রাজধানীর তেজগাঁওস্থ আওয়ামী লীগের ঢাকা জেলা কার্যালয় ও ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার কার্যালয়ে আগুন দিয়েছে আন্দোলনকারীরা। এছাড়া প্রধান বিচারপতি বাসভবনে ভাঙচুর করে তারা। বিভিন্ন জেলায় আওয়ামী লীগের কার্যালয়, থানা ও মন্ত্রী-এমপিদের হামলা চায় বিক্ষোভকারীরা।
জানা গেছে, গতকাল সোমবার বিকেল ৪টার দিকে রাজধানীর তেজগাঁওস্থ আওয়ামী লীগের ঢাকা জেলা কার্যালয়ে আগুন দিয়েছে আন্দোলনকারীরা। এ সময় পাশের গ্যাস সিলিন্ডারের দোকানেও আগুন ছড়িয়ে পড়েছে। এরপর রাজধানীতে ধানমন্ডির ৩/এতে আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার কার্যালয়ে আগুন দিয়েছেন আন্দোলনকারীরা। ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু ভবনে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে বিক্ষোভকারীরা। বিকেল পৌনে ৫টার দিকে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলতে দেখা গেছে। সেখানে বিক্ষোভকারীরা নানা স্লোগান দিতে দেখা যায়।
বিকেল ৫টার দিকে প্রধান বিচারপতি বাসভবনে ভাঙচুর চালায় বিক্ষোভকারীরা। এ সময় বেশ কিছু মানুষ দেয়াল টপকে ১৯ হেয়ার রোডে অবস্থিত প্রধান বিচারপতির বাসভবনে ঢুকে পড়ে। ভেতর থেকে চিৎকার, হইহুল্লোড় ও ভাঙচুরের শব্দ শোনা যাচ্ছিল।
এদিকে রাজধানীর ধানমন্ডির সদস্য সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বাসায় হামলা ও ভাঙচুর করছেন আন্দোলনকারীরা। গতকাল সোমবার বেলা সাড়ে ৩টার দিকে এ দৃশ্য দেখা যায়। দেখা যায়, ফটক ভেঙে হাজারো আন্দোলনকারী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসায় ঢুকে পড়েন। বাড়ির ভেতর থেকে ধোঁয়াও বের হতে দেখা যাচ্ছে। ভেতরে ভাঙচুরও চলছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের আদাবর থানায় আগুন দিয়েছে বিক্ষুব্ধ জনতা। একই সঙ্গে ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়েছে থানার মালামাল-কাগজপত্র। গতকাল সোমবার শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার পর আদাবর থানায় হামলা চালায় স্থানীয় বিক্ষুব্ধ জনতা। এ সময় শুরুতে সাধারণ মানুষকে প্রতিহত করার চেষ্টা চালায় পুলিশ। তবে জনতার রোষানলে কাছে বেশিক্ষণ টিকতে পারেনি পুলিশ। পরে থানা ছেড়ে চলে যান পুলিশ সদস্যরা। পুলিশ থানা ত্যাগ করার পর থানায় ঢুকে পরে সাধারণ মানুষ। এ সময় থানাটিতে ব্যাপক ভাঙচুর চালান তারা। একই সঙ্গে থানার লকার, চেয়ার- টেবিলসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র বের করে নিয়ে আসেন। থানার পাশাপাশি এর সামনে থাকা পরিত্যক্ত মোটরসাইকেল ও প্রাইভেট কারেও আগুন দেওয়া হয়।
চট্টগ্রাম : চট্টগ্রামে দারুল ফজল মার্কেটের নগর আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে ভাঙচুর ও আগুন দেওয়া হয়েছে। গতকাল সোমবার বিকেল চারটার দিকে বিজয় মিছিল থেকে গিয়ে কার্যালয়টিতে আগুন দেওয়া হয়। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ নেতা সিটি মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরীর বাড়িতে ভাঙচুরের পর আগুন দেওয়া হয়েছে। একইভাবে আগুন দেওয়া হয়েছে রাউজানের সংসদ সদস্য এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরীর বাসায়। বেলা তিনটার পর থেকে ছোট ছোট মিছিল নিয়ে লোকজন নগরের বিভিন্ন স্থানে জড়ো হতে থাকেন। এর মধ্যে নগরের নিউমার্কেট, দামপাড়া, কোতোয়ালি, প্রবর্তক মোড়, বহদ্দারহাট, চকবাজারসহ বিভিন্ন জায়গা অন্যতম।
বহদ্দারহাটে জড়ো হওয়া মিছিল থেকে মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরীর বাসায় ভাঙচুর করা হয়। এরপর আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। এ সময় মেয়র বাসায় ছিলেন না। তবে তার পরিবারের সদস্যরা বাসায় ছিলেন। নিউমার্কেট মোড় থেকে একটি দল গিয়ে দারুল ফজল মার্কেটের দলীয় কার্যালয়ে আগুন দেয়। এরপর বিকেল পাঁচটার দিকে কোতোয়ালি থানার পেছনে পাথরঘাটায় অবস্থিত রাউজানের সংসদ সদস্য এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরীর বাসায় আগুন দেওয়া হয়।
সিলেট : শেখ হাসিনার পদত্যাগের খবর প্রচারিত হওয়ার পরপরই মিছিল নিয়ে একদল মানুষ নগরের শাপলাবাগ এলাকায় যান। সেখানে প্রবাসী ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী ও সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শফিকুর রহমান চৌধুরীর বাসভবন ভাঙচুর ও আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।
পৃথকভাবে আরও কয়েকটি দল নগরের পূর্ব শাপলাবাগ এলাকায় সিলেট সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আজাদুর রহমান আজাদ, গোপালটিলা এলাকায় অবস্থিত সুনামগঞ্জ-১ (তাহিরপুর, জামালগঞ্জ, ধর্মপাশা ও মধ্যনগর) আসনের আওয়ামী লীগদলীয় সংসদ সদস্য (এমপি) রণজিত চন্দ্র সরকার এবং সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মাসুক উদ্দিন আহমদ ও সহসভাপতি আসাদ উদ্দিনের বাসায় হামলা চালিয়ে ভাঙচুর চালায়। এ ছাড়া নগরে আওয়ামী লীগ সমর্থিত অনেক ব্যবসায়ীর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) কার্যনির্বাহী সদস্য ও সিলেট জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক মাহি উদ্দিন আহমদ সেলিমের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর ও লুটপাট হয়েছে। সিলেটে সবচেয়ে বড় কয়েকটি কাপড়ের দোকানের মধ্যে এটি একটি। নগরের নয়াসড়ক এলাকায় প্রতিষ্ঠানটি অবস্থিত। সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আসাদ উদ্দিন আহমদ তার বাসায় ভাঙচুরের বিষয়টি স্বীকার করেন। তবে অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি।
একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, আজ বেলা তিনটার দিকে নগরের বন্দরবাজার এলাকায় অবস্থিত সিলেটের পুলিশ সুপার কার্যালয়ে আগুন দেওয়া হয়। হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের বিষয়ে জানতে সিলেট মহানগর পুলিশের কমিশনার মো. জাকির হোসেন খানের মুঠোফোনে কল করলে তিনি কেটে দেন। পরে মহানগর পুলিশের শীর্ষ পর্যায়ের দু’জন কর্মকর্তার মুঠোফোনে কল করলে তারাও ধরেননি।
বগুড়া : প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশ ছেড়ে যাওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ার পর বগুড়া সদর থানায় হামলা হয়েছে। অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে বগুড়া সদর ফাঁড়িতে। লুটপাট করা হয়েছে পুলিশ প্লাজার বিভিন্ন দোকানপাট। ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে জেলা আওয়ামীগ কার্যালয় ও দলটির নেতাদের বাড়িতে।
বগুড়া সদর থানার উপপরিদর্শক আবদুর রহিম বলেন, বিকেল সোয়া চারটার দিকে বিক্ষুব্ধ জনতার একটি বিজয় মিছিল থেকে থানা লক্ষ্য করে কয়েকটি ককটেল নিক্ষেপ করা হয়। পুলিশ তাদের ছত্রভঙ্গ করতে কাঁদানে গ্যাসের শেল ও রাবার বুলেট ছোড়ে। এরপর দফায় দফায় থানায় হামলার চেষ্টা করা হয়। এদিকে বিকেল সাড়ে চারটার দিকে শহরের নওয়াববাড়ি সড়কে বগুড়া সদর ফাঁড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়। পরে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন। প্রায় একই সময় বিক্ষুব্ধ জনতা শহরের সার্কিট হাউস মোড়ে পুলিশ প্লাজায় হামলা ও ভাঙচুর করেন। এ সময় বেশ কিছু দোকানপাট থেকে মালপত্র লুট করা হয়।
এদিকে বিকেল সোয়া চারটার দিকে শহরের জলেশ্বরীতলা এলাকার বীর মুক্তিযোদ্ধা রেজাউল বাকি সড়ক অতিক্রম করার সময় একটি মিছিল থেকে রেজ্জাক-উল-হায়দার বাণিজ্যিক টাওয়ারের নিচতলায় জেলা যুবলীগের সভাপতি ও সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শুভাশীষ পোদ্দারের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা ও ভাঙচুর করা হয়। এ ছাড়া ভবনের দোতলায় হোটেল লাভিস্তাতেও ইটপাটকেল ছুড়ে ভাঙচুর করা হয়।
বিক্ষুব্ধ জনতা জলেশ্বরীতলা এলাকায় শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল হাসানের (ববি) বাসায় হামলা-ভাঙচুর করেন। এ সময় বাসার নিচে থাকা জিপ গাড়িতে আগুন দেওয়া হয়। বিকেল চারটা থেকে পাঁচটার মধ্যে হামলা-ভাঙচুর হয়েছে বগুড়া সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সদর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আবু সুফিয়ানের (সফিক) বাসায়। বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে শহরের সাত মাথা এলাকায় জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। এর আগে দুপুরে বিক্ষুব্ধ জনতা সদর উপজেলা পরিষদে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেন। পুলিশ তাদের ছত্রভঙ্গ করতে কাঁদানে গ্যাসের শেল ও রাবার বুলেট ছোড়ে।
কুমিল্লা : কুমিল্লায় আওয়ামী লীগের নয় তলা অফিস ও কুমিল্লা ক্লাবে আগুন দিয়েছেন দুর্বৃত্তরা। এছাড়াও কুমিল্লার ঐতিহাসিক বীর চন্দ্র গণপাঠাগারে ভাঙচুরসহ শিক্ষাবোর্ডে উপস্থিত কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সামনে বঙ্গবন্ধুর ম্যুরালে ভাঙচুর চালিয়েছে স্থানীয় লোকজন। গতকাল সোমবার কুমিল্লা নগরীর কান্দির পারের পাশে থাকা এই স্থাপনাগুলোয় নাশকতা চালায় বিক্ষুব্ধ জনতা। এসময় এসবের ভিডিও করতে গেলে আওয়ামী লীগ নাম দিয়ে একজনকে মারধর করে উপস্থিত লোকজন। এসংবাদ লেখা পর্যন্ত (সন্ধ্যা ৬টা) কুমিল্লায় বর্তমানে কয়েক হাজার জনতা রাজপথে নেমে এসেছে। তারা বিভিন্ন জায়গায় থাকা আওয়ামী লীগের স্থাপনা, স্থানীয় এমপি ও নেতা-কর্মীদের বাড়িতে আগুন ও ভাঙচুর চালিয়ে যাচ্ছে।
ভোরের আকাশ/ সু
মন্তব্য