-->

আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ জয়

নিজস্ব প্রতিবেদক
আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ জয়
আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

সব জল্পনা-কল্পনা, হুমকি, শঙ্কা আর গুজবের অবসান ঘটিয়ে দেশে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল আরও একটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এটি বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। বিএনপিসহ দেশের কয়েটিদল নির্বাচন আটকানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা থাকলেও শেষ পর্যন্ত তা সফল হয়নি। গতকাল অনিুষ্ঠিত এই নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয় পায় আওয়ামী লীগ। এর মধ্যে দিয়ে দলটি টানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করতে যাচ্ছে।

 

মোট ২৯৮টি আসনের ফলাফল ঘোষণা করা হয়। এর মধ্যে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ পেয়েছে ২২৫টি। এছাড়া জাতীয় পার্টি ১১টি, স্বতন্ত্র ও অন্যান্য দল পেয়েছে ৬২টি আসন। এ বছর জাতীয় সংসদের ৩০০টি আসনের মধ্যে গতকাল রোববার ২৯৯টি আসনে নির্বাচন হয়। নওগাঁ-২ আসনের এক স্বতন্ত্র প্রার্থীর মৃত্যু হলে বিধি অনুযায়ী আসনটির ভোট স্থগিত করেছে ইসি। এবার মোট ৪১.৮ শতাংশ ভোট পড়েছে।

 

পূর্ব ঘোষণা অনুয়ায়ী সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত বিরতিহীনভাবে ভোটগ্রহণ চলে। বিএনপিসহ সমমনা দলগুলোর বর্জনের মধ্য দিয়ে দেশের ২৯৯টি সংসদীয় আসনে একযোগে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ভোট বর্জনকারী এ দলগুলো ভোটের আগের দিন থেকে টানা ৪৮ ঘণ্টার হরতালেরও ডাক দেয়। ভোটের আগে ট্রেন, বাসসহ কয়েকটি ভোটকেন্দ্রে অগ্নি সংযোগের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু তারপর কয়েকটি বিছিন্ন ঘটনা ছাড়া শান্তিপূর্ণভাবে ভোট অনুষ্ঠিত হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের সুষ্ঠু ভোটের আয়োজনের বিপরীতে বিএনপিসহ নির্বাচন বর্জনকারী দল নির্বাচন যাতে সফলভাবে সম্পন্ন না হয়, সেই প্রচেষ্টা অব্যাহত ছিল। নির্বাচনে ২৮টি রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরা অংশ নিলেও দলীয় প্রার্থীদের মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সঙ্গে। ২২৫টির মতো আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী ছিল। স্বতন্ত্রদের বেশিরভাগই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সমর্থিত। তাদের মধ্যে অনেকেই রয়েছেন জেলা-উপজেলা পর্যায়ের পদধারী, ছিল বর্তমান সংসদের এমপি।

 

মোট প্রার্থী ছিল ১৯৬৯ জন : এবারের নির্বাচনে দেশের ৪৪টি নিবন্ধিত দলের মধ্যে ২৮টি দল অংশ নিয়েছে। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রার্থী রয়েছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের। দলটির প্রার্থীর সংখ্যা ২৬৫ জন। এ ছাড়া জাতীয় পার্টির ২৬৪ জন, তৃণমূল বিএনপির ১৩৫ জন, ন্যাশনাল পিপলস পার্টির ১২২ জন, বাংলাদেশ কংগ্রেসের ৯৬ জন, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ৫৬ জনসহ নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ২৮টি রাজনৈতিক দলের মোট প্রার্থী সংখ্যা এক হাজার ৫৩৪ জন। আর স্বতন্ত্র প্রার্থী রয়েছেন আরও ৪৩৭ জন। ফলে এবারের নির্বাচনের চূড়ান্ত প্রার্থী সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৯৬৯ জনে। এর মধ্যে পুরুষ প্রার্থী এক হাজার ১৮৭১ জন। ৯৬ জন নারী প্রার্থী, হিজড়া ২ জন ও ৭৯ জন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর প্রার্থীও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। নির্বাচনে অন্যদলগুলোর মধ্যে ইসলামী ফ্রন্ট বাংলাদেশ, ইসলামী ঐক্যজোট, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, গণফোরাম, গণফ্রন্ট, জাকের পার্টি, জাতীয় পার্টি, জাতীয় পার্টি-জেপি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ, তৃণমূল বিএনপি, ন্যাশনাল পিপলস পার্টি, বিকল্প ধারা বাংলাদেশ, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট, বাংলাদেশ কংগ্রেস, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ), বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট-বিএনএফ, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি, বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোট, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পাটি, গণতন্ত্রী ও বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল (এম.এল) প্রার্থী দিয়েছে। দেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল বিএনপিসহ ১৬টি নিবন্ধিত দল এ নির্বাচন বয়কট করেছে।

 

এদিকে ভোট সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের লক্ষ্যে নির্বাচনী ভোটের মাঠের নিয়ন্ত্রণ ছিল আয়োজক সাংবিধানিক সংস্থা নির্বাচন কমিশনের হাতে। ইসির নির্দেশে নিরাপত্তার চাঁদরে ঢেকে ফেলা হয় সারা দেশ। শেষ মুহূর্তে মাঠে ছিল জুডিসিয়াল ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, সেনাবাহিনী, নৌ ও বিমানবাহিনী, বিজিবি, র‌্যাব, পুলিশ ও আনসারসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দখলে।

 

শনিবার সারা দিন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে রিটার্নিং ও সহকারী রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয় থেকে ব্যালট পেপার বাদে বাকি সব নির্বাচনী সামগ্রী বিতরণ করা হয়। এসব নির্বাচনি সামগ্রী নিয়ে প্রিজাইডিং অফিসাররা নিজ নিজ ভোটকেন্দ্রে গিয়ে কেন্দ্র প্রস্তুত ছিল।

 

ছিল ১৯২ বিদেশি পর্যবেক্ষক : নির্বাচন দেখার জন্য যে বিদেশিরা আবেদন জানিয়ে ছিলেন, তাদের মধ্যে ১৯২ জন পর্যবেক্ষক ও সাংবাদিকদের অনুমোদন দিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এদের মধ্যে ১২৬ জন পর্যবেক্ষক আর ৭৬ জন বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের কর্মী রয়েছেন। ৩৪টি দেশ ও চারটি বিদেশি সংস্থার পক্ষ থেকে ভোট পর্যবেক্ষণ করে। ১২৬ জন বিদেশি পর্যবেক্ষকের মধ্যে ১২৬ জন আসছে স্ব-উদ্যোগে এবং এছাড়া নির্বাচন কমিশনের আমন্ত্রণে এসেছেন ৩২ জন। বিভিন্ন দেশের নির্বাচন কমিশনার ও তাদের প্রতিনিধি আসছেন ১৮ জন।

 

দেশীয় পর্যবেক্ষক ২০৭৭৩ জন : নির্বাচন কমিশনে বর্তমানে ৯৬টি নিবন্ধিত দেশীয় পর্যবেক্ষক সংস্থা রয়েছে। এর মধ্যে ৮৪টি এবার নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করছে। এসব সংস্থার মোট ২০ হাজার ৭৭৩ জন পর্যবেক্ষক নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করছেন। এই হিসাবে দেশের মোট ভোটকেন্দ্রের মধ্যে অর্ধেকে দেশীয় পর্যবেক্ষক থাকছেন। এর মধ্যে কেন্দ্রীয়ভাবে ৪০টি পর্যবেক্ষক সংস্থার ৫১৭ জন এবং স্থানীয়ভাবে ৮৪টি পর্যবেক্ষণ সংস্থার ২০ হাজার ২৫৬ জন ভোট পর্যবেক্ষণ করবেন।

 

আচরণবিধি লঙ্ঘনে ব্যবস্থা : তফসিল ঘোষণার পরপরই নির্বাচন কমিশন বিচারিক হাকিমদের সমন্বয়ে নির্বাচনী অনুসন্ধানী টিম গঠন করে। ওই কমিটির মাধ্যমে প্রার্থী, সমর্থক ও নির্বাচনী কর্মকর্তাদের ৭২০টি শোকজ করা হয়েছে। এর মধ্যে ৪৮৪টির ক্ষেত্রে প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে। এর আলোকে আচরণবিধি লঙ্ঘনে ৫১টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। একজনের প্রার্থিতা বাতিল (আদালতে প্রার্থিতা ফেরত পেয়েছেন) করা হয়েছে। এক হাজার ৫১ জনকে জরিমানা করা হয়েছে। মোট জরিমানা করা হয়েছে ৩৩ লাখ ১৫ হাজার ৩০০ টাকা।

 

২ হাজার ৩০০ কোটি টাকার নির্বাচন : দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ব্যয় বেড়ে দাঁড়াচ্ছে প্রায় ২ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। এ নির্বাচনে আসনপ্রতি ৭ কোটি টাকার বেশি ব্যয় করবে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। বিশাল এ বাজেটের বেশিরভাগ অর্থই ভোটের দায়িত্বে থাকা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পেছনে ব্যয় হবে। জানা গেছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থেকে প্রাপ্ত চাহিদা অনুযায়ী সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ১ হাজার ২২৫ কোটি ৬২ লাখ টাকা এবং নির্বাচন পরিচালনা খাতে সম্ভাব্য ব্যয় ১ হাজার ৫০ কোটি ৬০ লাখ টাকা।

 

এবারের নির্বাচনে মোট ১১ কোটি ৯৩ লাখ ৩৩ হাজার ১৫৭ জন ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ পাচ্ছেন। এর মধ্যে ৬ কোটি ৫ লাখ ৯২ হাজার ১৬৯ জন পুরুষ, ৫ কোটি ৮৭ লাখ ৪০ হাজার ১৪০ জন নারী এবং ৮৪৮ জন হিজড়া।

 

দায়িত্বে ছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী : নির্বাচনে সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাড়ে ৭ লাখের বেশি সদস্য মোতায়েন করা হয়। এর মধ্যে ছিল ৫ লাখ ১৪ হাজার ২৮৮ জন আনসার সদস্য ছিল। এর মধ্যে ৮০ হাজার পুলিশ সদস্য মাঠে থেকে নির্বাচনকালীন দায়িত্ব পালন করেছে। বাকি ৯৪ হাজার ৭৬৭ জন ভোটকেন্দ্রের দায়িত্ব পালন করেন। দেশের ৪২ হাজার ২৪টি কেন্দ্রের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্র ১০ হাজারের কিছু বেশি। প্রতিটি সাধারণ কেন্দ্রে ছিল দুই জন পুলিশ, ১২ জন আনসারসহ ১৪-১৫ জন সদস্য। ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রে ৪ জন পুলিশসহ ১৬-১৭ জন দায়িত্ব পালন করে। ঢাকাসহ ৮টি মহানগরীর কেন্দ্রগুলোতে তিন জন পুলিশসহ ১৫ জন এবং মহানগরীর ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রে ৪ জন পুলিশসহ ১৬ জন সদস্য দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া নির্বাচনে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে ৬২টি জেলায় ৩৮ হাজার ১৫৪ জন সেনা সদস্য ও দুটি জেলার সম্পূর্ণসহ ১৯টি জেলার আংশিক এলাকায় দুই হাজার ৮২৭ জন নৌবাহিনীর সদস্য দায়িত্ব পালন করে। আর বিজিবি দায়িত্ব পালন করেন ৪৪ হাজার ৯১২ জন (১১৫১ প্লাটুন), কোস্ট কার্ড দুই হাজার ৩৫৫ জন (৭০ প্লাটুন)। র‌্যাবের থাকছে ৫ হাজার ৫৬০ জন (৬০০ টিম ও ৯৫টি রিজার্ভ টিম)।

 

এবারের নির্বাচনে মোট ৪২ হাজার ২৪টি কেন্দ্র ছিল। ভোট কক্ষ দুই লাখ ৬০ হাজার ৮৫৮টি। এর মধ্যে দুর্গম ২ হাজার ৯৭১ কেন্দ্রে শনিবার (৫ জানুয়ারি) ব্যালট পেপার পাঠানো হয়। এ ছাড়া ভোটের দিন (৭ জানুয়ারি)

 

২২ সদস্যের মনিটরিং সেল : নির্বাচন উপলক্ষে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বয়ে ২২ সদস্যের মনিটরিং সেল গঠন করে কমিশন। এই মনিটরিং সেলের নেতৃত্ব দেন আইডিএ প্রকল্প-২ এর প্রকল্প পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবুল হাসনাত মোহাম্মদ সায়েম। নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী, মনিটরিং সেল শনিবার সকাল ৮টা থেকে ৯ জানুয়ারি সকাল ৮টা পর্যন্ত মোট ৭২ ঘণ্টা পরিচালনা করা হয়। শুক্রবার আইনশৃঙ্খলা সমন্বয় ও মনিটরিং সেলের প্রধান আইডিয়া প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবুল হাসনাত মোহাম্মদ সায়েমের সভাপতিত্বে সেলের প্রাক-পরিকল্পনাবিষয়ক সভা অনুষ্ঠিত হয়।

 

ভোরের আকাশ/ সু

মন্তব্য

Beta version