কোটা সংস্কার আন্দোলন ইস্যুতে সহিংসতার জন্য জামায়াতে ইসলাম; তাদের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির এবং বিএনপিকে দায়ী করছে সরকার। এই প্রেক্ষাপটে জামায়াত ও ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধ করতে যাচ্ছে সরকার।
নির্বাহী আদেশে তাদের রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হবে। যেকোন সময় এ বিষয়ে সরকার প্রজ্ঞাপন জারি করবে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। গতকাল বুধবার সাংবাদিকদের তিনি এই কথা বলেন। এদিকে প্রজ্ঞাপন জারির পর জামায়াত-শিবির মরণ কামড় দিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তারা চোরাগোপ্তা হামলা চালাতে পারে। এজন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে সতর্ক থাকার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এই হামলার আশঙ্কার ইঙ্গিত পাওয়া গেছে বিরোধী দলীয় নেতা জিএম কাদেরের কথাতেও। তিনি বলেছেন, দলটি আন্ডারগ্রাউন্ডে থেকে কার্যক্রম চালাতে পারে। তবে গতকাল রাত ৯টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত প্রজ্ঞাপন জারির খবর পাওয়া যায়নি।
সূত্র জানিয়েছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে সতর্ক থাকার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় নিরাপত্তা বলয় গড়ে তুলতে বলা হয়েছে। এছাড়া র্যাব-পুলিশ ও অন্যান্য বাহিনীকে টহল জোরদার করতে বলা হয়েছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ও সুশীলদের দাবি ছিল। সেটি প্রক্রিয়াধীন। গতকাল বুধবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিজ কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, সন্ত্রাস দমন আইনের-১৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হচ্ছে। এখনও প্রক্রিয়াধীন। যেকোনো মুহূর্তে সিদ্ধান্ত জানানো হবে। প্রজ্ঞাপন জারি হবে যেকোনো মুহূর্তে। এক প্রশ্নে তিনি বলেন, জামায়াত-শিবির চলমান পরিস্থিতি তৈরি করেছে। শিক্ষার্থীদের সামনে রেখে তারা ধ্বংসাত্মক কাজ করেছে। তাদের বিচারের মুখোমুখি করতেই রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হচ্ছে।
জানা গেছে, কোটা সংস্কারের দাবিকে কেন্দ্র করে আন্দোলনের সময় সহিংসতা ও তাণ্ডবের পেছনে কাজ করেছে বিএনপি ও জামায়াত। এখন জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধের প্রক্রিয়াকে কেন্দ্র করে আবারও মাঠে নামতে পারে তারা। এমনকি প্রজ্ঞাপন জারির পর তারা মরণ কামড়ও দিতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এ অবস্থায় চোরাগোপ্তা হামলা ও নাশকতা ঠেকাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। দেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে গত মঙ্গলবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, চার সচিব ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তাদের নিয়ে এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করার পর কী ধরনের পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে; তা নিয়ে দীর্ঘসময় আলোচনা হয়েছে।
বৈঠকে উপস্থিত একাধিক সূত্র জানায়, বৈঠকে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে চোরাগোপ্তা হামলার আশঙ্কা করা হয়েছে। তাই যে কোনো নৈরাজ্য প্রতিরোধে আজ থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় কঠোর নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলার। দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। সহিংসতার মামলা, গ্রেপ্তার, সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফেরানো, কারফিউ, শিক্ষার্থীদের আন্দোলন, জামায়াতের কর্মকাণ্ডে নিষেধাজ্ঞা নিয়ে বিশদ আলোচনা হয়। মন্ত্রী ও সচিবরা যার যার মন্ত্রণালয় নিয়ে কথা বলেছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা দেশের পরিস্থিতি নিয়ে বৈঠকে অবহিত করেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এক কর্মকর্তা সভায় জানান, জামায়াত ও শিবিরের সব ধরনের কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করলে দলটির নেতাকর্মীর বিশৃঙ্খলা করার আশঙ্কা রয়েছে। তারা চোরাগোপ্তা হামলাও চালাতে পারে। এজন্য পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ও আনসারের টহল বৃদ্ধি করতে হবে।
বৈঠকে আরও বলা হয়, ঢাকা মহানগরসহ পুলিশের সব ক’টি ইউনিটকে সতর্ক থাকতে হবে। যারা সহিংসতার সঙ্গে সম্পৃক্ত তাদের যেভাবেই হোক আনতে হবে আইনের আওতায়। তবে কোনো নিরাপরাধ লোক যাতে হয়রানির শিকার না হয়, সেদিকে বিশেষ নজর দিতে বলা হয়েছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে। এর আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের সভাপতিত্বে বিশেষ বৈঠক শুরু হয়। দুই ঘণ্টার বেশি সময় ধরে বৈঠক চলে। বৈঠকের মাঝে জরুরি কাজে বের হয়ে যান তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত। এ সময় তিনি বলেন, কোটা আন্দোলনকে হাতিয়ার বানিয়ে জঙ্গিদের গণভবন ও বিমানবন্দরে হামলার পরিকল্পনা ছিল। কীভাবে তারা পরিকল্পনা করে জঙ্গি আক্রমণ করেছে, এসব বিষয় নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে।
এদিকে, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা জিএম কাদের বলেছেন, কোনো রাজনৈতিক দলকে প্রশাসনিক অর্ডারে বন্ধ করা ঠিক নয়। জনগণ তাদের জন্য কোনো রাজনৈতিক দলকে ক্ষতিকারক মনে করলে তারা বয়কট করবে। এক সময় সেই রাজনৈতিক দল বিলীন হয়ে যাবে। জোর করে কিছু করলে তাদের যদি গ্রহণযোগ্যতা ও সাংগঠনিক কাঠামো থাকে, তাহলে তারা আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করবে। এতে করে অস্বাভাবিক রাজনীতির বীজ বপণ হতে পারে। তিনি বলেন, সংঘর্ষের শুরু থেকে বিএনপি-জামায়াত বলে বলে যতবার সরকার যেভাবে প্রচার করুক না কেন, আমি ঢাকায় দেখেছি, মানুষের সাথে কথা বলেছি। জনগণ সরকারের এ কথা গ্রহণ করেনি। এটি জনগণের সংগ্রাম। বিএনপি-জামায়াত-জাতীয় পার্টির কেউ থাকলে তারা ব্যক্তিগতভাবে আন্দোলনে গিয়েছিল। গতকাল বিকেলে রংপুরে দু’দিনের সফরে এসে সার্কিট হাউজে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন তিনি।
এর আগে মঙ্গলবার আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেছিলেন, বুধবারের (গতকাল) জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করা হবে। জামায়াতে ইসলামীকে সাম্প্রতিক কোটা আন্দোলনের মধ্যে ‘সহিংসতার জন্য’ সরকারের নির্বাহী আদেশে নিষিদ্ধ করা হবে বলে জানিয়েছেন তিনি। বুধবারের মধ্যে এ সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হবে জানিয়ে তিনি বলেছেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাকে এ বিষয়ে নির্দেশ দিয়েছেন। আগামীকালকের মধ্যে একটা ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমি কিছুক্ষণ পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বসব। কোন আইনি প্রক্রিয়ায় হবে, সেটা যখন সিদ্ধান্ত নেব তখন জানাব। কালকের মধ্যে এই সিদ্ধান্ত হবে ইনশাআল্লাহ।
সোমবার রাতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের বৈঠকে জামায়াত নিষিদ্ধের পক্ষে ঐকমত্য হওয়ার পর গত মঙ্গলবার দুপুরে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন আইনমন্ত্রী। জামায়াতকে নিষিদ্ধের আলোচনা গত ১০ বছর ধরেই চলছে। এখন কোন প্রক্রিয়ায় কোন কারণে দলটিকে নিষিদ্ধ করা হচ্ছে তা আইনমন্ত্রীর কাছে জানতে চেয়েছিলেন সাংবাদিকরা। উত্তরে তিনি বলেন, গত ১৬ থেকে ২০ জুলাই কোটাবিরোধী আন্দোলনের নামে যে নৃশংসতা চালানো হয়েছে, সেখানে আন্দোলনকারীরা বলেছেন যে তারা সহিংসতার মধ্যে নেই। আমাদের কাছে তথ্য উপাত্ত আছে যে, এই জামায়াত, শিবির, বিএনপি, ছাত্রদলের যারা জঙ্গি, তারাই এটা করেছে। এই দলটাকে যদি নিষিদ্ধ করা হয় তাহলে আইনশঙ্খলা ও দেশের পরিস্থিতির উন্নতি হবে। আরেক প্রশ্নের উত্তর মন্ত্রী বলেন, কোনো দলকে যখন নিষিদ্ধ করা হয়, সেটা নির্বাহী আদেশেই হয়। যুদ্ধাপরাধের দায়ে বিচার করা এক কথা, আর দল নিষিদ্ধ করা আরেক কথা।
এর আগে সকালে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দলের যৌথসভার শুরুতে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, জামায়াতকে কীভাবে নিষিদ্ধ করা হবে, সেই আইনি দিক তারা খতিয়ে দেখছেন। আপনারা জানেন ১৪ দলের সভায় জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার বিষয়ে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হয়েছে, যা আমরা গতরাতে (সোমবার) গণমাধ্যমকে অবহিত করেছি।
জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার জন্য দীর্ঘদিনের দাবির বিষয়টি তুলে ধরে কাদের বলেন, শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে একাত্তরে ঘাতক-দালল নির্মূল কমিটির গঠিত গণআদালত ও পরবর্তীতে গণজাগরণ মঞ্চের দাবিও ছিল জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করা। জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করে হাইকোর্টের রায় দেশের সর্বোচ্চ আদালত বহাল রেখেছে। দেশের গণপ্রতিনিধিত্ব আইন অনুযায়ী, নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন না থাকলে কোনো রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ নিতে পারে না। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এমন নজির আছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে জার্মানিতে হিটলারের নাৎসি বাহিনী রাজনীতি করতে পারে না।
১৪ দলের বৈঠকে যা হয়েছিল : সোমবার গণভবনে চৌদ্দ দলের বৈঠক শেষে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ১৪ দলের এ সভায় সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হয়েছে জামায়াত-শিবির গোষ্ঠীর অপশক্তির রাজনীতি নিষিদ্ধ করার জন্য। ১৪ দলীয় জোটের নেতৃবৃন্দ মনে করেন, বিএনপি, জামায়াত, ছাত্রদল, শিবির তাদের দোসর উগ্রবাদী জঙ্গি গোষ্ঠী বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব নস্যাত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। তারা সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে দেশকে অকার্যকর করার ষড়যন্ত্র করছে। অতিসম্প্রতি চোরা-গোপ্তা হামলা করে এবং গুলি বর্ষণ করে সরকারের উপর দায় চাপাতে তারা দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। পুলিশ বাহিনীর সদস্যসহ মানুষ হত্যা করে লাশ পর্যন্ত ঝুলিয়ে রেখেছে। এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠী যে প্রক্রিয়ায় হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে, তা ইতিহাসে নজিরবিহীন। জাতীয় স্বার্থে দেশবিরোধী এ অপশক্তিকে নির্মূল করা প্রয়োজন।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক দল জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি দীর্ঘদিনের। আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ নেওয়ার পর সে দাবি আরো জোরালো হলেও গত ১৫ বছরে জোরালো কোনো উদ্যোগ সরকারের তরফে নেওয়া হয়নি। এবার কোটাবিরোধী আন্দোলনকে সহিংস রূপ দেওয়ার পেছনে বিএনপি ও জামায়াতকে দায়ী করে আসছেন সরকারের কর্তাব্যক্তিরা। তার মধ্যেই আওয়ামী লীগ সভাপতি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে ১৪ দলের বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত এসেছে।
ভোরের আকাশ/মি
মন্তব্য