আমরা কেন কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারিনা। জনস্বাস্থ্যকে আমাদের প্রাধান্য দিতে হবে।”
সভাপতির বক্তব্যে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবং জাতীয় তামাকবিরোধী মঞ্চের আহ্বায়ক ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, “তামাক কোম্পানি থেকে সরকারের শেয়ার প্রত্যাহার করতে হবে। তামাক কোম্পানিকে পুরস্কৃত করা যাবেনা এবং সিএসআর কার্যক্রম সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করতে হবে। কয়েক বছর ধরেই আমরা এসব বলে আসছি, কিন্তু কাজ হচ্ছেনা। হয়ত একসময় আমাদের নীতিনির্ধারক ও সরকারি দপ্তরগুলোতে যারা আছেন তারা আমাদের কথা শুনবেন।”
জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেল এর সমন্বয়কারী (অতিরিক্ত সচিব) হোসেন আলী খোন্দকার বলেন, “আইন সংশোধন প্রক্রিয়ায় আমরা অনেকটাই অগ্রগতি লাভ করেছি। তবে তামাক কোম্পানিগুলো বার বার বাধা দেয়ার চেষ্টা করছে। আমাদের সজাগ থাকতে হবে।”
গ্লোবাল সেন্টার ফর গুড গভার্নেন্স ইন টোব্যাকো কন্ট্রোল (জিজিটিসি) এর হেড অব গ্লোবাল রিসার্চ অ্যান্ড অ্যাডভোকেসি ড. মেরি আসুন্তা বলেন, “স্পষ্টতই বহুজাতিক তামাক কোম্পানিগুলো এশিয়া এবং বাংলাদেশকে তাদের মুনাফা বাড়ানোর একটি গুরুত্বপূর্ণ বাজার হিসেবে পেতে চায়। কাজেই মুনাফা হুমকিতে পরে এমন যেকোনো সরকারি পদক্ষেপকে চ্যালেঞ্জ ও বিরোধিতা করবে তারা।
তবে সরকার জনস্বাস্থ্য রক্ষা করতে বাধ্য, মৃত্যুবিপণনকারী কোন শিল্পকে নয়। ডব্লিউএইচও এফসিটিসি এর আর্টিক্যাল ৫.৩ একটি শক্তিশালী হাতিয়ার যা সরকার জীবন বাঁচাতে এবং একটি স্বাস্থ্যকর বাংলাদেশ বিনির্মাণে ব্যবহার করতে পারে।”
গবেষণায় দেখা গেছে, তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপ মোকাবেলা এবং আর্টিক্যাল ৫.৩ এর নির্দেশনাবলী বাস্তবায়নে কোন অগ্রগতিই হয়নি বাংলাদেশে। আইন সংশোধন হলে সরকার কোটি কোটি টাকার রাজস্ব হারাবে উল্লেখ করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) চিঠি দেয় ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো (বিএটিবি)। তামাক কোম্পনির এধরনের অপব্যাখা আমলে নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে পরবর্তীতে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগকে চিঠি দেয় এনবিআর। আইন সংশোধনের বিরোধিতা করে প্রধানমন্ত্রী বরাবর চিঠি প্রদান করে জাতীয় ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সমিতি (নাসিব)।
এছাড়া তামাক কোম্পানির মদদপুষ্ট বেশকিছু তথাকথিত আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ ই-সিগারেট নিষিদ্ধ না করতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বরাবর চিঠি পাঠায় এসময়। স্বাস্থ্যের সাথে সংশ্লিষ্ট নয় এমন মন্ত্রণালয়, সরকারি ও স্বায়ত্বশাসিত সংস্থার সাথে বৃক্ষরোপণ, পানি বিশুদ্ধকরণ, সোলার প্যানেল, কোভিড ভ্যাকসিন রেজিস্ট্রেশন বুথ স্থাপন ইত্যাদি সিএসআর কার্যক্রম পরিচালনা করতে দেখা গেছে কোম্পানিগুলোকে। বরাবরের মতোই মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী এবং সচিবদের উপস্থিতিতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডসহ বিভিন্ন সরকারি সংস্থার পক্ষ থেকে তামাক কোম্পানিগুলোকে পুরস্কৃত করতে দেখা গেছে।
এভাবে প্রভাবশালী সরকারি বিভিন্ন সংস্থা ও নীতি-নির্ধারকদের সান্নিধ্যে এসে ভবিষ্যত হস্তক্ষেপের পথ সুগম করার সুযোগ পেয়েছে কোম্পানিগুলো। তবে, রাষ্ট্রপতির শিল্প উন্নয়ন পুরস্কারের জন্য তামাক কোম্পানিকে অযোগ্য ঘোষণা করা, তামাক কোম্পানির আর্থিক সহায়তায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাথে অনুষ্ঠিতব্য কর্মশালা বাতিলসহ বেশ কিছু ইতিবাচক ঘটনা উঠে এসেছে গবেষণায়।
গবেষণার সুপারিশে তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপমুক্ত থেকে আইন সংশোধনের পাশাপাশি ডব্লিউএইচও এফসিটিসি আর্টিক্যাল ৫.৩ প্রতিপালনে সচেতনতা সৃষ্টি, তামাক কোম্পানির সাথে যোগাযোগ বা আলোচনার ক্ষেত্রে আর্টিক্যাল ৫.৩ এর আলোকে আচরণবিধি চূড়ান্ত করা, তামাক খাতে বিদেশি বিনিয়োগের সুযোগ বন্ধ করা, ১৯৫৬ সালের অত্যাবশ্যকীয় পণ্য নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন করে সিগারেটকে তালিকা থেকে বাদ দেয়া, তামাক কোম্পানিতে সরকারের শেয়ার প্রত্যাহার, এবং একটি সহজ তামাককর ও মূল্য নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের তাগিদ দেয়া হয়েছে।
এবছর বিশ্বের ৯০টি দেশে এই গবেষণা পরিচালিত হয়েছে। সরকারসমূহ তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপ কিভাবে আমলে নেয় এবং হস্তক্ষেপ মোকাবিলায় কি ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করে তা এফসিটিসি আর্টিক্যাল ৫.৩ গাইডলাইনের আলোকে মূল্যায়ন করা হয়ে থাকে এই গবেষণার মাধ্যমে। স্কোর যত কম, হস্তক্ষেপ তত কম। তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপের বৈশ্বিক সূচক ২০২৩ অনুযায়ী সবচেয়ে ভালো করেছে ব্রুনাই (স্কোর, ১৪) এবং সবচেয়ে খারাপ করেছে ডোমিনিকান রিপাবলিক (স্কোর, ১০০)।
বাংলাদেশের স্কোর ৭২, যা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে খারাপ। প্রজ্ঞা (প্রগতির জন্য জ্ঞান) ২০১৮ সাল থেকে ‘তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপ সূচক, বাংলাদেশ’ প্রকাশ করে আসছে। ব্লুমবার্গ ফিল্যানথ্রপিস এর সহায়তায় এই গবেষণা কার্যক্রমে সার্বিক সহযোগিতা প্রদান করেছে সাউথইস্ট এশিয়া টোব্যাকো কন্ট্রোল অ্যালায়েন্স (সিটকা) এবং গ্লোবাল সেন্টার ফর গুড গভার্নেন্স ইন টোব্যাকো কন্ট্রোল (জিজিটিসি)।
অনুষ্ঠানে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনায় অংশ নেন মো. মোস্তাফিজুর রহমান, লিড পলিসি অ্যাডভাইজর, ক্যাম্পেইন ফর টোব্যাকো ফ্রি কিডস (সিটিএফকে), বাংলাদেশ; সৈয়দ মাহবুবুল আলম, টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজার, ভাইটাল স্ট্র্যাটেজিস, বাংলাদেশ; নাদিরা কিরণ, কো-কনভেনর, আত্মা এবং এবিএম জুবায়ের, নির্বাহী পরিচালক, প্রজ্ঞা। আত্মা’র কনভেনর মতুর্জা হায়দার লিটন অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন।
প্রজ্ঞা’র কোঅর্ডিনেটর নাফিউর আহমেদের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে গবেষণা ফলাফল উপস্থাপন করেন প্রজ্ঞা’র কর্মসূচি প্রধান মো: হাসান শাহরিয়ার। গবেষণা ফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে বিভিন্ন গণমাধ্যমসহ তামাকবিরোধী সংগঠন এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিবৃন্দ অংশগ্রহণ করেন।
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য