-->
শিরোনাম

চাপেও ছাড়ছেন না কোটাবিরোধীরা

সিরাজুল ইসলাম
চাপেও ছাড়ছেন না
কোটাবিরোধীরা

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে পুলিশের গাড়ি ভাঙচুর ও মারধরের মামলা করেছে পুলিশ। রাজধানীর শাহবাগ থানায় গতকাল শুক্রবার পুলিশের গাড়ি চালক খলিলুর রহমান বাদী হয়ে এই মামলা করেন। তবে কারো নাম উল্লেখ করা হয়নি। অজ্ঞাতনামা শিক্ষার্থীদের আসামি করা হয়। মামলার পর আন্দোলন আরও বেগবান করার ইঙ্গিত দিয়েছেন আন্দোলনের তিনজন সম্বনয়ক। এই আন্দোলনকে সংবিধানবিরোধী বলছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল শিক্ষার্থীদের আন্দোলন বন্ধ করা উচিত বলে মনে করেন। তিনি তাদের আদালতে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে বলেছেন, জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করবেন না। এই আন্দোলনে অনুপ্রবেশকারী ঢুকে পড়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখার তাগিদ অনুভব করছেন ঢাকা মহানগর ডিবি পুলিশের প্রধান হারুন-অর-রশিদ। অন্যদিকে, এই আন্দোলনের আড়ালে ‘সরকার অন্য কিছু’ করে ফেলে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার কোটা সংস্কার করা প্রয়োজন বলে মনে করেন। অন্যদিকে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের কথা বলা হয়েছিল একটি গবেষণায়। সেখানে বলা হয়, মেধার চেয়ে কোটা বেশি হতে পারে না। এদিকে বারবার ছাত্রলীগ নেতারা আন্দোলনকারীদের ঘরে ফেরার আহ্বান জানিয়েছেন। তারাও মাঠে নেমেছে। মিছিল করেছে। তবে সংঘাতে জড়ায়নি। সব মিলিয়ে আন্দোলনের উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ছে সারাদেশে।

আন্দোলনে উপস্থিতি বাড়ছে : সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে চলমান আন্দোলন ২০১৮ সালের মতোই ধীরে ধীরে বড় আকার ধারণ করছে। দিন দিন উপস্থিতি বাড়ছে কর্মসূচিতে। সরকারের পক্ষ থেকে আন্দোলন বন্ধ করতে বারবার বলা হলেও তা গায়ে মাখছেন না শিক্ষার্থীরা। বরং সংসদে বিশেষ অধিবেশন ডেকে দাবি মেনে নিতে পাল্টা চাপ প্রয়োগ করতে চান আন্দোলনকারীরা। এজন্য আন্দোলন আরও জোরালো করার ইঙ্গিত দিয়েছেন শীর্ষ তিন সমন্বয়ক। এই আন্দোলনের নেতৃত্বে কারা রয়েছেন সেটা নিয়ে অনেকের কৌতূহল রয়েছে। কাউকে কাউকে নিয়ে রয়েছে আলোচনা-সমালোচনাও। ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ ব্যানারে এই আন্দোলন পরিচালিত হচ্ছে। আন্দোলন পরিচালনা করতে দেশব্যাপী ৬৫ জনের সমন্বয়ক কমিটি করা হয়েছে। আন্দোলনের মূল নেতৃত্ব দিচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। আর সেখানে তিনজনের নাম মোটাদাগে উঠে আসছে। তারা হলেনÑ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের নাহিদ ইসলাম, ইংরেজি বিভাগের হাসনাত আব্দুল্লাহ, প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সারজিস আলম। তিনজনই ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। ছাত্রলীগ বারবার অভিযোগ করে আসছে আন্দোলনকারীরা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে আন্দোলন করছে। সরকারের পক্ষ থেকেও সেই অভিযোগ তোলা হচ্ছে। কোটা আন্দোলনকারীদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আছে কি না তা স্পষ্ট না হলেও এই আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্তদের কেউ কেউ রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।

কোটা আন্দোলনের নেতৃত্বে কারা : সম্প্রতি গঠিত রাজনৈতিক দল গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি বা ডেমোক্র্যাটিক স্টুডেন্ট ফোর্সের (ডিএসএফ) সদস্য সচিব নাহিদ ইসলাম। তিনি রয়েছেন আন্দোলনের সামনের সারিতে। কর্মসূচিগুলো ঘোষণা করেন তিনি। এছাড়া একই দলের রিফাত রশিদ, আবু বাকের মজুমদারসহ আরও বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী আন্দোলনকে পরিচালনা করছেন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে। এ অর্থে এটি পরিষ্কার যে, কোটা আন্দোলনে ছাত্রশক্তির ব্যাপক সম্পৃক্ততা রয়েছে। কোটা আন্দোলন নিয়ে নিজের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরতে গিয়ে নাহিদ ইসলাম বলেন, তখন (২০১৮ সালে) আমাদের জন্য এটি ভীষণ কঠিন ছিল। হলে হলে গিয়ে জনসমর্থন আদায় করতে হয়েছে। তারপর বৃহৎ আন্দোলন করা গেছে। এবার এটা নিয়ে তেমন কষ্ট করতে হয়নি। সবাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিয়েছে। কোটা কেন অযৌক্তিক তা সবাইই বোঝেন। তাই অনেকেই ভাবতে পারেন যে, এতে হয়ত ছাত্রলীগের প্রতিপক্ষ কোনো শক্তির সম্পৃক্ততা রয়েছে। কিন্তু আসলে তা নয়।

কোটা আন্দোলন নিয়ে ছাত্রলীগের ব্যাখ্যা এবং ব্যাপক আকারে ছাত্রশক্তির নেতাকর্মীদের সম্পৃক্ততা নিয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, দেখুন, আমরা একটি ক্যাম্পাসভিত্তিক মধ্যমপন্থি দল। ছাত্রদের সমস্যা, ছাত্রদের আশা-আকাক্সক্ষা নিয়ে আমরা কাজ করি। কোটা আন্দোলন ছাত্রদের একটি সমস্যা। ছাত্রদের প্রাণের দাবি। সুতরাং এই প্রাণের দাবিতে গণতান্ত্রিক ছাত্র-শক্তি বসে থাকবেÑ এটি হতে পারে না। ছাত্রদের যেকোনো আন্দোলনে ক্রান্তিকালে ছাত্রশক্তি থাকবে। এটি আর পাঁচটি সংগঠনের ক্ষেত্রেও একই। আন্দোলনের অন্যতম নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহ। তিনি স্কুল অফ এক্সিলেন্স নামক একটি অনলাইনভিত্তিক শিক্ষা প্ল্যাটফর্মের সহ-প্রতিষ্ঠাতা। নানা সময়ে নানা বক্তৃতায় তাকে বলতে শোনা গেছেÑ ‘আমরা লাইব্রেরির লোক, আমরা আন্দোলন কীভাবে করতে হয় তা জানি না। এসব করে আমরা অভ্যস্ত নই, রাস্তায় থাকাটা সুখকর কিছুও নয়। সুতরাং আমাদের ভুল-ত্রুটিগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।’ তার এই বক্তব্যের আলোকে এবারের কোটা আন্দোলনের চরিত্রকে ‘অরাজনৈতিক’ বলা যেতেই পারে। হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, ‘সারজিস ভাই এবং নাহিদ ইসলাম ভাইয়ের সঙ্গে আমার সংযুক্তি, এটাই প্রমাণ করে যে, এই আন্দোলন একটি গণআন্দোলনে পরিণত হয়েছে, একটি সার্বজনীন আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। দল মতো নির্বিশেষে সব মতের মানুষের নেতৃত্বে এবং অংশগ্রহণ এই আন্দোলন এগিয়ে যাচ্ছে।’ আন্দোলন সীমিত হয়ে পড়ছে কি না এ প্রশ্নে তিনি বলেন, আমাদের আন্দোলন আরও বেগবান হবে। এ নিয়ে কোনো চিন্তার কারণ নেই। দিনে দিনে এই আন্দোলন আরও শক্ত অবস্থানে যাবে।

কোটা আন্দোলনের অন্যতম পরিচিত মুখ প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সারজিস আলম। তিনি অমর একুশে হলের আবাসিক শিক্ষার্থী এবং তিনি যুক্ত ছিলেন ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে। বিসিএস প্রিলিতেও পাস করেছিলেন। তবে আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হিসেবে তার খ্যাতি রয়েছে পুরো বিশ্ববিদ্যালয়জুড়ে। সম্প্রতি ছাত্রলীগ তাকে হল থেকে বের করে দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেলে শিক্ষার্থীরা একে একে বিভিন্ন হল থেকে যাত্রা করে অমর একুশে হলের দিকে। চাপের মুখে ছাত্রলীগ তখন বাধ্য হয়ে তাকে হলে ফিরিয়ে নেয়। আদালতের রায় এবং শিক্ষার্থীদের অবস্থান নিয়ে তাকে একাধিকবার বক্তব্য দিতে দেখা গেছে। টেলিভিশন টকশোতেও তিনি যাচ্ছেন। এবারের কোটা আন্দোলনের অন্যতম মুখ্য চরিত্র সারজিস আলম। ছাত্রলীগ পরিচয়ের কারণে অনেকেই অনাস্থা জ্ঞাপন করছেন এই নেতার প্রতি। ২০২৪ সালের কোটা আন্দোলন ‘নেতাসর্বস্ব’ আন্দোলনে পরিণত হচ্ছে কি না তা নিয়েও সন্দেহ দেখা দিয়েছে আন্দোলনকারীদের অনেকের মনে। এ বিষয়ে সারজিস আলম বলেন, কারা মঞ্চে থাকছে, সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, স্লোগান দিচ্ছে, তারা আমাদের কাছে ইমপোরট্যান্ট। মাথার উপরে বিভিন্ন হাত নিয়ে যেসব পাগলের প্রলাপ কিছু মানুষ বকছেন, তারা এর একটাও প্রমাণ করতে পারলে কিংবা অন্য কোনো উদ্দেশ্য বের করতে পারলে, আন্দোলনের নেতৃত্ব ছেড়ে দেব। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, যেদিন আমাদের এই যৌক্তিক দাবি মেনে নেওয়া হবে সেদিন থেকে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ নামে কোনো ব্যানার থাকবে না।

সূত্র জানায়, ২০১৮ সালের কোটা আন্দোলনও গড়ে উঠেছিল বিভিন্ন দলের বিভিন্ন মতের মানুষকে নিয়ে। ভিপি নুরুল হক নূর তিনি ছিলেন আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা। সেই আন্দোলনের সময় নূর ছিলেন বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের অন্যতম যুগ্ম-আহ্বায়ক। এর আগে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের মুহসিন হলের উপ-মানব উন্নয়নবিষয়ক সম্পাদক ছিলেন।

গাড়ি ভাঙচুরের মামলা : কোটা সংস্কারের আন্দোলনের সময় রাজধানীর শাহবাগে পুলিশের সাঁজোয়া যান ও জল কামান ভাঙচুরের মামলা হয়েছে। পুলিশের একটি সাঁজোয়া যানের (এপিপি) চালক কনস্টেবল খলিলুর রহমান গতকাল শুক্রবার এই মামলা করেন। মামলায় আসামির সংখ্যা অজ্ঞাত বলে জানান শাহবাগ থানার ওসি মোস্তাজিরুর রহমান। মামলায় দুটি যানবাহনে জোর করে উঠে ‘উদ্দাম নৃত্য’ ও ভাঙচুর করে পাঁচ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি করার অভিযোগ আনা হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার বিকাল ৪টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন আন্দোলনকারীরা। মিছিলটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সড়ক ঘুরে বিকাল ৫টার দিকে শাহবাগে এসে অবস্থান নেয়। আন্দোলনকারীদের একাংশ বাংলামোটরের দিকে যেতে চাইলে পুলিশ বাধা দেয়। শেষ পর্যন্ত তারা শাহবাগেই অবস্থান নেন। এসময় পুলিশ ইন্টারকন্টিনেন্টালের দিকে সরে গেলেও তাদের একটি সাঁজোয়া যান (এপিসি) শিক্ষার্থীদের মাঝে পড়ে যায়। শিক্ষার্থীরা যানটির ওপর উঠে বিক্ষোভ দেখান। এতে সাঁজোয়া যানটির দুটি এসএস স্ট্যান্ড, রেডিও অ্যান্টেনা, মাডগার্ড, জল কামান ও লুকিং গ্লাস ভেঙে যায় বলে মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে। এতে আরও বলা হয়, পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা শিক্ষার্থীদের শান্ত করার চেষ্টা করলেও তারা আরও ক্ষিপ্ত হয়ে পুলিশকে লক্ষ্য করে পানির বোতল, টেপটেনিস বল ও ইটের টুকরা ছুড়ে মারে। এতে কয়েকজন পুলিশ আঘাত পান। মামলায় সরকারি কাজে বাধা, কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যদের ওপর হামলা, ক্ষতিসাধন ও ভয়ভীতি দেখানোয় ১৪৩/১৪৭/১৪৯/১৫২/৩৪১/৩২৩/৩৩২/৩৫৩/৪২৭/৫০৬ ধারায় অভিযোগ করা হয়।অনেক বক্তব্য সংবিধানবিরোধী : কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের দাবি ও অনেক বক্তব্য সংবিধানের এবং সাংবিধানিক রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতি বিরোধী বলে মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। আন্দোলন সংবিধানের বিরুদ্ধে বা আদালতের বিরুদ্ধে যাওয়ায় কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে কিনা, সেই প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে।’ গতকাল শনিবার ধানমণ্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি একথা বলেন।

পবিত্র সংবিধানের আলোকেই কেবল রাষ্ট্র পরিচালনা হয় উল্লেখ করে ওবায়দুল কাদের বলেন, রাষ্ট্র পরিচালনা সম্পর্কিত সংবিধানের ১৯ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, সব নাগরিকের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করবে রাষ্ট্র। মানুষের সামাজিক-অর্থনৈতিক অসাম্য নিরোধের জন্য নাগরিকদের মধ্যে সুষম বণ্টন নিশ্চিত করার জন্য এবং প্রজাতন্ত্রের সর্বত্র অর্থনৈতিক উন্নয়নে সমান সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণও নিশ্চিত করতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, অথচ গত কয়েক বছরে সরকারি চাকরিতে মেয়েদের অন্তর্ভুক্তি হতাশাজনকভাবে কমেছে। কোটা না থাকায় পুলিশে মাত্র চার জন নারী অফিসার সুযোগ পেয়েছে, ফরেন সার্ভিসে সুযোগ পেয়েছেন মাত্র দুজন। ৫০টি জেলার নারীরা ক্যাডার সার্ভিসে যোগ দেওয়ার সুযোগ পায়নি। ২৩টি জেলায় একজনও পুলিশে চাকরি পায়নি।

আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বলেন, সংবিধানের উল্লিখিত বিধানের উদ্দেশ্য হচ্ছে, রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে সরকারি চাকরিসহ সব খাতে সবাই যেন সমানভাগে সুযোগ পায়। সে জন্যই ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। তিনি বলেন, বিসিএস নিয়োগ পরীক্ষার ক্ষেত্রে মেধা তালিকায় নিয়োগ পায় ৭০ শতাংশের মতো। ৩৩, ৩৪, ৩৫তম বিসিএসে ৭২ শতাংশ প্রার্থীকে মেধার ভিক্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। যেখানে কোটায় নিয়োগ পেয়েছে ২৮ শতাংশ। শূন্য পদগুলোতে মেধা তালিকা থেকে নেওয়া হয়েছে। কোটায় প্রার্থী না পাওয়া গেলে যেখানে মেধা তালিকা থেকে পূরণ করা হচ্ছে, সেখানে আন্দোলনের যৌক্তিকতা নেই। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশেই কোটার ভিক্তিতে সবচেয়ে কম নিয়োগ দেওয়া হয় জানিয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, বর্তমানে ভারতে ৬০ শতাংশ, পাকিস্তানে ৯২.৫ শতাংশ, নেপালে ৪৫ শতাংশ এবং শ্রীলঙ্কার ৫০ শতাংশ কোটায় নিয়োগ দেওয়া হয়। এই পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, আমাদের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতায় কোটার প্রয়োজন রয়েছে। শিক্ষার্থীদের পুঁজি করে একটি কূচক্রী মহল রাষ্ট্রকে অস্থির করার ষড়যন্ত্র করছেÑ এমন অভিযোগ করে তিনি বলেন, এই অশুভ শক্তি এর আগেও... আমাদের কাছে তথ্য আছে। ২০১৮ সালে যখন কোটাবিরোধী আন্দোলন হয়, তখন রাজনৈতিকভাবে পরাজিত এই অশুভ শক্তি এই আন্দোলনের ওপর ভর করেছিল। নিরাপদ সড়কের আন্দোলনেও ভর করে রাজনৈতিক রূপ নেওয়ার ষড়যন্ত্র করেছে। তখন এই অশুভ শক্তির হাতে আমাদের ধানমণ্ডি পার্টি অফিসও আক্রান্ত হয়েছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন, ওই মহলটি রাষ্ট্রব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ অকার্যকর করার জন্য এবং এদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যের প্রতি শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিরূপ মনোভাব তৈরির ক্ষেত্র প্রস্তুতের চেষ্টা করেছিল। আওয়ামী লীগ তারুণ্যের শক্তিতে আস্থা রাখে মন্তব্য করে তিনি বলেন, আমরা বিশ্বাস করি, তারুণ্যের সবাইকে নিয়ে ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে সবাইকে সমান সুযোগ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণ করবে। কোটাবিরোধী আন্দোলন সংবিধানের বিরুদ্ধে বা আদালতের বিরুদ্ধে যাওয়ায় আওয়ামী লীগ কোনও ব্যবস্থা নেবে কিনাÑ এমন প্রশ্নের জবাবে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে।’

এসময় আরও উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম, বি এম মোজাম্মেল হক, আফজাল হোসেন, সুজিত রায় নন্দী, দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া এবং শিক্ষা ও মানবসম্পদ সম্পাদক, শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী শামসুন্নাহার চাপা প্রমুখ।

ছাত্রদের আন্দোলন থামানো উচিত : দেশব্যাপী চলমান কোটা সংস্কারের দাবিতে চলা শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, আমি মনে করি, তাদের (ছাত্রদের) একটু অপেক্ষা করা উচিত, আন্দোলন থামানো উচিত। কারণ, পৃথিবীর সব জায়গায় কিন্তু কোটা রয়েছে। সব দেশেই কিছু অনগ্রসর জায়গা থাকে, যেমন আমাদের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জন্য কোটা রয়েছে এবং সংবিধানেও সেটি বলা আছে। এটি বাতিল করে দিলে এরা কোনো দিন সমাজের মূলস্রোতে আসতে পারবে না। আমরা মনে করছি, সবাই যেন একসঙ্গে চলতে পারে। গতকাল দুপুরে ময়মনসিংহ জেলা পুলিশের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প উদ্বোধন শেষে সুধী সমাবেশে দেওয়া বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন।

দুপুর দুইটায় মন্ত্রী ময়মনসিংহ পুলিশ লাইনসে পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর উদ্বোধন করেন। এর আগে তিনি জেলা পুলিশের বিভিন্ন থানার ১১টি উন্নয়ন প্রকল্প উদ্বোধন করেন। এরপর ‘মুক্তিযুদ্ধে পুলিশ : ময়মনসিংহ জেলা’ গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন এবং সুধী সমাবেশে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, ছাত্র ভাইদের কিছু বলার থাকলে তারা রাস্তাঘাট বন্ধ না করে আদালতে এসে তাদের যা বলার তা যেন বলেন। রাস্তাঘাট বন্ধ করলে জনগণের দুর্ভোগ বাড়ে, হাসপাতালগামী রোগীদের দুর্ভোগ বাড়ে। যে যেখানে যাচ্ছেন, তারা বাধাপ্রাপ্ত হলে ৫-৬ ঘণ্টা বসে থাকেন। সেই সাধারণ মানুষের যে কী অভিব্যক্তি, ছাত্রদের তা শোনা উচিত। আমি মনে করি, রাস্তা অবরোধ না করে আমাদের প্রধান বিচারপতি যেভাবে বলেছেন, তাদের সব দাবি যেন আদালতে এসে বলেন।

আন্দোলন অন্যদিকে ধাবিত করার চেষ্টা : কোটা আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের অন্য কেউ ইন্ধন দিতে পারে। ঘটনাটি অন্যদিকে ধাবিত করারও চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ। গতকাল শনিবার রাজধানীর মিন্টো রোডের নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি একথা বলেন। ঢাকা মহানগর ডিবি প্রধান বলেন, কেউ যদি আদালতের আদেশ না মানে, আন্দোলনের নামে জানমালের ক্ষতি করে, সড়ক অবরোধ করে, তাহলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যে যৌক্তিক কাজ, সেটাই করা হবে। তিনি বলেন, কোটা শুধু বাংলাদেশে নয়, অনেক দেশেই প্রচলন রয়েছে। কোটার বিরোধিতা করে কিছু লোক ও কিছু শিক্ষার্থী রাস্তায় আন্দোলন করছে। এরই মধ্যে সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি নিয়ে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের ওপর এক মাসের স্থিতাবস্থা দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। সুপ্রিম কোর্ট সবার ভরসাস্থল। আদালতের নির্দেশনা সাবার মেনে চলা উচিত। কিন্তু কয়েকদিন ধরে শিক্ষার্থীরা তাদের ক্লাসে না গিয়ে, তারা বিভিন্ন সড়কে বসে সাধারণ মানুষের চলাচল বিঘ্ন ঘটাচ্ছে। অনেক জায়গায় গাড়িতে তারা হাত দিচ্ছে এবং একটি মামলাও রুজু হয়েছে।

এই ডিবি কর্মকর্তা বলেন, কেউ যদি মনে করে, আদালত মানবে না, পুলিশের কথা মানবে না তাহলে আমাদের করার কী আছে? আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যে ক্ষমতা আমরা সেটাই করবো। কারণ, আন্দোলনরতরা যদি জানমালের ক্ষতি করে, সড়ক অবরোধ করে এবং মানুষের স্বাভাবিক চলাচল বিঘ্ন সৃষ্টি করে, তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যে যৌক্তিক কাজ সেটাই করা হবে। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের অন্য কেউ ইন্ধন দিচ্ছে কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে ডিবি প্রধান আরও বলেন, আন্দোলনে অনুপ্রবেশকারী ঢুকেছে কিনা, ঘটনাটি অপরদিকে ধাবিত করার চেষ্টা চলছে কিনাÑ এসব নিয়ে ডিবির টিম ও পুলিশ কাজ করছে। কেউ যদি হাইকোর্টের নির্দেশনা না মেনে আন্দোলনের নামে সড়কে নেমে অবরোধ করে গাড়িতে হামলা ও ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে, তবে আমরা ধরে নিতে পারি অনুপ্রবেশকারীরাই এসব কাজ করছে।

মির্জা আব্বাসের ভয় : ‘শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন ভিন্ন খাতে নিতে সরকার অপকৌশল করছে’ বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির স্থাযী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস। তিনি বলেন, ‘কোটা সংস্কার আন্দোলন যারা করছে তাদের দাবি-দাওয়া ন্যায্য। বিএনপি এর সঙ্গে আছে বলে সরকার যে কথা এখন বলেছে, এসব কথা বলে আসলে বিষয়টাকে ধামাচাপা দেওয়ার প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না। এটা তাদের (সরকার) একটা অপপ্রয়াস-অপকৌশল এই আন্দোলনকে (কোটা আন্দোলন) অন্যদিকে ধাবিত করার জন্যে। আমরা ভয় পাচ্ছি এইটুকুই যে, এই আন্দোলনের ফাঁক দিয়ে আবার অন্য কোনো অপকর্ম তারা (সরকার) করছে কি না, এদেশের বিরুদ্ধে কোনো ষড়যন্ত্র করছে কি না- এটা আমরা ভয় পাচ্ছি। গতকাল শনিবার দুপুরে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের কবরে পুষ্পমাল্য অর্পণের পরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন।

কোটা সংস্কার চায় জাসদ : সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটার যৌক্তিক সংস্কার করার দাবি জানিয়েছেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার। এ জন্য অবিলম্বে কমিশন গঠনের দাবিও জানিয়েছেন তিনি। গতকাল শনিবার সকালে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে জাসদ চত্বরে এক সমাবেশে শিরীন আখতার এ কথা বলেন। দুর্নীতি-লুটপাটে জড়িত রাঘববোয়ালদের গ্রেপ্তার, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ, বিদ্যুতের ভুতুড়ে বিল বন্ধের দাবিতে এই সমাবেশ করে জাসদ। সমাবেশ শেষে জাসদের নেতা-কর্মীরা রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে বিক্ষোভ মিছিল করেন।

সংস্কারের তাগিদ ছিল গবেণষায় : প্রয়াত মন্ত্রিপরিষদ সচিব আকবর আলি খান ও সাবেক সচিব কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ ২০০৮ সালে বাংলাদেশের জনপ্রশাসনে কোটাব্যবস্থার ওপর গবেষণা করে তা কমানোর সুপারিশ করেছিলেন। ওই গবেষণায় বলা হয়, অগ্রাধিকার কোটা কোনোভাবেই মেধা কোটার চেয়ে বেশি হতে পারে না। বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) উদ্যোগে ওই গবেষণা করা হয়েছিল। যদিও সেই গবেষণার সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হয়নি। সরকারি চাকরিতে ২০টি গ্রেড আছে। সরাসরি নিয়োগ হয় মূলত ৯ম থেকে ২০তম গ্রেডে। ২০১৮ সাল পর্যন্ত এসব চাকরিতে মোট ৫৬ শতাংশ কোটা ছিল। ওই বছর ৯ম থেকে ১৩তম গ্রেডের (প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি) সব কোটা বাতিল করা হয়। তবে ১৪তম থেকে ২০তম গ্রেডে (মূলত তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণি) কোটা আগেও ছিল, এখনো আছে। যদিও প্রতিষ্ঠানভেদে এসব পদের কোটায় কিছু ভিন্নতা আছে।

 

ভোরের আকাশ/মি

মন্তব্য

Beta version