-->

পোশাকের দাম বৃদ্ধি কথা রাখছে না বিদেশি ক্রেতারা

নিজস্ব প্রতিবেদক
পোশাকের দাম বৃদ্ধি
কথা রাখছে না বিদেশি ক্রেতারা

২০২৩ সালে পোশাক কারখানার উৎপাদন সক্ষমতার ২৭ দশমিক ৫ শতাংশই অলস পড়েছিল। চলতি বছর প্রথম চার মাসেও ৩৮ শতাংশ সক্ষমতা ফাঁকা পড়ে থাকবে বলে জানাচ্ছেন মালিকরা। পোশাক শ্রমিকদের নূন্যতম মজুরি ২৫ হাজার টাকা করার আন্দোলনের সময় যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতা জোট সেই দাবির পক্ষে অবস্থান নেয়। বাড়তি মজুরি নিশ্চিত করতে পোশাকের দাম ৪ থেকে ৬ শতাংশ বাড়ানোর কথাও বলে তারা। বাংলাদেশের পোশাকখাতে শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানোর পর আরো বেশি মজুরির দাবিতে শ্রমিকদের আন্দোলনের সময় যুক্তরাষ্ট্রের একটি ক্রেতা জোট পোশাকের দাম বাড়ানোর কথা বললেও বেশিরভাগ কারখানা মালিকই বাড়তি দর পাচ্ছেন না।

 

২০ শতাংশ কারখানায় পণ্যের কিছুটা বাড়তি দর পাওয়া গেছে বলে এক জরিপে উঠে এসেছে। জরিপে অংশ নেওয়া ৬৬ জন কারখানা মালিকের মধ্যে ৮০ শতাংশই জানিয়েছেন, তারা বিদেশি ক্রেতাদের কাছ থেকে পণ্যের কোনো বাড়তি দর পাননি।

 

জরিপটি গত ২১ ডিসেম্বর করা হয়। ঢাকার উত্তরা ক্লাবে ‘তৈরি পোশাক শিল্পের চ্যালেঞ্জ ও করণীয়’ বিষয়ে উন্মুক্ত আলোচনার আয়োজন করে শিল্প মালিকদের একাংশের জোট ফোরাম। সেখানেই বিজিএমইএর সাধারণ সদস্যদের মধ্য থেকে ৬৬জন কারখানা মালিকের অংশগ্রহণে এই জরিপ চালানো হয়।

 

সাধারণত কারখানাগুলো বিদেশি ক্রেতাদের কাছ থেকে কাজ শুরুর ৩ থেকে ৪ মাস আগে ক্রয়াদেশ নিশ্চিত করে থাকে। ফলে ডিসেম্বরে পরিচালিত জরিপে অন্তত পরের ৩ মাসের ধারণা পাওয়া গেছে। গত ডিসেম্বর মাস থেকে পোশাক খাতের নতুন মজুরি কার্যকর হয়েছে, যেখানে মূল মজুরি ৫৬ দশমিক ২৫ শতাংশ বাড়িয়ে ন্যূনতম মজুরি সাড়ে ১২ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।

 

মজুরি বৃদ্ধির সঙ্গে মিল রেখে বিদেশি ক্রেতারাও যেন পোশাকের মূল্য বাড়িয়ে দেন সেই দাবি ছিল মালিকদের পক্ষ থেকে। বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) সভাপতি ফারুক হাসান পণ্যের মজুরি বৃদ্ধির জন্য ক্রেতাদের বিভিন্ন সংগঠনের কাছে চিঠিও দিয়েছিলেন। মজুরি বৃদ্ধির সময় শ্রমিকদের দাবি ছিল ন্যূনতম মুজরি যেন মাসে ২০ হাজার টাকা থেকে ২৫ হাজার টাকার মধ্যে থাকে। তবে মালিকরা সেই দাবিতে রাজি হননি, সরকার গঠিত মজুরি বোর্ডও মালিক শ্রমিকের দাবির মাঝামাঝি একটা জায়গায় এসে সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

 

সেই সময় এক হাজার পশ্চিমা ফ্যাশন ব্র্যান্ডের জোট আমেরিকান অ্যাপারেল অ্যান্ড ফুটওয়্যার অ্যাসোসিয়েশন গণমাধ্যমে ঘোষণা দিয়েছিল, মজুরি বৃদ্ধির কথা বিবেচনায় নিয়ে পোশাকের ক্রয়মূল্য ৫ থেকে ৬ শতাংশ বাড়াতে রাজি আছেন তাদের সদস্যরা। অবশ্য ২৫ হাজার টাকা ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণে শ্রমিকদের দাবি পূরণ করার পক্ষেও ছিল ক্রেতা জোট।

 

শিল্প মালিকদের নিয়ে জোট ফোরামের দলনেতা ফয়সাল সামাদ ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে জরিপের ফলাফল তুলে ধরেন। গত ডিসেম্বরে পোশাক খাতের ন্যূনতম বেতন বাড়িয়ে ১২ হাজার ৫০০ টাকা করা হয়। তবে শ্রমিকরা ২৫ হাজার টাকা বেতনের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে আসছিলেন। পরে অবশ্য তারা কাজে যোগ দেন। তিনি বলেন, ৭৯ দশমিক ১ শতাংশ কারখানা মালিক পণ্যের কোনো বাড়তি দাম পাননি। ১ শতাংশ বেশি দাম পাওয়ার কথা জানিয়েছেন ৪ দশমিক ৫ শতাংশ কারখানা মালিক। ২ শতাংশ বেশি দাম পাওয়ার কথা জানিয়েছেন ৬ শতাংশ কারখানা মালিক। পণ্যের দাম ৩ শতাংশ বেড়েছে ৩ শতাংশ কারখানায়।

 

প্রায় ৮ শতাংশ কারখানা মালিক দরকষাকষি করে পণ্যের দাম ৪ থেকে ৫ শতাংশ বাড়াতে পেরেছেন। সুরমা গার্মেন্টেস নামে একটি পোশাক কারখানার পরিচালক ফয়সাল সামাদ বলেন, “ক্রেতাদের বার বার চিঠি দেওয়া হলেও এখন পর্যন্ত বেশিরভাগ ক্রেতাই পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি করেননি। এক্ষেত্রে সম্মিলিতভাবে ক্রেতাদের সঙ্গে আরও দরকষাকষিতে যেতে হবে।”

 

শিল্প মালিকরা নিজেরাই কম দামে ক্রয়াদেশ নেওয়ার ‘প্রতিযোগিতা করছে’ বলে যে অভিযোগ আছে, সে প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “কারখানা মালিকরা এককভাবে এই সমস্যার সমাধান করতে পারবে না। বিজিএমইএ সমন্বিতভাবে ক্রেতাদের সঙ্গে বসে আলোচনা করে পণ্যের মূল্য নিশ্চিত করতে পারে।”

 

বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান এ বিষয়ে বলেন, “মজুরি বৃদ্ধির পর দুই একজন ক্রেতা পোশাক মূল্য সঠিকভাবে বাড়িয়েছেন। বাকিদের কেউ কেউ ৫০ শতাংশ থেকে ৬০ শতাংশ বাড়তি ব্যয়টি সমন্বয় করেছেন। আবার অনেকে আছেন আগামী ফেব্রুয়ারি কিংবা মার্চ থেকে দাম বাড়াবেন বলে আশ্বাস দিচ্ছেন। মূল কথা হচ্ছে মজুরি বৃদ্ধির পর অধিকাংশ ক্রেতাই এখনও পোশাকের দাম বাড়াননি।”

 

২০২২ সালে বিভিন্ন কারণে পোশাক রপ্তানিতে ভালো প্রবৃদ্ধি আসলেও ২০২৩ সালটি ছিল এই খাতের জন্য নানা রকম চ্যালেঞ্জর বছর। ২০২১ সালে যেখানে ৩৫ দশমিক ৮১ বিলিয়ন ডলারের পোশাক পণ্য রপ্তানি হয়েছিল ২০২২ সালে এসে সেটা প্রায় ১০ বিলিয়ন বেড়ে ৪৫ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়। অর্থাৎ প্রবৃদ্ধি ছিল ২৭ দশমিক ৬৪ শতাংশ।

 

ডিসেম্বরে পরিচালিত ওই জরিপে ২০২৩ সালে কারখানাগুলোর উৎপাদন সক্ষমতার ২৭ দশমিক ৫ শতাংশই অলস পড়ে থাকার তথ্য দিয়েছিলেন মালিকরা। ২০২৪ সালের প্রথম চার মাসেও ৩৮ শতাংশ সক্ষমতা ফাঁকা পড়ে থাকার আশঙ্কার কথাও উঠে আসে তাদের তথ্যে।

 

১০ শতাংশ কারখানা মালিক বলেছেন, গত বছর তাদের সক্ষমতার ১০ শতাংশই ফাঁকা ছিল। সক্ষমতার ২০ শতাংশ কাজে লাগাতে পারেননি ২২ শতাংশ কারখানা মালিক। ৩০ শতাংশ সক্ষমতা অলস পড়ে ছিল প্রায় ২৭ শতাংশ কারখানায়। ৪০ শতাংশ থেকে ৫০ শতাংশ উৎপাদন সক্ষমতা অলস পড়ে ছিল ৩২ শতাংশ কারখানায়। ২০২৩ সালে গ্যাস সংকট ও বিদ্যুতের লোডশেডিংয়েও ভুগতে হয়েছে কারখানা মালিকদের।কার্যাদেশ আছে ৬২ শতাংশ

 

চলতি ২০২৪ সালের প্রথম চার মাসের জন্য মোট সক্ষমতার গড়ে ৬২ দশমিক ২১ শতাংশ ক্রয়াদেশ পাওয়া গেছে বলে কারখানা মালিকরা জানিয়েছেন। এর অর্থ হচ্ছে এই সময়ের জন্য এখনও প্রায় ৩৮ শতাংশ ক্যাপাসিটি বা উৎপাদন সক্ষমতা ফাঁকা পড়ে আছে। জরিপে দেখা যায়, ৬৬টি কারখানার মধ্যে ১৩ শতাংশ কারখানা তাদের সক্ষমতার ৮০ শতাংশ ক্রয়াদেশ নিশ্চিত করতে পেরেছে। ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ ক্রয়াদেশ নিশ্চিত করতে পেরেছে প্রায় ৩৮ শতাংশ কারখানা। ৪৩ শতাংশ কারখানা তাদের উৎপাদন সক্ষমতার অর্ধেক ক্রয়াদেশ এখনও পায়নি।

 

ভোরের আকাশ/মি

মন্তব্য

Beta version