২০ সেট ডেমু ট্রেনের মধ্যে ১৯টিই অচল পড়ে আছে। এই অচল ট্রেন মেরামতে এবার সাড়ে ৫ কোটি টাকা ব্যয় দেখিয়েছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। বিষয়টি নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন অনেকে। তারা বলছেন, রাষ্ট্রের টাকা লুটপাট করতেই এ ব্যয় দেখানো হয়েছে।
জানা গেছে, স্বল্প দূরত্বে মানসম্মত যাত্রীসেবার ঘোষণা দিয়ে ২০১৩ সালে চীন থেকে ২০ সেট ডেমু (ডিজেল-ইলেকট্রিক মাল্টিপল ইউনিট) ট্রেন আমদানি করেছিল রেলওয়ে। ৬৫৪ কোটি টাকায় কেনা এসব ট্রেনের অর্থনৈতিক আয়ুস্কাল ধরা হয়েছিল ২৫ বছর। তবে পাঁচ বছরও নিরবচ্ছিন্ন সেবা দিতে পারেনি ট্রেনগুলো। এরপর ২০১৯ সালে ট্রেনগুলোতে যাত্রী পরিবহন বন্ধ হয়ে যায়। ঢাকার কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের লোকোশেডে এখন সাতটি ডেমু পড়ে আছে। ১২টি ডেমু পড়ে আছে চট্টগ্রাম ও লালমনিরহাট শেডে। একটি মাত্র ডেমু চট্টগ্রাম-দোহাজারী রুটে চলছে। সেটিও অনিয়মিত হয়ে পড়ছে। তবে চলাচল বন্ধ হলেও গত পাঁচ বছরে ট্রেনগুলোর পেছনে মেরামত বাবদ প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি টাকা খরচ দেখিয়েছে রেলওয়ে।
২০১৯-২০ অর্থবছরে ২ কোটি ৯৮ লাখ ৩৩ হাজার ৪০ টাকা খরচ দেখানো হয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে দেখানো হয়েছে ২ কোটি ৪৬ লাখ ৬৮ হাজার ৭৪১ টাকা। সংরক্ষণ, জ্বালানি ও যন্ত্রাংশ ক্রয়বাবদ এসব ব্যয় দেখানো হয়েছে। এ দুই অর্থবছরে মোট ৫ কোটি ৪৫ লাখ ১ হাজার ৭৮১ কোটি টাকা অপচয় করেছে রেলওয়ের দিনাজপুরের পার্বতীপুর ও চট্টগ্রামের পাহাড়তলী কার্যালয়। বাংলাদেশ রেলওয়ের ইন্টারনাল অডিটে (অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা) এ অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির চিত্র ফুটে উঠেছে। পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চলে কার্যালয়ের সংরক্ষিত চুক্তিপত্র, বিল, আউটটার্ন ও ট্রেন চলাচল সংক্রান্ত রেকর্ড যাচাই করে নিরীক্ষায় এমন তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। নিরীক্ষা প্রতিবেদনে এ অনিয়মের জন্য দায়ী করা হয়েছে চট্টগ্রামের পাহাড়তলী ও পার্বতীপুর কার্যালয়ের দুই কর্মব্যবস্থাপককে (ডিজেল)।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, রেলওয়ের ওয়ে অ্যান্ড ওয়ার্কস ম্যানুয়াল ও মেকানিক্যাল কোড অনুযায়ী প্রতিটি লোকোমোটিভের (রেলইঞ্জিন) স্বাভাবিক আয়ুস্কাল ধরা হয় ২০ বছর। যেকোনো ইঞ্জিন বা যন্ত্রপাতি রক্ষণাবেক্ষণের করে কার্যপোযোগী রাখার জন্য নির্দিষ্ট সময় পরপর মেরামত করা হয়।
নিরীক্ষা প্রতিবেদনে জানা যায়, মেয়াদ ফুরানোর আগে অচল ডেমু মেরামত করতে ব্যাপক অনিয়মের আশ্রয় নিয়েছেন পার্বতীপুর ও পাহাড়তলীর কর্মকর্তারা। ২০১৩ সালে দেশে আসা লোকোমোটিভগুলা মেরামত করতে ২০২০ সালে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স সামসুদ্দিন ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কসের সঙ্গে চুক্তি করে পার্বতীপুর কার্যালয়। পঞ্চগড়-পার্বতীপুর-লালমনিরহাট রুটে চলাচলকারী ডেমু ট্রেন মেরামত করতে সামসুদ্দিন ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কসকে ৮ লাখ ৯ হাজার ৩১০ টাকা পরিশোধ করা হয়। অন্যদিকে চট্টগ্রাম কার্যালয়ে ৫টি ডেমু ট্রেন মেরামতে ২ কোটি ৯০ লাখ ২৩ হাজার ৭৩০ টাকা ব্যয় করা হয়েছে। পার্বতীপুর ও পাহাড়তলী কার্যালয়ে ডেমু ট্রেনগুলো মেরামত করতে ব্যয় দেখানো হয়েছে ২ কোটি ৯৮ হাজার ৩৩ হাজার ৪০ টাকা।
নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কানাডিয়ান ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অথরিটি সিআইডিএর ম্যানুয়াল অনুযায়ী প্রতিটি ইঞ্জিন দেড় বছর পরপর এফ-সিডিউল এবং তিন বছর অপরপর জি-সিডিউল সম্পন্ন করার নির্দেশনা রয়েছে। এক্ষেত্রে ডেমু ট্রেনের ইঞ্জিনের গুরুত্বপূর্ণ দামি যন্ত্রাংশ পরিবর্তন করা হয়েছে। ২০ বছরের আয়ুস্কাল নির্ধারণ করে কেনা ডেমু ট্রেনগুলো সাত বছরের মধ্যে মেরামতের নামে প্রতিটি ইঞ্জিনের গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশ পরিবর্তন করে কয়েক কোটি টাকা খরচ করা হচ্ছে। এছাড়া এই ট্রেন বন্ধ থাকা সত্ত্বেও মেরামত বাবদ অর্থ পরিশোধ দেখানো হয়েছে।
নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, দুই সেট ডেমু ট্রেন বন্ধকালীন সময়ে ১ হাজার ৭১২ লিটার জ্বালানি তেল ও ৩২২ লিটার লুবঅয়েল ইস্যু করা হয়েছে; যার মূল্য ২ লাখ ৭৫ টাকা। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা ডেমু ট্রেন দুটির বিপরীতে ২ কোটি ৪৪ লাখ ৬৮ হাজার ৬৬৬ টাকার বিভিন্ন যন্ত্রাংশ ক্রয় করা হয়েছে। ২০২১ সালের ১৭ জুন পাহাড়তলীর ডিসিওএসের মাধ্যমে (পরিদর্শন) পার্বতীপুরের প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক বিপুল পরিমাণ যন্ত্রাংশ কিনেছেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। দুই সেট অচল ডেমুর জন্য ২ কোটি ৪৪ লাখ ৬৮ হাজার ৬৬৬ টাকার যন্ত্রাংশ কেনা হয়েছে বলে এতে উল্লেখ করা হয়। নিরীক্ষার ব্যাখ্যায় পার্বতীপুর কার্যালয় থেকে জানানো হয়, কী পরিমাণ তেল ডেমু মেরামতে ব্যবহৃত হয়েছে ও কী পরিমাণ তেল মজুত রয়েছে। কিন্তু যন্ত্রাংশ কেনার বিষয়ে কোনো তথ্য তারা দেননি।
এ বিষয়ে রেলের ডেমু মেরামতের সঙ্গে যুক্ত রোলিং স্টোক বিভাগের দ্বায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত মহাপরিচালক পার্থ সরকার গণমাধ্যমকে বলেন, ডেমুর পেছনে নতুন কোনো বরাদ্দ নেই; যা ছিল সেগুলো আগের। তবে নিরীক্ষায় আপত্তি সম্পর্কে তিনি বলেন, এ বিষয়ে নিরীক্ষা বিভাগকে জানানো হবে, এটা গণমাধ্যমকে বলার বিষয় নয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির সভাপতি হাজি মোহাম্মদ শহীদ মিয়া বলেন, সরকার রেলের উন্নয়নে বরাদ্দ যত বাড়াচ্ছে, রেলের এক শ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারির অর্থল্পিসাও তত বাড়ছে। তাদের লাগামহীন দুর্নীতির কারণে রাষ্ট্রীয় সেবাসংস্থাটির কাছ থেকে সাধারণ মানুষ কাক্সিক্ষত সেবা পাচ্ছেন না।
অন্যদিকে, দুর্নীতিবাজদের পকেট ভারী হচ্ছে। এর বিরুদ্ধে সরকারের শক্ত অবস্থান নেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে।
ভোরের আকাশ/ সু
মন্তব্য