-->

ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে হামলা

সিরাজুল ইসলাম
ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে হামলা

কোটা সংস্কার দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালিয়েছে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। গতকাল সোমবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন ক্যাম্পাসে এই হামলা চালায় তারা। কয়েকটি স্থানে হাতবোমা বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া গেছে। হামলায় তিন শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। তবে শুধু ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয় দেড়শ জনের মতো।

কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। ইডেন কলেজেও হামলায় বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। বিক্ষোভকারীদের হটাতে ছাত্রলীগ প্রস্তুত রয়েছে বলে এদিন সংবাদ সম্মেলনে জানিয়ে ছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেনও তাদের হটিয়ে দেওয়ার হুঙ্কার দিয়ে ছিলেন। এর আগের রাতে (রোববার রাতে) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যে অসন্তোষ জানিয়ে দেশের ১২টি বিশ^বিদ্যালয়ে বিক্ষোভ করেন কোটা সংস্কার দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা।

আহতদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চার শিক্ষার্থীকে ভর্তি করা হয়েছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। তারা চার হলেনÑ মাহমুদুল হাসান (২৩), ইয়াকুব (২১), রাকিব (২৪) ও মাসুদ (২৩)। তারা সবাই ঢাকা বিশ্বদ্যিালয়ের বিভিন্ন হলের আবাসিক ছাত্র। আহত মাহমুদুল জানান, বিজয় ৭১ হলের সামনে বিকাল ৩টার দিকে ইট পাটকেল ও লাঠির আঘাতে আহত হন তারা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য ঘিরে দুই পক্ষই এদিন রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে পাল্টা-পাল্টি কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল; যা নিয়ে উত্তেজনা চলছিল সকাল থেকেই। দুপুর সাড়ে ১২টার পর থেকেই বিক্ষোভ সমাবেশের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে জড়ো হতে থাকেন কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা। ছাত্রলীগ একই জায়গায় বিকাল ৩টায় সমাবেশ করার ঘোষণা দিলেও কোটাবিরোধীরা ওই জায়গা দখল করে রাখায় সরকার সমর্থক সংগঠনটির নেতাকর্মীরা জড়ো হন মধুর ক্যান্টিনে। এর মধ্যেই বিকাল সোয়া ৩টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজয় একাত্তর হল এবং মাস্টারদা সূর্যসেন হলের কাছে দুই পক্ষের মধ্যে ঢিল ছোড়াছুড়ি শুরু হয়। এরপর আন্দোলনকারীদের একটি অংশ লাঠিসোটা নিয়ে মল চত্বরে অবস্থান নেন। অন্যদিকে ছাত্রলীগের কর্মীরা অবস্থান নেন মধুর ক্যান্টিন, বিজয় একাত্তর ও সূর্যসেন হলের ভেতরে। বিকাল পৌনে ৪টার দিকে মধুর ক্যান্টিন ও বিভিন্ন হল থেকে বেরিয়ে এসে ছাত্রলীগ কর্মীর মল চত্বর থেকে আন্দোলকারীদের ধাওয়া দিয়ে ভিসি চত্বরে নিয়ে যায় এবং পিটুনি শুরু করে। হামলার মুখে কোটা আন্দোলনকারীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় এবং ক্যাম্পাসের বিভিন্ন অংশ দিয়ে ক্যাম্পাস ত্যাগ করে। অন্যদিকে ছাত্রলীগ কর্মীরা লাঠিসোটা নিয়ে ভিসি চত্বরসহ ক্যাম্পাসের বিভিন্ন অংশে অবস্থান নেয়। সংঘর্ষের পর কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের প্ল্যাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ বলেন, ছাত্রলীগ আমাদের ওপর ন্যক্কারজনক হামলা চালিয়েছে। আমাদের নারী শিক্ষার্থীদের তারা বেধড়ক পিটিয়েছে। এই হামলায় অন্তত দুইশত শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। শিক্ষার্থীদের অনেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ বিভাগের শিক্ষার্থী সুলতানা আক্তার বলেন, আমরা কখনো ভাবিনি ছাত্রলীগ এ ধরনের পরিস্থিতি তৈরি করবে। আমরা নারী শিক্ষার্থীরা অনেকে দৌড়ে পালাতে পারিনি। ছাত্রলীগের কর্মীরা হেলমেট পরে আমাদেরকে বেধড়ক মারধর করেছে, লাঠিপেটা করেছে। নিজের ক্যাম্পাসে নারী শিক্ষার্থীরা কতটা অসহায়, ছাত্রলীগ আজকে প্রমাণ করল। অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি মাজহারুল কবির শয়ন সাংবাদিকদের বলেন, আমাদের নেতাকর্মীদের তারা উসকে দিয়েছে। আমরা খুব দাঁতভাঙ্গা জবাব দিয়েছি। আজকে তাদেরকে আমরা ৫ মিনিটে ক্যাম্পাস থেকে বের করে দিয়েছি। সাধারণ শিক্ষার্থীদের আমরা বলব, আপনারা আন্দোলন থেকে সরে যান। আপনারা ২০ পার্সেন্ট সরে গেলে, দেখা যাবে বাকি ৮০ শতাংশ পলিটিক্যাল অ্যাক্টিভিস্ট। পলিটিক্যাল অ্যাক্টিভিস্টদের কীভাবে মোকাবিলা করতে হয়, সেটা আমরা জানি।

শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে শয়ন বলেন, ওরা সাধারণ শিক্ষার্থী নয়, তারা বিএনপির ইশরাকের (বিএনপির আন্তর্জাতিকবিষয়ক কমিটির সদস্য ইশরাক হোসেন) কর্মী। আপনারা গণমাধ্যম অন্ধ হয়ে গেছেন। এই আন্দোলনে সাধারণ শিক্ষার্থী ১০ থেকে ২০ শতাংশ। বাকি ৮০ শতাংশ শিবির-ছাত্রদলের অ্যাক্টিভিস্ট। জামায়াত-শিবির, ছাত্রদলকে আমরা যুগে যুগে পরাজিত করেছি। তারা কোনো কিছুই করতে পারেনি। এবারও কিছু করতে পারবে না। সংঘর্ষের সময় ছাত্রলীগের তিন থেকে চারজন নেতাকর্মী আহত হয়েছেন বলে মাজহারুল কবির শয়নের ভাষ্য।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের পিটিয়ে ছত্রভঙ্গ করে দেওয়ার পর দ্বিতীয় দফায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে সংঘর্ষে জড়িয়েছে ছাত্রলীগ। গতকাল বিকালে বিশ্ববিদ্যালয়ে মারধরের শিকার হয়ে আন্দোলনকারীরা ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসা নিতে যান। এসময় তাদেরকে জরুরি বিভাগ থেকে বের করে দেওয়ার চেষ্টা করেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। তখন কোটাবিরোধীরা সংগঠিত হয়ে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের ধাওয়া দেন। পরে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা শহীদুল্লাহ হলের পাশ থেকে কোটাবিরোধীদেরও ধাওয়া করেন। এক পক্ষ আরেক পক্ষকে লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করা শুরু করেন। পাঁচটি হাত বোমা বিস্ফোরিত হয়। তবে কারা এই ককটেল নিক্ষেপ করেছে তা তাৎক্ষণিকভাবে জানা সম্ভব হয়নি। এদিকে ঢাকা মেডিকেলের সামনে সংঘর্ষের খবর পেয়ে রাজু ভাস্কর্যের সামনে আয়োজিত ছাত্রলীগের সমাবেশ থেকে নেতাকর্মীরা সেখানে ছুটে যান। বিকাল সাড়ে ৬টায় শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা সেখানে অবস্থান করছিলেন।

ঢাকা মেডিকেল প্রতিনিধি জানান, বিকাল সোয়া ৫টার দিকে জরুরি বিভাগের সামনে লাঠিসোটা হাতে বেশ কয়েকজন এলে সেখানে হুড়াহুড়ি শুরু হয়। পরে বাঁশি বাজিয়ে আনসার সদস্যরা ছুটে এলে তারা সরে যায়। এরপর মেডিকেলের প্রধান ফটক ও জরুরি বিভাগের সামনে বিপুল সংখ্যক আনসার সদস্য মোতায়েন করা হয়। এরপর হাসপাতালে পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আসাদুজ্জামানসহ ঊর্ধ্বতনরা জরুরি বিভাগের সামনে ছুটে আসেন।

সেখানে তিনি বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে শতাধিক আহত মেডিকেলে এসেছেন। তাদের চিকিৎসার জন্য অতিরিক্ত চিকিৎসক নিয়োগ করা হয়েছে। যাদের এখন ডিউটি নেই তাদেরও কল করা হয়েছে। আর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে জরুরি বিভাগের সামনে অতিরিক্ত আনসার মোতায়েন করা হয়েছে। এসময় আহতদের সঙ্গে আসা কয়েকজন পরিচালককে বলেন, আপনারা কীসের নিরাপত্তা দিচ্ছেন? তারা তো মেডিকেলে এসে আমাদের আহতদের ওপর আবারও হামলা চালাচ্ছে। পরিচালক তখন বলেন, আমাদের জানা মতে, এখানে আহতদের সঙ্গে যারা আছেন, সবাই আপনাদেরই লোক। তারপরও আপনারা আইডেন্টিফাই করে দিলে আমাদের সুবিধা হয়।

এরপর তিনি মূল ফটকে অতিরিক্ত আনসার মোতায়েন করেন। এদিকে ঢাকা মেডিকেলের সামনে সংঘর্ষের খবর পেয়ে রাজু ভাস্কর্যের সামনে আয়োজিত ছাত্রলীগের সমাবেশ থেকে নেতাকর্মীরা সেখানে ছুটে যান। বিকাল সাড়ে ৬টায় শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা সেখানে অবস্থান করছিলেন। এদিকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হল এলাকায় কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারী ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ হয়েছে। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা হলের বাইরের সড়কে অবস্থান নিয়ে ইটপাটকেল ছুড়ছেন। অন্যদিকে হলের ভেতর অবস্থান করে আন্দোলনকারীরা ইটপাটকেল ছোড়েন। ওই এলাকায় অন্তত দুটি বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। সংঘর্ষ হয়েছে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট এলাকায়ও। ধাওয়া পাল্টা-ধাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। সন্ধ্যা সোয়া ৬টায় দোয়েল চত্বরে দেখা যায়, শহীদুল্লাহ হলের ছাদ থেকে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করা হচ্ছে।

এ কারণে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা সামনে এগোতে পারছেন না। যদিও ক্যাম্পাসের বিভিন্ন জায়গা থেকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা দোয়েল চত্বরে জড়ো হচ্ছেন। সে সময় ওই এলাকায় পুলিশ সদস্যদের দেখা যায়নি। সন্ধ্যা পৌনে সাতটার দিকে সেখানে পুলিশ সদস্যরা আসেন। শহীদুল্লাহ হল ও বার্ন ইনস্টিটিউটের মাঝা-মাঝি স্থানে দেখা যায়, সেখানে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা হেলমেট পরে লাঠিসোটা নিয়ে অবস্থান নিয়েছেন। তারা হলের ভেতর ঢোকার চেষ্টা করছিলেন। তবে হলের ফটকে ও ভবনের ছাদে থাকা আন্দোলনকারীরা ইটপাটকেল নিক্ষেপ করছিলেন। সেখানেও পুলিশ সদস্যদের দেখা যায়নি। এদিকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের এক শিক্ষার্থী টিএসসি থেকে পরমাণু শক্তি কেন্দ্রের সামনে দিয়ে শহীদ মিনারের দিকে হেঁটে যাচ্ছিলেন। তখন তাকে মারধর করেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এতে ওই ছাত্রের মাথা ফেটে রক্ত বের হয়। তাকে রিকশায় করে হাসপাতালে নেওয়া হয়।

চট্টগ্রামের ষোলশহর রণক্ষেত্র : ছাত্রলীগ ও কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের সঙ্গে দফায় দফায় সংঘর্ষে রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে চট্টগ্রাম নগরীর দুই নম্বর ষোলশহর এলাকা। গতকাল বিকাল ৫টার দিকে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। বিকাল ৫টা ৪০ মিনিট পর্যন্ত এ সংঘর্ষ চলছে। এতে এক পক্ষ অপর পক্ষের ওপর ইট-পাটকেল নিক্ষেপের পাশাপাশি বেশ কয়েকটি ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। ঘটনার পর থেকে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা ষোলশহর সড়কের ওপর অবস্থা নেন। অপরদিকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা বিভিন্ন সড়কের অলিগলিতে অবস্থান নিয়েছেন।

প্রত্যক্ষদর্শী সূত্র জানিয়েছে, বিকাল সাড়ে ৩টা থেকে নগরীর ষোলশহর স্টেশনের সামনে রেললাইনের ওপর বসে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে আসছিলেন কোটা সংস্কার নিয়ে আন্দোলনরত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। বিকাল ৫টার দিকে বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা সেøাগান নিয়ে অতর্কিতভাবে হামলা করে। আন্দোলনকারী বিশ্ববিদ্যালয় তিন শিক্ষার্থীকে মারধর করে আহত করার অভিযোগ উঠেছে। পরে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা এগিয়ে এলে উভয়ের মধ্যে ধাওয়া পাল্টা-ধাওয়া ও ইটপাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। ঘটনাস্থলের কাছাকাছি বিপুল সংখ্যক পুলিশ সদস্য ছিল। থাকা পাঁচলাইশ থানার ওসি সন্তোষ কুমার চাকমা সংঘর্ষের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) উত্তর জোনের উপ-পুলিশ কমিশনার মুখলেছুর রহমান বলেন, কোটা সংস্কারে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।

ষোলশহর এলাকায় বিক্ষোভ করছিল। ছাত্রলীগের একটি মিছিল সড়ক দিয়ে যাওয়ার সময় মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। পুলিশ উভয় পক্ষকে শান্ত করে। পুরো ঘটনার বিষয়ে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

শাবিতে হামলা : সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে হামলার অভিযোগ তুলেছেন কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। গত রোববার রাত সাড়ে ১২টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার ভবনের সামনে এ ঘটনায় কোটা আন্দোলনকারী তিনজন শিক্ষার্থী গুরুতর আহত হয়েছেন। আহতরা হলেনÑ ইংরেজি বিভাগের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী দেলোয়ার হোসেন শিশির, রসায়ন বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী আসাদুল্লাহ আল গালিব ও গণিত বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী হাফিজুল ইসলাম। তাদের সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজন শিক্ষার্থী জানান, কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীদের অবমাননা করা হয়েছেÑ অভিযোগ এনে রোববার রাত সাড়ে ১১টায় ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। মিছিলটি ছাত্রী হলের দিকে গেলে দুইশ থেকে তিনশ ছাত্রী এতে যোগ দেন। পরে মিছিলটি ছাত্রীদের আবাসিক হল হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার ভবনের সামনে যায়। এ সময় শিক্ষার্থীরা ‘চাইতে গেলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার’, ‘তুমি কে আমি কে/ রাজাকার, রাজাকার’, ‘মেধা না কোটা/ মেধা মেধাসহ বিভিন্ন সেøাগান দিতে থাকেন। বিপরীত দিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি খলিলুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক সজিবুর রহমানের নেতৃত্বে শতাধিক নেতাকর্মী শাহপরাণ হল থেকে একটি মিছিল নিয়ে আসেন। তারা সেøাগান দেন ‘আমার সোনার বাংলায় রাজাকারের ঠাঁই নাই’।

প্রত্যক্ষদর্শী শিক্ষার্থীদের ভাষ্য, দুপক্ষই বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে মুখোমুখি হলে ছাত্রলীগ কোটা আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের মানব প্রাচীর তৈরি করে বিক্ষোভ করতে বাধা দেন। এ সময় শিক্ষার্থীরা বাধা উপেক্ষা করে যেতে চাইলে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের কয়েকজনকে মারধর করেন। এতে একজন শিক্ষার্থী মাথায় আঘাত পেয়ে রক্তাক্ত হন। পরে মিছিলটি ছাত্রলীগের বাধা উপেক্ষা করেই ছাত্রদের আবাসিক হলে যায়। এরপর একটি সংক্ষিপ্ত সমাবেশ মিলিত হয়। আহত আসাদুল্লাহ আল গালিফ বলেন, আমরা শান্তিপূর্ণভাবে ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল করছিলাম। এর মধ্যে খবর পাই, মিছিলে আসতে আগ্রহী হলের কিছু ভাইকে ছাত্রলীগ আসতে বাধা দিচ্ছে। তাই আবাসিক ছাত্র হলের দিকে যাওয়ার পথে ছাত্রলীগ নামক সন্ত্রাস বাহিনীর সদস্যরা আমাদের মিছিলে বাধা দেয়। এক পর্যায়ে তারা হামলা করে। রসায়ন বিভাগের এ শিক্ষার্থী বলেন, তারা আমাদের বোনদের আঘাত করে, নির্মমভাবে নির্যাতন চালিয়েছে। এছাড়া নারী শিক্ষার্থীসহ ২০ থেকে ২৬ জন শিক্ষার্থীও আহত হয়েছেন। অনেকেই প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছেন। এদিকে হামলার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি খলিলুর রহমান। তিনি বলেন, কোনো হামলার ঘটনা ঘটেনি। সবার কাছে ভিডিও ফুটেজ আছে, তা দেখলেই বোঝা যাবে। আমরা বরং সড়কের পাশে গিয়ে তাদের যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছি। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে এই অভিযোগ করা হচ্ছে বলে জানান তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর মো. কামরুজ্জামান চৌধুরী বলেন, দুপক্ষ মুখোমুখি হলে উত্তেজনা তৈরি হলেও পরে তা স্বাভাবিক হয়ে যায়। কেউ আহত হয়েছে, শিক্ষার্থীরা এমন কোনো বিষয়ে করেননি। বর্তমানে ক্যাম্পাসের পরিস্থিতি শান্ত রয়েছে বলে জানান তিনি।

খুলনা : কোটা সংস্কার, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যের প্রতিবাদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোটা আন্দোলনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে খুলনায় মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছেন শিক্ষার্থীরা। গতকাল সোমবার সন্ধ্যা ৬টার দিকে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বিএল কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা সম্মিলিতভাবে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক থেকে মিছিল বের করেন। তারা মিছিল নিয়ে নগরীর জিরোপয়েন্ট মোড় এলাকায় মহাসড়ক অবরোধ করেন। ওই মোড়টিতে খুলনার সঙ্গে বাগেরহাট, সাতক্ষীরা ও যশোর জেলার মহাসড়ক সংযুক্ত। এছাড়া মোংলা বন্দর, ভোমরা স্থলবন্দর, নোয়াপড়া নদীবন্দর, বেনাপোল স্থলবন্দর ও খুলনা নদীবন্দরের মালামালও পরিবহন হয় এই মোড় ব্যবহার করে। শিক্ষার্থীদের অবরোধের ফলে খুলনা-সাতক্ষীরা, খুলনা-বাগেরহাট-ঢাকা, খুলনা-যশোর ও খুলনা-মোংলা মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এতে বিভিন্ন সড়কে কয়েক কিলোমিটার যানজটের সৃষ্টি হয়। শিক্ষার্থীরা জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যে তারা চরম ক্ষুব্ধ। তাদের যৌক্তিক দাবিকে দমিয়ে দিতে গত রোববার রাতে বিভিন্ন জায়গায় শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা হয়েছে। প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল করছেন তারা।

রাজশাহীতে বিক্ষোভ : চলমান কোটা আন্দোলন নিয়ে এবং কোটা সংস্কারের এক দফা দাবিতে রাজশাহীতে আন্দোলন করেছেন শিক্ষার্থীরা। গতকাল দুপুর সাড়ে ১২টায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যারিস রোডে বিক্ষোভ মিছিল ও পদযাত্রা করেছেন রাবি, রুয়েট, রামেক, রাজশাহী কলেজ ও বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। দুপুর ১২টা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যারিস রোডে অবস্থান নিতে শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। পরে দুপুর সাড়ে বারোটায় রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ, রাজশাহী কলেজ ও বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে আন্দোলনে অংশ নেন। এরপর দুপুর ২টা পর্যন্ত একযোগে বিক্ষোভ কর্মসূচি চালিয়ে যান তারা। এ সময় শিক্ষার্থীরা ‘অ্যাকশন অ্যাকশন, ডাইরেক্ট অ্যাকশন’, ‘চেয়েছিলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার’; ‘পুলিশ দিয়ে আন্দোলন, বন্ধ রাখা যাবে না’; ‘বাধা আসবে যেখানে, লড়াই হবে সেখানে’ ইত্যাদি সেøাগানে আন্দোলন মুখরিত করেন।

বরিশাল : সরকারি চাকরিতে কোটাপদ্ধতি সংস্কারের দাবি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার প্রতিবাদে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ সমাবেশ হয়েছে। গতকাল বেলা সাড়ে তিনটার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের নিচতলায় জড়ো হতে থাকেন শিক্ষার্থীরা। সেখানে তারা সমাবেশ করেন। পরে বিকেল সোয়া চারটার দিকে বরিশাল-কুয়াকাটা মহাসড়কে বিক্ষোভ করেন আন্দোলনকারীরা। এ সময় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদ জানান। একই সঙ্গে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে করা মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানান।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ে হামলা : কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের বিক্ষোভে রাতভর উত্তপ্ত ছিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। গত রোববার রাত পৌনে ৩টার দিকে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালিয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন আন্দোলনকারীরা।

প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মন্তব্যের প্রতিবাদে রোববার রাত সাড়ে ১১টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলা এলাকা থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করেন শিক্ষার্থীরা। তখন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলে দুজন আন্দোলনকারীকে অবরুদ্ধ করার অভিযোগ ওঠে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। এই খবর জানাজানি হলে মিছিলটি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হল ঘেরাও করেন তারা। এ সময় ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মীকে নিয়ে বৈঠকে বসেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের প্রাধ্যক্ষ নাজমুল হাসান তালুকদার। তখনো শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন হলের সামনে ও ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করছিলেন। পরে রাত দেড়টার দিকে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন সড়কে বিক্ষোভ মিছিল করতে থাকেন আন্দোলনকারীরা। মিছিলটি রাত সোয়া ২টার দিকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের সামনে এলে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা বাধা দেন এবং মুখোমুখি অবস্থান নেন। এ সময় দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে রাত পৌনে ৩টার দিকে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালানো হয়। হামলার একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে। এতে দেখা যায়, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হল ছাত্রলীগের সভাপতি পদপ্রত্যাশী ৪৬ ব্যাচের ছাত্র প্রাচুর্যসহ বেশ কয়েকজন হামলা করছেন। হামলায় আহসান লাবিব নামের একজন আন্দোলনকারী ও একজন নিরাপত্তা কর্মকর্তা আহত হয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের জাবি শাখার সমন্বয়ক মাহফুজ ইসলাম মেঘ বলেন, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রতিবাদে আমরা একটি বিক্ষোভ মিছিল ও জমায়েতের ডাক দিয়েছিলাম। এতে সাড়া দিয়ে বিভিন্ন হল থেকে শিক্ষার্থীরা জমায়েত শুরু করলে ২ শিক্ষার্থীকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হল ছাত্রলীগ তাদের ক্যান্টিন কক্ষে আটক করে রাখে। পরে আমরা আটককৃতদের মুক্ত করার জন্য এবং জড়িতদের শাস্তির দাবিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হল ঘেরাও করেছি। পরে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আমাদের বিক্ষোভে হামলা করে। ছাত্রলীগ কর্তৃক আটককৃত দুই শিক্ষার্থী হলেনÑ বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী কাওসার আলম আরমান ও ম্যানেজমেন্ট বিভাগের শিক্ষার্থী আশিক মাহমুদ।

এ ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ দেখার দাবি জানান আন্দোলন শিক্ষার্থীরা। কিন্তু হল প্রশাসন তা দেখাতে গড়িমসি করলে শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে পড়েন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের প্রাধ্যাক্ষ অধ্যাপক নাজমুল হাসান তালুকদার ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক আলমগীর কবীর। এরপর হল প্রশাসনের সঙ্গে একটি রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন হল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। বৈঠক শেষে হলের সামনে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মুখোমুখি অবস্থানে জড়ান ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। ছাত্রলীগের দাবি, শিক্ষার্থীদের সিসিটিভির ফুটেজ চাওয়ার এখতিয়ার নেই। এ সময় দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি বিরাজ করে। পরে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ধাওয়া খেয়ে হলে অভ্যন্তরে আশ্রয় নেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা জানান, ‘হল প্রশাসনের উসকানিতে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তাদের সঙ্গে বিবাদের জড়ানোর সাহস পেয়েছে। পরে শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে পড়ে পদত্যাগ করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক নাজমুল হাসান তালুকদার।

ইডেন কলেজে হামলা : ইডেন মহিলা কলেজের সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগ হামলা চালিয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। গত সোমবার দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যে পাদদেশে বিক্ষোভে যাওয়ার পথে এ ঘটনা ঘটে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ছাত্রলীগের হামলায় আহত হয়েছেন ইডেন কলেজের শিক্ষার্থী সায়মা আফরোজ, শাহিনূর সুমি, সুমাইয়া সাইনা, সানজিদা হক ও স্কাইয়া ইসলামসহ ১০ জন। আহতরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছেন। এ বিষয়ে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের (মার্ক্সবাদী) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক মোজাম্মেল হক গণমাধ্যমকে বলেন, ইডেন কলেজে ছাত্রলীগ আন্দোলনকারী ছাত্রীদের ওপর হামলা করেছে। এতে আহত হয়েছেন ছাত্র ফ্রন্টের ঢাকা নগর শাখার সাধারণ সম্পাদক সায়মা আফরোজ, ইডেন কলেজ শাখার সভাপতি শাহিনূর সুমি, সাংগঠনিক সম্পাদক সুমাইয়া সাইনা, অর্থ সম্পাদক সানজিদা হক এবং গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিলের ঢাকা নগরের সংগঠক স্কাইয়াসহ অনেকে। সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের সাধারণ সম্পাদক রাফিকুজ্জামান ফরিদ বলেন, দুপুরে রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত শিক্ষার্থীদের কর্মসূচিতে যোগ দিতে ইডেন কলেজের শিক্ষার্থীরা প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এ সময় ইডেন কলেজ শাখা ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মী ইডেন কলেজের শিক্ষার্থীদের ওপর গরম পানি ঢেলে দেন এবং মারধর করেন। এতে সুমিসহ কয়েকজন আহত হন। তিনি এখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি আছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের অবমাননা করা হয়েছে দাবি করে গত রোববার মধ্যরাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। মিছিল হয়েছে জাহাঙ্গীরনগর, জগন্নাথ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েও। তবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ শুরু করলে সেখানেও হামলা চালায় ছাত্রলীগ। সোমবার সরকারি চাকরিতে ‘মুক্তিযোদ্ধা কোটা’ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেওয়া বক্তব্য প্রত্যাহারের দাবিতে দ্বিতীয় দিনের মতো আন্দোলন শুরু হয়। এ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা কলেজ, ইডেন কলেজের সাধারণ শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে এসে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ সমাবেশ করেন।

কী বলে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী : ২০১৮ সালে সরকারি চাকরির প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে কোটা বাতিল করে জারি করা পরিপত্র হাইকোর্ট অবৈধ ঘোষণার প্রতিক্রিয়ায় শিক্ষার্থীরা দুই সপ্তাহ ধরে টানা আন্দোলন চালিয়ে আসছে। এর মধ্যে গত রোববার এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাফ জানিয়ে দেন, সরকারি চাকরিতে কোটার বিষয়টি আদালতেই ফয়সালা করতে হবে। বক্তব্যের এক পর্যায়ে সরকারপ্রধান বলেন, কোটা আন্দোলন করার আগে তো তোদের রেজাল্টগুলো দেখা উচিত ছিল যেÑ কোথায় তারা দাঁড়িয়েছে! দ্বিতীয়টি হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি তাদের এত ক্ষোভ কেন? মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি পুতিরা পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতি পুতিরা (চাকরি) পাবে? মুক্তিযোদ্ধাদের অপরাধটা কী? নিজের জীবন বাজি রেখে, নিজের পরিবার সংসার সব বাদ দিয়ে যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল, খেয়ে না খেয়ে, কাদা মাটিতে রোদ বৃষ্টি ঝড় সব উপেক্ষা করে যুদ্ধ করে এই দেশ স্বাধীন করেছে। মুক্তিযোদ্ধারা বিজয় এনে দিয়েছিল বলেই সবাই উচ্চপদে আসীন, আজকে বড় গলায় কথা বলতে পারছে। নইলে পাকিস্তানিদের বুটের লাথি খেয়ে মরতে হতো। প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যে ‘মর্মাহত’ হয়ে গত রোববার রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষালয়ে আন্দোলনকারীরা বিক্ষোভ দেখান; যেখানে সেøাগান দেওয়া হয়, ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার-রাজাকার; কে বলেছে কে বলেছ, স্বৈরাচার, স্বৈরাচার’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিক্ষোভে অংশ নেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, স্বাধীন বাংলাদেশে সবাই রাজাকারকে সবাই ঘৃণা করে, আমাদেরকে রাজাকার বলে সম্বোধন করা হয়েছে। ২ পারসেন্ট ছাড়া বাকি ৯৮ পারসেন্ট রাজাকার? এটা ছাত্রদের আহত করেছে। মিছিলে অংশ নেওয়া হাজি মুহাম্মদ মুহসীন হলের এক শিক্ষার্থী বলেন, প্রধানমন্ত্রীর মুখে এ ধরনের কথা আমরা কখনোই প্রত্যাশা করিনি। তিনি কোটা আন্দোলনকারীদের রাজাকারের নাতিপুতি বলেছেন, এর চেয়ে জঘন্য কথা আর কী হতে পারে? হাজার হাজার শিক্ষার্থী কোটা আন্দোলনে স্বেচ্ছায় অংশ নিয়েছে। সবাই কি রাজাকারের নাতিপুতি? রাত ১টার দিকে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা চলে যাওয়ার পর টিএসসি এলাকায় তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত, যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হোসেন খানসহ আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতা-কর্মীদের দেখা যায়। পরে ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল বের করে ছাত্রলীগ। মিছিলে ‘তুমি কে আমি কে, বাঙালি বাঙালি’, ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা’ প্রভৃতি সেøাগান দেওয়া হয়। রাত ৩টার পর রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে ছাত্রলীগ সমাবেশ করে। সমাবেশ থেকে গতকাল সোমবার বেলা ৩টায় রাজু ভাস্কর্যে প্রতিবাদী অবস্থান কর্মসূচির ঘোষণা দেন ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেন। তিনি বলেন, বাঙালির মহান স্বাধীনতাকে কটাক্ষ, একাত্তরের ঘৃণিত গণহত্যাকারী রাজাকারদের প্রতি সাফাই এবং আন্দোলনের নামে অস্থিতিশীলতা তৈরির প্রতিবাদে এ সমাবেশ হবে।

শিক্ষার্থীদের সমাবেশ : বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে শিক্ষার্থীরা ঘোষণা অনুযায়ী গতকাল সোমবার দুপুরে রাজু ভাস্কর্যের সামনে জড়ো হতে থাকেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি বুয়েট, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, ঢাকা কলেজ, ইডেন কলেজের শিক্ষার্থীরাও সমাবেশে অংশ নেন। এ সময় তারা নিজেদের দাবির পক্ষে সেøাগান, প্রতিবাদী গান ও কবিতায় কর্মসূচি চালিয়ে যান। সমাবেশে শিক্ষার্থীরা ‘কে বলেছে রাজাকার, ধিক্কার ধিক্কার’, ‘তুমি নও, আমি নই, রাজাকার রাজাকার’, ‘আমি কেন রাজাকার, জবাব চাই জবাব চাই’, ‘প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য প্রত্যাহার করতে হবে’, ‘লাখো শহীদের রক্তে কেনা, দেশটা কারও বাপের না’ ইত্যাদি সেøাগান দেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক সারজিস আলম সমাবেশে বলেন, ‘গতকাল মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাদের উদ্দেশ্য করে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যা বলেছেন, তা আমাদেরকে আশাহত করেছে। আমাদের দাবির বিষয়ে আমরা প্রধানমন্ত্রীর ওপর আস্থা রেখেছিলাম। কিন্তু গতকাল তিনি যা বলেছেন, এতে আমাদের আস্থা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। আমরা চাই, অবিলম্বে তিনি তার বক্তব্য প্রত্যাহার করবেন। আমরা স্পষ্টভাবে বলতে চাই, আমাদের যেভাবেই ব্লেম দেওয়া হোক না কেন, আমাদের উদ্দেশ্য একটিই, সেটা হল কোটা ব্যবস্থার যৌক্তিক সংস্কার। এই দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন চলবে। তিনি বলেন, উন্নত, স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে হলে মেধাভিত্তিক বাংলাদেশ গড়ার কোনো বিকল্প নাই। ৫৬ শতাংশ কোটা উন্নত বাংলাদেশের সঙ্গে যায় না। ৫৬ শতাংশ কোটা কখনো মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে যায় না।

কী নিয়ে আন্দোলন : ২০১৮ সালে সরকারি চাকরির প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে কোটা বাতিল করে জারি করা পরিপত্র হাইকোর্ট অবৈধ ঘোষণার প্রতিক্রিয়ায় শিক্ষার্থীরা মাঠে নেমেছে। তারা প্রথমে সেই পরিপত্র ফিরিয়ে আনা অর্থাৎ কোটা তুলে দেওয়ার দাবি জানালেও পরে সংস্কারের দাবি তুলেছে। গত সপ্তাহে মঙ্গলবার বাদ দিয়ে প্রতিটি কর্মদিবসেই তারা বাংলা ব্লকেড নামে অবরোধ কর্মসূচি পালন কলে সাধারণ মানুষ ভোগান্তিতে পড়ে। বুধবার পর্যন্ত তারা নির্বিঘ্নে কর্মসূচি পালন করলেও বৃহস্পতিবার থেকে পুলিশের পক্ষ থেকে সতর্কবার্তা দেওয়া হয়, একাধিক এলাকায় বাধাও দেওয়া হয়। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ কোটা নিয়ে হাইকোর্টের রায়ের ওপর চার সপ্তাহের স্থিতাবস্থা দিয়েছে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন না করে ক্লাসে ফিরে যাওয়ার এবং আদালতে এসে নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরার পরামর্শ দিয়েছেন প্রধান বিচারপতি। তবে শিক্ষার্থীরা সংসদ অধিবেশন ডেকে কোটার বিষয়ে ফয়সালা চাইছেন, আর ফয়সালা না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে বলে জানিয়েছেন। গত রোববার শিক্ষার্থীরা তাদের দাবি মেনে নিতে রাষ্ট্রপতিকে স্মারকলিপি দেন। এতে জাতীয় সংসদে জরুরি অধিবেশন ডেকে কোটা সংস্কারের দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিতে সরকারকে ২৪ ঘণ্টার সময় বেঁধে দেন আন্দোলনকারীরা। পাশাপাশি তাদের বিরুদ্ধে করা সব মামলা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তুলে নেওয়ার দাবিও জানিয়েছেন। পরে বিকালে প্রধানমন্ত্রী চীন সফর নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বলেন, কোটার বিষয়টি ফয়সালা হবে আদালতেই। আর রাস্তায় ধ্বংসাত্মক কিছু হলে আইন নিজস্ব গতিতে চলবে।

 

ভোরের আকাশ/মি

মন্তব্য

Beta version