-->
শিরোনাম
কৃষিপণ্য

বিধিমালা কিতাবে আছে, নেই বাজার নিয়ন্ত্রণ

মুহাম্মাদ সাফানুর রহমান
বিধিমালা কিতাবে আছে, নেই বাজার নিয়ন্ত্রণ
ক্যাপশন : রাজধানীর কারওয়ান বাজারে খুচরা পর্যায়ে কেনাকাটা চলছে।

কৃষিপণ্যের বাজারদর নিয়ন্ত্রণে রাখতে অর্ধযুগ আগে সরকার যে ব্যবস্থাটি আইনের রূপ দিয়েছিল, এখন পর্যন্ত তার বাস্তবায়ন হয়নি। ব্যবস্থাপনা এমন হওয়ার কথা ছিল, যেখানে পণ্যের উৎপাদন খরচ কত, পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে মুনাফার সর্বোচ্চ হার কত, সেই তথ্য ক্রেতাদের জন্য প্রকাশিত থাকবে। ফলে তাদের দরকষাকষির ভিত্তি তৈরি হত।

 

কিন্তু সে পথে না গিয়ে ব্যবসায়ীদের ডেকে ‘নসিহত’, অনুরোধ বা ‘হুঁশিয়ারি’ দিয়ে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, তা যে কাজ করছে না, সেটাও স্পষ্ট। বাজারে পাইকারি ও খুচরা দরের মধ্যে দামের পার্থক্য বিস্তর। কিন্তু ক্রেতাদের ধারণা থাকে না পাইকারিতে আসলে দাম কত।

 

দাম বেড়ে যাওয়ার পর খুচরা বিক্রেতা সব সময় বলেন, পাইকারিতে দাম বেড়েছে। পাইকারিতে বলা হয়, তারা ন্যূনতম মুনাফায় পণ্য বিক্রি করে। কৃষক দাম পায় না এমন একটি ধারণাও সাধারণের মনে প্রতিষ্ঠিত।

 

অথচ ২০১৮ সালে কৃষিপণ্য বিপণন আইন ও তিন বছর পর করা বিধিমালায় স্পষ্ট করেই বলা আছে উৎপাদন খরচ বিবেচনায় পাইকারি ও খুচরায় সর্বোচ্চ মূল্য কত হতে পারবে, সে বিষয়ে সরকার তালিকা প্রকাশ করবে। সেটি প্রকাশ্য স্থানে থাকবে। তাতে ক্রেতাদেরও এসব বিষয়ে তথ্য থাকবে।

 

এই বিধিমালা অনুযায়ী উৎপাদন, পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে ইচ্ছামত মুনাফা ধরার সুযোগ নেই। পণ্যভেদে মুনাফার সর্বোচ্চ হার বেঁধে দেওয়া হয়েছে। তবে যৌক্তিক মুনাফা কত হবে, সেটি ঠিক করে দেওয়ার কথা প্রশাসনের। প্রতিটি পর্যায়ে এই সর্বোচ্চ দরকে ‘যৌক্তিক মূল্য’ বলা হয়েছে আইন ও বিধিমালায়। কিন্তু এর কোনোটাই করা হয়নি। এ কাজ যেমন জেলা পর্যায়ে করার কথা, তেমনি উপজেলা পর্যায়েও করার কথা। বাজারভিত্তিক থাকার কথা আলাদা কমিটি।

 

কিন্তু সে পথে না হেঁটে ব্যবসায়ীদের ডেকে মত বিনিময় বা সতর্ক করা, কেন্দ্রীয়ভাবে মন্ত্রণালয় থেকে দাম বেঁধে দিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত দিয়ে অভিযান এবং পণ্যের আমদানির অনুমতি দিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছে সরকার।

 

জেলা পর্যায়ে নামকাওয়াস্তে কমিটি থাকলেও যাদের সদস্য থাকার কথা, তাদের অনেকেই সেই কমিটি বা বৈঠকের কথা জানেন না। উপজেলা পর্যায়ে কমিটির কার্যক্রমই নেই।

 

আইন অনুযায়ী প্রতিটি বাজারে পাইকারি ও খুচরা সর্বোচ্চ মূল্য এভাবে তালিকা করে টানিয়ে দেওয়ার কথা। কিন্তু পাইকারি মূল্য কোথাও দেওয়া থাকে না। এ তালিকাও পাওয়া যায় না সব জায়গায় ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ বা ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, “যদি পাইকারি বাজারের দর ক্রেতার জানার সুযোগ থাকত, তাহলে খুব ভালো হত। সরকারের কর্তাব্যক্তিদের জিজ্ঞেস করুন, আইন বানিয়েছেন, কেন কার্যকর হচ্ছে না?” তবে মুক্তবাজার অর্থনীতিতে এভাবে ধরেবেঁধে কিছু কাজ করবে কি না, তা নিয়েও সন্দিহান তিনি।

 

গোলাম রহমান বলেন, “বাজার ঠিক করতে হবে মুদ্রানীতি, ট্রেড পলিসিসহ নানা নীতির মাধ্যমে। মুক্ত বাজারকে জোর করে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না।” বিভিন্ন জেলার কৃষি বিপণন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বেশ কিছু পণ্যের উৎপাদন খরচের হিসাব জানতে চেয়েছে। সেগুলো পাঠানোও হয়েছে। অধিদপ্তর বা মন্ত্রণালয় এখন যে সিদ্ধান্ত নেবে, সেগুলো বাস্তবায়নে উদ্যোগ দেওয়া হবে। কৃষি সচিব ওয়াহিদা আক্তার নিজেও বলেছেন, কৃষি বিপণন অধিদপ্তরটা তাদের একটি দুর্বলতা। এটি সঠিকভাবে কাজ করছে না।

 

অসহায় ক্রেতা রাজধানীর নিউ ইস্কাটনের বাসিন্দা টিটু মাহতাব কারওয়ানবাজার থেকে ৬০ টাকা কেজি দরে যে বেগুন কিনে এসেছেন, সেই বেগুন পরদিন তিনি এলাকার বাজারে দেখলেন ১০০ টাকা। কারওয়ানবাজারে ১ ফেব্রুয়ারি রাতে আলুর দর পাইকারিতে ছিল সর্বোচ্চ ২৬ টাকা, অথচ একই দিন মোহাম্মদপুর ও ইস্কাটনে খুচরায় তা বিক্রি হয়েছে ৪৫ টাকা করে। সবজিতে পাইকারি ও খুচরা দরে ১০০ শতাংশ, কখনো তার চেয়ে বেশি পার্থক্য ঢাকার এক নিয়মিত চিত্র।

 

কারওয়ানবাজারে খুচরায় ৮০ টাকা কেজির মটরশুঁটি সুপারশপেও ১৮০ টাকা, ১৫০ টাকার শিমের বিচি ২৫০ টাকা- এমন পার্থক্যও নিত্যদিনের। খুচরা পর্যায়ে বিক্রেতারা বাজারে থাকেন একজোট, তারা একটি নির্ধারিত দামের নিচে পণ্য বিক্রি করেন না, নষ্ট হলে ফেলে দেন, তাও কম দামে ছাড়েন না। এই মূল্য যৌক্তিক কি না, সেটি কখনো ক্রেতা জানে না, তার আসলে প্রশ্ন রাখার সুযোগও নেই। মোহাম্মদপুর টাউনহল বাজারে চাল কিনতে আসা মনির হোসেন বলেন, “পাইকারিতে কত দাম, তা জানি না। খুচরাতে যে দাম চায় অনুমান করে তার থেকে একটু কম বলি আর কিনি। তবে বেশিরভাগ সময় ঠকি।”

 

মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটে নারকেল ও মিঠাই কিনতে আসা নাসিমা আক্তার বলেন, “খুচরা দোকানিরা পাইকারি থেকে কত দিয়ে কিনে আমরা জানি না। অনেক সময় সন্দেহ হয় বেশি লাভ করছে। কিন্তু আমাদের তো কিছুই করার নেই।”

 

আরেকজন ক্রেতা মোহাম্মদ আলী বলেন, “মূল্য তালিকা থাকলে ভালো হত। তারা যেন বেশি দামে বিক্রি করতে পারে তাই মনে হয় তালিকা লাগায় না।” একই বাজারের পাইকারি দোকানি ইসলাম ট্রেডার্সের বিক্রেতা মেহেদি হাসান বলেন, “যেহেতু মূল্য তালিকা নাই, তাই খুচরা বিক্রেতারা যেমন খুশি তেমন লাভ করে। আমরা যদি কোনো বস্তা বিক্রি করি ১৫০০ টাকা। খুচরা বিক্রেতারা সেই বস্তা ১৮০০ থেকে ১৯০০ টাকায় বিক্রি করবে।

 

“আমাদের এখানে রশিদ মিনিকেট বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ৬৪ টাকা করে, কিন্তু খুচরায় হয়ত বিক্রি করছে ৭০ থেকে ৭৪ টাকায়। ভোক্তা অধিদপ্তর খালি আমাদেরকে ধরে। কিন্তু আসল কারসাজি হয় খুচরাতে। তারা কত লাভ করতে পারবে তা নিয়ে কোনো সীমাবদ্ধতা নাই।”

 

২০১৮ সালে কৃষিপণ্য বিপণন আইন এবং এর আলোকে তিন বছর পর কৃষিপণ্য বিপণন বিধিমালা করা হয়। এই বিধিমালায় চাল, ডাল, শাক সবজি, মাছ ডিম, দুধ এবং প্রক্রিয়াজাত খাবারের জন্য আলাদা আলাদা সর্বোচ্চ মুনাফার হার ঠিক করে দেওয়া আছে।

 

এই ‘যৌক্তিক মূল্য’ বাস্তবায়নে জেলা পর্যায়ে কৃষি বিপণন সমন্বয় কমিটিও গঠন করা হয়েছে। এই কমিটির সদস্য হিসেবে আছেন জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক, জেলা প্রাণিসম্পদ ও মৎস্য কর্মকর্তা, জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক, সিনিয়র বা কৃষি বিপণন কর্মকর্তাসহ ১৬ জন।

 

আরো থাকবেন জেলা প্রশাসন মনোনীত তিনজন কৃষিপণ্য ব্যবসায়ী (একজন হতে হবে নারী), জেলা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি, জেলা প্রশাসন অনুমোদিত একজন গুদাম মালিক, একজন হিমাগার মালিক, একজন সুপারশপ মালিক (যদি থাকে)। উপজেলা পর্যায়েও থাকার কথা এমন কমিটি। সরকার মুনাফার সর্বোচ্চ যে হার ঠিক করে দিয়েছে, সেটি মাত্রাতিরিক্ত কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। তবে এই সর্বোচ্চ হার নির্ধারণ কিন্তু কোনো পর্যায়েই ব্যবসায়ীর হাতে থাকার কথা না, সর্বোচ্চ হার ঠিক করে দেওয়ার কথা এসব কমিটির।

 

বিধিমালা অনুযায়ী উৎপাদন পর্যায়ে ফসল ও পণ্যভেদে সর্বোচ্চ ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ, পাইকারি পর্যায়ে ১৫ থেকে সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ, এবং খুচরা পর্যায়ে ২৫ থেকে সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ যৌক্তিক মুনাফা করার কথাও বলা আছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে উৎপাদন খরচের প্রায় দ্বিগুণ, কখনও আড়াই গুণ বেশি দামে পণ্য বিক্রির সুযোগ করে দিয়েছে সরকার। কিন্তু বাজারে উৎপাদন খরচের ১০ গুণ দামেও পণ্য বিক্রির কথা উঠে এসেছে সরকারি হিসেবেই।

 

নিত্যপণ্যের দাম নিয়ে ব্যাপক আলোচনার মধ্যে প্রায়ই বিভিন্ন পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে অস্বাভাবিক হারে। অভিযোগ ওঠে, ব্যবসায়ীরা একজোট হয়ে ইচ্ছা করে সংকট তৈরি করে দাম বাড়াচ্ছেন। এ নিয়ে আলোচনা থাকলেও কখনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।

 

এই সময়ে একেকবার একেকটি পণ্য নিয়ে হুলুস্থূল হয়েছে। কখনো ব্রয়লার মুরগি, কখনো ডিম, কখনো পেঁয়াজ, কখনো আলু, কখনো সবজি, কখনো চালের দামের হঠাৎ লাফ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে।জেলার কৃষি বিপণন সমন্বয় কমিটির কাজ ছয়টি১. কৃষিপণ্য ও কৃষি উপকরণ পরিবহনের সময় প্রতিবন্ধকতা বা চাঁদা বা অর্থ আদায় রোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে অবাধ সরবরাহ চেইন নিশ্চিত করা,২. কৃষিপণ্য ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখা এবং বাজার মূল্য স্থিতিশীল রাখার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ,৩. কৃষি বিপণন অধিদপ্তর নির্ধারিত যৌক্তিক মূল্য বাস্তবায়নের পদক্ষেপ গ্রহণ৪. কৃষিপণ্য ও কৃষি উপকরণের স্থানীয় চাহিদা, উৎপাদন ও যোগান, মজুদ, বাজার দর, সংরক্ষণ, পরিমাপ, প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং সরবরাহ পরিস্থিতি সম্পর্কে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে পরামর্শ প্রদান’৫. পাইকারি ও খুচরা বাজারে কৃষিপণ্য ও কৃষি উপকরণের ক্রয় ও বিক্রয় মূল্যের তালিকা সাধারণের দৃষ্টিগোচর স্থানে প্রদর্শন হচ্ছে কি না, সেটি তত্ত্বাবধান করা; এবং৬. আইনের আওতায় দ্রব্যমূল্য যৌক্তিক পর্যায়ে রাখতে এবং ভোজাল ও ক্ষতিকর রাসায়নিক মুক্ত পণ্য সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য মোবাইল কোর্ট পরিচালনায় সহায়তা করা।উপজেলা পর্যায়ের কমিটির কাজ চারটি। জেলা পর্যায়ের কমিটির ২ ও ৫ নম্বর দায়িত্বটি তাদের দেওয়া হয়নি।

 

আইন অনুযায়ী কৃষক, পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে ‘ন্যায্যমূল্য’ নির্ধারণ করতে জেলা, উপজেলার পাশাপাশি বাজার পর্যায়েও কমিটি থাকার কথা। কিন্তু জেলা কমিটি থাকলেও তার কার্যক্রম সীমিত। বাকি দুই কমিটি নেই বললেই চলে বাজারভিত্তিক আলাদা কৃষি বিপণন কমিটি গঠনের কথা বলা আছে বিধিমালায়। এই কমিটির সভাপতি হওয়ার কথা সিটি করপোরেশন বা পৌরসভার ওয়ার্ড কাউন্সিল বা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের। সদস্য সচিব হওয়ার কথা উপজেলা কৃষি বিপণন কর্মকর্তার।

 

সদস্যরা হবেন উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা, সভাপতি মনোনীত গণ্যমান্য ব্যক্তি ও তিনজন কৃষিপণ্য ব্যবসায়ী, একজন কৃষিপণ্য উৎপাদন, বাজার পরিচালনা কমিটির সভাপতি বা সেক্রেটারি।২০টি পণ্যের বিষয়ে খোঁজ নিচ্ছে সরকার

 

দেশের প্রতিটি বিভাগে একটি করে জেলায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কোথাও কোনো পর্যায়ে কৃষিপণ্যের ‘যৌক্তিক মূল্য’ বা মুনাফার হার ঠিক করে দেওয়া হয়নি।নিত্যপণ্যের দাম কমাতে নতুন সরকারের দৃশ্যমান নানা চেষ্টার মধ্যে বিভিন্ন জেলা থেকে তথ্য মিলেছে, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের নির্দেশের পর ২০টি পণ্যের উৎপাদন খরচের হিসাব পাঠানো হয়েছে ঢাকায়।

 

বরিশালের সিনিয়র কৃষি বিপণন কর্মকর্তার কার্যালয়ের মাঠ পরিদর্শক মো. রাসেল খান জানান, “প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ৬৪ জেলা থেকে পণ্যের উৎপাদন খরচ চেয়েছে। তাই বরিশাল জেলার পণ্যের উৎপাদন খরচ পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।”

 

রংপুরের সিনিয়র কৃষি বিপণন কর্মকর্তা রবিউল হাসান বলেছেন, “আমরা কস্ট অব প্রডাকশন ঠিক করেছি। ২০টা পণ্যের সর্বোচ্চ পাইকারি ও খুচরা দর ঠিক করে দেওয়া হবে। এ ক্ষেত্রে সদরদপ্তর কাজ করছে। আপনি একটু তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।” উপজেলা পর্যায়ের কৃষি বিপণন সমন্বয় কমিটি আছে কি না, এই প্রশ্নে তিনি বলেন, “উপজেলায় আমাদের এই সেটআপ নেই।” নেত্রকোণা কৃষি বিপণন কর্মকর্তা দেওয়ান আহাদুজ্জামান খান দাবি বলেন, “যৌক্তিক মূল্য বাস্তবায়নের গত সপ্তাহে ডিম, মুরগি, শসাসহ কয়েকটি পণ্যের কৃষক পর্যায়ে উৎপাদন খরচ, পাইকারি, খুচরা বিক্রিসহ ভোক্তা পর্যায়ে কত বিক্রি হচ্ছে, সেটি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানিয়েছি।”

 

তবে সমন্বয় কমিটির সদস্য জেলা মৎস্য কর্মকর্তা শাহজাহান কবীর বলেন, “আমি নেত্রকোণায় জেলায় আছি আড়াই বছর ধরে। এ ধরনের কমিটির কোনো সভাতেই আমি ছিলাম না। আমাকে জানানোই হয়নি।” জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা অহিদুল আলম বলেন, “এই কমিটির কথা আপনার কাছ থেকে প্রথম শুনলাম।” জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মোয়েতাছিমুর রহমান বলেন, আমি ৬ মাস হয় আসছি নেত্রকোণায়। আমি কোনো দিন এই কমিটির সভার খোঁজ পাইনি।”

 

কুমিল্লার কৃষি বিপণন সমন্বয় কমিটির সদস্য সচিব ও জেলার সিনিয়র কৃষি বিপণন কর্মকর্তা মোহাম্মদ জাকারিয়া বলেন, “মূল্য নির্ধারণের জন্য উচ্চ পর্যায়ের মিটিং আছে। আমরা ইতোমধ্যে তথ্য পাঠিয়ে দিয়েছি। মূল্য নির্ধারণ আমরা করব না, বাস্তবায়ন করব। মূল্য নির্ধারণ করার ক্ষমতা মন্ত্রণালয় ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ডিজি সাহেবের। তারা সেটা করবেন।” ফরিদপুরের ডিসি কামাল আহসান তালুকদার বলেন, “কোনো পণ্যের যৌক্তিক মূল্য জেলা থেকে নির্ধারণ হয় না, কেন্দ্র থেকেই পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে দেয়, সেটা আমরা বাস্তবায়ন করি।”

 

বগুড়ায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক মাতলুবার রহমান বলেন, “গত মাসে ব্যবসায়ীদের নিয়ে সভায় ছিলাম। তখন ডিম ও আলুর দাম নিয়ে আলোচনা হয়। তবে এই কমিটি কোনো পণ্যের যৌক্তিক দর ঠিক করে না। বরং তারা তথ্য পাঠায় মন্ত্রণালয়ে।” কমিটির সদস্য সচিব কৃষি বিপণন কর্মকর্তা মমতা বেগম বলেন, “মাঠ পর্যায়ের তথ্য নিয়ে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। আমরা দেখি কৃষকের উৎপাদন খরচ কত। সেই খরচের উপর কত দামে বিক্রি করতে পারেন। “সেই মূল্য মন্ত্রণালয় পাঠালে মন্ত্রণালয় থেকে মূল্য নির্ধারণ করে আবার মাঠ পর্যায়ে পাঠায়। বাজারে যখন সেই নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি দাম নেওয়া হয়, তখন ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অভিযান চালাই।”

 

রাজশাহী কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক আফরিন হোসেন শুরুতে বলেন, “কৃষি বিপণন সমন্বয় কমিটি আছে কিনা আমার জানা নেই। আমি এখানে ছয় মাস হল যোগদান করেছি। এ সময়ের মধ্যে এ কমিটির কোনো বৈঠক হয়নি।” কারওয়ানবাজারে পেঁয়াজের আড়ত। আইন অনুযায়ী যে কোনো পাইকারি বাজারে মুনাফার সর্বোচ্চ হার নির্দিষ্ট করে তার তালিকা থাকার কথা । তবে পরে তিনি নিজেই ফোন করে জানান ১৬ সদস্যের একটি কমিটি আছে। সর্বশেষ গত বছরের জুনে এ কমিটির সভা হয়েছে।

 

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের জেলা শাখার উপ-পরিচালক মোজদার হোসেন বলেন, “রাজশাহীতে কৃষি বিপণন সমন্বয় কমিটি আছে কি না আমার জানা নেই।” যশোরের কৃষি বিপণন কর্মকর্তা রবিউল ইসলাম বলেন, “যশোরে এ কমিটি রয়েছে। সবশেষ সভা হয়েছে গত বছরের ২১ সেপ্টেম্বর। রমজান সামনে রেখে ফেব্রুয়ারি মাসের শেষের দিকে সভা হবে। সিলেটের সিনিয়র কৃষি বিপণন কর্মকর্তা আবু সালেহ মো. হুমায়ুন কবির বলেন, “কয়েক দিন আগে সিলেটে উৎপাদিত আমন ধান, শিম, কাচাঁমরিচ, ব্রয়লার ও সেনালি মুরগির তথ্য পাঠানো হয়েছে। অধিদপ্তর ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় দাম নির্ধারণ করে দিলে আমরা জেলা সমন্বয় কমিটি ব্যবসায়ীদের জানিয়ে দেব।”

 

কৃষি বিপণন আমাদের দুর্বলতা: কৃষি সচিব কৃষিপণ্যের মূল্য নির্ধারণের যে পদ্ধতির কথা আইন ও বিধিতে বলা আছে, সেভাবে উদ্যোগ না নেওয়ার বিষয়ে কৃষি সচিব ওয়াহিদা আক্তার বলেন, “আপনি ঠিকই বলেছেন। কৃষি বিপণন অধিদপ্তরকে আমরা অনেকবার তাদের বলেছি। কিন্তু তারা সেভাবে কাজ করে না। কৃষি সচিব ওয়াহিদা আক্তার বলেছেন কৃষি বিপণন অধিদপ্তর তাদের মন্ত্রণালয়ের দুর্বল একটি জায়গা। এই দুর্বলতা কাটাতে তারা কাজ করছেন “আমরা সব সময় বলেছি তারা যেন বৈজ্ঞানিকভাবে উৎপাদনের খরচ নির্ধারণ করে। পরিবহন ও আনুষঙ্গিক খরচ হিসাব করে একটি পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে দাম নির্ধারণ করে। কিন্তু কৃষি মন্ত্রণালয়ের এই একটাই জায়গা যেটা ঠিক সেভাবে কাজ করছে না।”

 

জেলা পর্যায়ে বিপণন সমন্বয় কমিটি থাকলেও উপজেলা পর্যায়ে এর কার্যক্রম একেবারেই না থাকার বিষয়টিও জানেন সচিব। এর পেছনে জনবল সংকটকেও একটি কারণ হিসেবে দেখিয়েছেন তিনি।ওয়াহিদা বলেন, “যে পরিমাণ জনবল অনুমোদন আছে, তার অর্ধেকেরও কম কর্মী দিয়ে কাজ করতে হচ্ছে। এটা আমাদের একটা দুর্বল জায়গা, কিন্তু যতটা সক্ষমতা আছে, ততটা কাজও করতে পারছি না।”

 

আগামী দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে পরিস্থিতি পাল্টে যাবে বলেও আশা করছেন কৃষি সচিব। বলেন, “বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ৭৬০ কোটি টাকায় একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন হবে। এতে অধিদপ্তরের সক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি অ্যাসেম্বিং সেন্টার করা হবে। কৃষকের পণ্য বিক্রি ও বিপণন কেন্দ্র করা হবে যাতে তারা সরাসরি বিক্রি করতে পারে। এ রকম আরো অনেক কাজই করা হবে।

 

ভোরের আকাশ/মি

মন্তব্য

Beta version