-->
শিরোনাম

মার্জার করলেও খেলাপী ঋণ ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা সম্ভব না

বাংলাদেশ ব্যাংকের সেই সক্ষমতা নেই

হেলাল সাজওয়াল
মার্জার করলেও খেলাপী ঋণ ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা সম্ভব না

একীভূত করার কোনো সিদ্ধান্তই স্বেচ্ছায় নেওয়া হয়নি, বরং নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাধ্য করেছে। বিষয়টি স্পষ্ট হয় বেসিক ব্যাংক এবং ন্যাশনাল ব্যাংকের একিভুত হতে না চাওয়ার কথা প্রকাশ হওয়ার পর। এদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন মার্জার করলেও খেলাপী ঋণ ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা সম্ভব না । সংশ্লিষ্টদের অভিমত বাংলাদেশে খেলাপী ঋনের এ অবস্থা হুট করে তৈরী হয়নি ১৯৭১ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত একিউমুলেট হতে হতে বর্তমান অবস্থায় পৌছেছে। হুট করে যেমন এত টাকা খেলাপী হয়নি তদরুপ হুট করে এ অবস্থার পরিবর্তন সম্ভব নয়। ব্যাংক খাতের একত্রীকরন নিয়ে আলোচনা গত বছরের শেষ দিকে শুরু হলেও, ৩১ জানুয়ারি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সঙ্গে এক বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংক এর গভর্নর দুর্বল ব্যাংকগুলোকে একীভূত করার পরামর্শ দেয়।

 

একিভুত হওয়ার আলোচনা শুরু হতেই গত ১৪ মার্চ এক্সিম ব্যাংক ও পদ্মা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ একে অপরের সঙ্গে একীভূত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় এবং এক চুক্তির মাধ্যমে পদ্মা এক্সিমে বীলিন হয়। গত ৪ মার্চ ব্যাংক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) একটি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠকে গভর্নর জানান, চলতি বছরের মধ্যে ৭ থেকে ১০টি দুর্বল ব্যাংককে সবল বা ভালো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করা হতে পারে। এ সময়ের মধ্যে দুর্বল ব্যাংকগুলো নিজেদের ইচ্ছায় একীভূত না হলে আগামী বছর থেকে তাদের চাপ দিয়ে একীভূত করা হবে। এমন আলোচনার মধ্যে গত ৩ এপ্রিল সরকারি খাতের রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংককে (রাকাব) বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের সঙ্গে এবং বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংককে (বিডিবিএল) সোনালী ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার সিদ্ধান্ত হয়। এরপর ৮ এপ্রিল সিটি ব্যাংকের সঙ্গে সমস্যাগ্রস্ত বেসিক ব্যাংককে এবং ৯ এপ্রিল বেসরকারি ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক বা ইউসিবির সঙ্গে ন্যাশনাল ব্যাংককে একীভূত করার সিদ্ধান্ত হয়। একীভূত করার কোনো সিদ্ধান্তই স্বেচ্ছায় নেওয়া হয়নি, বরং নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাধ্য করেছে। বিষয়টি স্পষ্ট হয় বেসিক ব্যাংক এবং ন্যাশনাল ব্যাংকের একিভুত হতে না চাওয়ার কথা প্রকাশ হওয়ার পর। এ দুটি ব্যাংক সাফ জানিয়ে দিয়েছে তারা কারো সাথে একিভুত হবে না আপাতত। গত ৬ মে ন্যাশনাল ব্যাংকের নব নিযুক্ত চেয়ারম্যান খলিলুর রহমান সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘আমরা ব্যাংক একীভূত করতে রাজি নই। বাংলাদেশ ব্যাংককেও এ কথা জানিয়েছি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাতে রাজি হয়েছে। তবে শর্ত দিয়েছে যে এক বছরের মধ্যে ব্যাংককে দুর্বল অবস্থা থেকে ভালো করতে হবে।’

 

৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ প্যাকেজের অন্যতম শর্ত হিসেবে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে একটি রোডম্যাপ প্রণয়ন করতে বলে আইএমএফ। তারপরেই ব্যাংক একীভূতকরণের বিষয়টি সামনে আসে। একীভূতকরণের মাধ্যমে ব্যাংকের সংখ্যা ৬১ থেকে কমিয়ে ৪৫-এ নামিয়ে আনার লক্ষে মাঠে নামে ব্যাংক খাতের নিয়ন্ত্রক বাংলাদেশ ব্যাংক। এক্ষেত্রে সরকারি, বেসরকারি ও বিদেশী খাতের দুর্বল ব্যাংককে সবল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার উদ্যোগ নেয় কেন্দীয় ব্যাংক। গত ৭ এপ্রিল একত্রীকরণ নীতি ঘোষণার পরপরই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুসারে একীভূত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় পাঁচটি ব্যাংক। এরমধ্যে সোনালী ব্যাংক একীভূত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেডের সঙ্গে; বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের সঙ্গে; সিটি ব্যাংক বেসিক ব্যাংকের সঙ্গে; ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক ন্যাশনাল ব্যাংকের সঙ্গে এবং এক্সিম ব্যাংক পদ্মা ব্যাংকের সাথে একীভূত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু, মার্জারের বিষয়টি গণমাধ্যমে প্রকাশের পরেই আমানতকারীদের মধ্যে যে ভীতি তৈরি হয় তাতে আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়।

 

এর আগে কোন ব্যাংকের সাথে তারা একীভূত হতে চায় এটা বেছে নিতে কিছু ভালো ব্যাংকের কাছে ১০টি ব্যাংকের তালিকা দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। জানুয়ারির মধ্যে তারা স্বেচ্ছায় একীভূত না হতে পারলে– বাধ্যতামূলক একীভূতকরণে যাবে বাংলাদেশ ব্যাংক। এসব ব্যাংকগুলো হলো বেসিক ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব), এবি ব্যাংক, পদ্মা ব্যাংক, জনতা ব্যাংক এবং ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান।

 

একীভূতকরণের জন্য শর্টলিস্ট করা ব্যাংকগুলো যদি স্বেচ্ছায় একীভূত হতে ব্যর্থ হয় তাহলে তাদের "বাধ্যতামূলক একত্রীকরণ" এর বিকল্প রাখা হয়। ‘ব্যাংক একত্রীকরণের জন্য অনুসরণীয় নীতিমালা’ শীর্ষক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১-এর ধারা ৪৯(১)(গ), ৭৭(১৬) এবং কোম্পানি আইন, ১৯৯৪-এর ধারা ২২৮ ও ২২৯-এর বিধান অনুসরণে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদনক্রমে এবং মধ্যস্থতায় কোনো ব্যাংক স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে অন্য কোনো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হতে পারবে। ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১-এর ৭৭ ক ধারায় ব্যাংকের পুনরুদ্ধার বিষয়ে দ্রুত সংশোধনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণে বাংলাদেশ ব্যাংককে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। ওই ক্ষমতার বলে গত বছরের ৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংক ‘প্রম্পট কারেকটিভ অ্যাকশন (পিসিএ) ফ্রেমওয়ার্ক’ জারি করেছে। এ ফ্রেমওয়ার্ক অনুযায়ী, কোনো ব্যাংক মূলধন ও তারল্য ঘাটতি, উচ্চ মাত্রার খেলাপি ঋণ, সুশাসনের ঘাটতি এবং আমানতকারীদের জন্য ক্ষতিকর কার্যকলাপের কারণে পিসিএ ফ্রেমওয়ার্কের আওতাভুক্ত হলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক আরোপিত বা নির্দেশিত বিধিনিষেধ অনুসরণ করতে হবে।

 

পুনরুদ্ধার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ব্যর্থ হলে আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষার্থে বা জনস্বার্থে ব্যাংকের যথাযথ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার স্বার্থে ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১-এর ধারা ৭৭-এর বিধান সাপেক্ষে, ওই ব্যাংককে অন্য কোনো ব্যাংকের সঙ্গে বাধ্যতামূলক একত্রীকরণ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক বা একাধিক বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণের আইনি বিধান পরিপালনের আবশ্যকতা রয়েছে। অন্যদিকে ব্যাংকের স্বতঃপ্রণোদিত একত্রীকরণ সম্পর্কিত নীতিমালা সম্পর্কে এতে বলা হয়, আইনে উল্লিখিত বিধান অনুযায়ী কোনো ব্যাংক স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে অন্য কোনো ব্যাংক বা ফাইন্যান্স কোম্পানির সঙ্গে একত্রীকরণের মাধ্যমে আর্থিকভাবে অধিকতর সবল ব্যাংক গঠনের সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এ কার্যক্রমের মূল লক্ষ্য হলো অপেক্ষাকৃত দুর্বল ব্যাংকের বিদ্যমান সমস্যা সমাধান এবং একইসঙ্গে অপেক্ষাকৃত সবল ব্যাংকের কার্যক্রম উন্নয়নের মাধ্যমে আর্থিক খাতকে শক্তিশালী করা, যাতে জনস্বার্থে একীভূত ব্যাংক অধিকতর সেবা প্রদান করতে পারে।

 

সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের অনুরোধক্রমে এবং ধারা ৭৫-এর বিধান সাপেক্ষে বাংলাদেশ ব্যাংক একত্রীকরণের প্রস্তাবের মধ্যস্থতাকারী হিসেবে বা অন্য কোনোভাবে সহায়তা দিতে পারবে। কোম্পানি আইনের ধারা ২৮৬-তে ভিন্ন কিছু বলা থাকলেও পাওনাদারদের ঋণ সম্পূর্ণরূপে পরিশোধ করতে সামর্থ্য নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের লিখিত প্রত্যয়ন ছাড়া ধারা ৩১-এর অধীনে লাইসেন্সপ্রাপ্ত কোনো ব্যাংক স্বেচ্ছা অবসায়নে যেতে পারবে না। স্বেচ্ছা অবসায়নের কার্যধারার কোনো পর্যায়ে দেনা পরিশোধে ব্যর্থ ব্যাংকের ক্ষেত্রে কোম্পানি আইনের ধারা ৩১৪ এবং ৩১৫-এর বিধান ক্ষুণ্ন না করে বাংলাদেশ ব্যাংক হাইকোর্ট বিভাগের মাধ্যমে ওই ব্যাংকের অবসায়নের জন্য আবেদন করবে।

 

একীভূত হলে ১০টি দুর্বল ব্যাংক তাদের অন্তত ৮৪ হাজার কোটি টাকার দায়, ৫৪ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ ও ৩০ হাজার কোটি টাকার মূলধন ঘাটতি ভালো ব্যাংকগুলোর কাছে পার করে দিতে পারবে। তবে এই একীভূত হওয়ার প্রক্রিয়ায় ব্যাংকখাতের খেলাপি ঋণ বর্তমানের ৯ শতাংশ থেকে কমে ৫ শতাংশে নামবে। এবং ২০২৬ সাল নাগাদ দুর্বল ব্যাংকের স্থিতিপত্রের উন্নয়নে আইএমএফ ঋণ প্যাকেজের অংশ হিসেবে যে শর্ত দিয়েছে, তা পূরণের সহায়ক হবে।

 

এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ডিপার্টমেন্ট অফ ব্যাংকিং এন্ড ইন্সুরেন্স এর চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. মাঈন উদ্দিন ভোরের আকাশকে বলেন,‘ বাংলাদেশ ব্যাংক আইএমএফএর কাছে খেলাপী ঋনের যে হার দেখিয়েছে সেটি গোজামিলের হিসাব প্রকৃত হিসাবে এ হার ২০ শতাংশের উপরে চলে যাবে। সে হিসেবে মার্জার করলেও আইএমএফের শর্তানুযায়ি ২০২৬ সালের মধ্যে খেলাপী ঋণ ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা সম্ভব নয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের সেই সক্ষমতা নেই।’

 

একীভূতকরণের উদ্যোগটি পুঁজিবাজারেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে । দুর্বল ব্যাংকের সাথে একীভূত হওয়ার ঘোষণা দেওয়ার পরে সিটি ব্যাংক ও এক্সিম ব্যাংকের শেয়ারের দরপতন ঘটে।

 

এটা এখন প্রকাশ্য যে এসব ব্যাংকের সুশাসনে মারাত্মক ঘাটতি ছিল। সেই ঘাটতি এমনই চরম যে তাদের ঋণ বিতরণ কর্মকাণ্ড ছিল লুণ্ঠনেরই নামান্তর। এ রকম আস্থাবিধ্বংসী অপকর্মের জন্য দায়ী মূল ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ক্ষেত্রবিশেষে কিছু ব্যাংক কর্মকর্তাকে বলির পাঁঠা বানানো হয়েছে বটে, কিন্তু মূল হোতাদের কাছে কোনো কঠোর বার্তা পৌঁছায়নি। ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তাদের কেউ কেউ ভুলে যান যে সাধারণ মানুষের আমানতের ওপর নির্ভর করে পরিচালিত হয় তাদের ব্যবসা। সে কারণে অন্য যে কোনো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের তুলনায় ব্যাংক একাধিক নিয়ন্ত্রক সংস্থার নজরদারিতে থাকে। কিন্তু এতদসত্ত্বেও আমানতকারীদের গচ্ছিত অর্থ লুণ্ঠনের মতো অপকর্ম ঘটে গেছে একের পর এক।

 

আমানতকারীদের গচ্ছিত অর্থ লুণ্ঠনের মতো অপকর্ম রোধ করতে করনীয় সম্পর্কে ড. মাঈন উদ্দিন ভোরের আকাশকে বলেন, ব্যাংকিং খাতে সুশাষন প্রতিষ্ঠা করা না গেলে এ খাতে উন্নয়ন সম্ভব নয়। প্রকৃত পক্ষে যারা ব্যাংকিং বুঝবেন তাদেরকে পরিচালনা পর্ষদে নিয়ে এসে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিলে হয়তো এক্ষেত্রে সুফল পাওয়া যাবে।

 

ভোরের আকাশ/মি

মন্তব্য

Beta version